ইসলামে নিকাব নেই!?
রঙঢঙের যুগেও যেসব বোনেরা নিজেদের হিফাজত করে যথাযথ হিজাব করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাচ্ছেন, দুয়েকজন ইসলামবিদ্বেষীর কারণে সেসব বোনদের ভোগান্তি আর অপমানের শিকার হতে হচ্ছে। কিন্তু বর্তমানের ঘটনা বরং অন্যদিকে মোড় নিয়েছে। এখন যখন সেই কালপ্রিটরা বুঝতে পেরেছে যে ৮৮% মুসলিমদের দেশে কোনো প্রতিষ্ঠানে হিজাব নিষিদ্ধ করলে আর যাই হোক সুবিধা করা যাবে না, তখন তারা একটু ডিফারেন্ট এপ্রোচ নিল। আর সেটা হল হিজাব থাকুক – সমস্যা নেই, কিন্তু নিকাব পরিধান করা যাবে না। তারা ভাবল, এখন যে হারে পূর্ণ দ্বীন না বোঝা বোকা মেয়েগুলো হিজাবের নামে লালনীল পট্টি বেঁধে, লিপস্টিক দিয়ে নয়া জামানার সম্ভ্রমী সেজেছে তাতে হিজাব থাকলেও সমস্যা নেই। কিন্তু যারা এখনও দ্বীনকে আঁকড়ে ধরে নিজেদের পর্দার ইবাদাতে পূর্ণতা এনে নিকাবও করছে এদেরকে সওয়া যায় না। সুতরাং, নিকাব নিষিদ্ধ করো। তাছাড়া একদল উলামার মতামত তো আছেই।
.
প্রথমদিকে বলা হল হিজাবই তো যথেষ্ট, নিকাবের আর কী দরকার? এরপর ধীরে ধীরে এল, ইসলামে নিকাবের বিধানই নাকি নেই! আল্লাহু আকবার! ফলাফলস্বরূপ আইইউবিএটিসহ কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আমরা নিকাব নিষিদ্ধ করতে দেখেছি। আরও হয়তো অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এই কাতারে দাঁড়িয়ে আছে।
.
এখানে একটা গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট যা হয়ত আমাদের নজর এড়িয়ে যায় তা হল, জ্বিন শয়তানের মত মানব শয়তানদেরও হুটহাট কাজ না করে ধীরস্থির কর্মপদ্ধতি। বারসিসাকে যেমনি শয়তান সরাসরি জিনা-হত্যা আর শিরকের অপরাধে জড়াতে পারে নি, কিন্তু ঠিকই দীর্ঘদিনের প্রচেষ্টায় ঠিকই উপরোক্ত ভয়ানক অপরাধগুলোতে জড়িয়ে ফেলেছিল; তেমনি মানব শয়তানরাও কিন্তু সরাসরি পর্দা-হিজাব সমস্ত বাদ এমন সুর তুলে নাই। কিন্তু তারা ধীরে ধীরে অগ্রসর হচ্ছে। প্রথমে তারা নিকবকে আক্রমণ করেছে। প্রথমে বলছে নিকাব ছাড়াও পর্দা হয়। এরপর বলছে, নিকাব ছাড়াও যেহেতু পর্দা হয়, সেহেতু আমার প্রতিষ্ঠানে থাকতে হলে নিকাব করা যাবে না। এমনি হিজাব করে আসো, তাতে সমস্যা নেই; আমি তো আর ইসলামবিদ্বেষী নই যে হিজাব নিষিদ্ধ করব! এরপর হয়ত একদিন বলা হবে অমুক দিন সবাইকে শাড়িই পরিধান করতে হবে – ইত্যাদি।
.
তাছাড়া কিছুদিন পর পর এক একটা কাফির দেশে নিকাব ‘নিষিদ্ধ’ করা হয় আর একদল মানুষ ‘ইসলামে নিকাব নেই’, জাস্ট একটা কালচার ইত্যাদি বোল শুরু করেন।
.
এহেন পরিস্থিতিগুলো মাথায় রেখে ইসলামে নিকাবের বিধান নিয়ে পড়াশোনার আগ্রহ জমলো, যেহেতু সকল ফিতনার এখানেই হয়েছিল শুরু। অতঃপর যা জেনেছি সুবহানাল্লাহ! নিকাবের দলিলসমূহ থেকে শুরু করে উলামাগণ যারা নিকাব ছাড়াও পর্দা হয় এমন ফতোয়া দেন তাদের দলিলগুলোরও যথার্থ রিফিউটেশন। অর্থাৎ এককথায় জানতে পেরেছি, ইসলামে নিকাব ছাড়া পর্দা নেই।
.
পরবর্তী কয়েকটি প্যারায় আমি উল্লেখযোগ্য কয়েকটি দলিল উল্লেখ করব ইনশাআল্লাহ। আমার মতে এই বিষয়ে সবার অন্তত সাধারণ ধারণা থাকা উচিত। তানাহলে হুটহাট কেউ আপনাকে বা আপনার সামনে কোনো নিকাবি বোনকে হয়তো পার্সোনালি আক্রমণ করে বলবে, ‘ইসলামে নিকাব নেই’ আর তখন জ্ঞানহীনতার দরুণ আপনি বাধ্য হবেন মেনে নিতে। আর পরবর্তীতে ধীরে ধীরে আক্রমণের মাত্রা বাড়তে বাড়তে একসময় নিকাব খুলে ফেলবার মত বেদনাদায়ক ঘটনা ঘটতে পারে। আমরা চাই না আমাদের কারও মা, বোন, স্ত্রী বা কন্যার এমন অবস্থার শিকার হতে হয়। তাই এসব ঘটনা ব্যক্তিগত পর্যায়ে থাকাকালীনই নিকাবের শক্ত দলিলগুলো দিয়ে ইতি টেনে দিতে হবে ইনশাআল্লাহ। আর আল্লাহ তো মু’মিনদেরই সাথে রয়েছেন।
.
নিকাবের উল্লেখযোগ্য দলিলসমূহঃ
.
প্রথম দলিল
.
স্বয়ং আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনের আয়াত,
يَـٰٓأَيُّہَا ٱلنَّبِىُّ قُل لِّأَزۡوَٲجِكَ وَبَنَاتِكَ وَنِسَآءِ ٱلۡمُؤۡمِنِينَ يُدۡنِينَ عَلَيۡہِنَّ مِن جَلَـٰبِيبِهِنَّۚ ذَٲلِكَ أَدۡنَىٰٓ أَن يُعۡرَفۡنَ فَلَا يُؤۡذَيۡنَۗ وَكَانَ ٱللَّهُ غَفُورً۬ا رَّحِيمً۬ا (٥٩)
“হে নবী! আপনি আপনার স্ত্রী-কন্যাগণকে এবং মুমিনদের স্ত্রীগণকে বলুন, তারা যেন তাদের চাদরের কিয়দাংশ নিজেদের উপর টেনে নেয়। এটাই উত্তম – তাদেরকে চেনা সহজ হবে এবং ফলে তাদেরকে উত্যক্ত করা হবে না। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।”
[সূরা আহযাব: ৫৯]
এই আয়াতে সকল নারীর কথাই উল্লেখ রয়েছে। রাসূলুল্লাহর ﷺ পূন্যাত্মা স্ত্রীগণসহ অন্যান্য মুসলিম নারীগণও এই হুকুমের আওতাভুক্ত। এই আয়াতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে যে, মুসলিম নারীদের জন্য চেহারার পর্দা করা জরুরী। আরও আদেশ করা হয়েছে তারা যেন তাদের সৌন্দর্য্য পরপুরুষ থেকে আড়ালে রাখে।
.
দ্বিতীয় দলিল
.
দু’টি হাদিস ও ব্যাখ্যাঃ
حَدَّثَنَا أَحْمَدُ بْنُ يُونُسَ، حَدَّثَنَا زُهَيْرٌ، حَدَّثَنَا مُوسَى بْنُ عُقْبَةَ، عَنْ سَالِمِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ، عَنْ أَبِيهِ ـ رضى الله عنه ـ عَنِ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم قَالَ ” مَنْ جَرَّ ثَوْبَهُ خُيَلاَءَ لَمْ يَنْظُرِ اللَّهُ إِلَيْهِ يَوْمَ الْقِيَامَةِ ”
“যে কেউ অহংকার বশত তার কাপড়কে মাটিতে হেঁচড়িয়ে চলবে, আল্লাহ কিয়ামতের দিন তার দিকে তাকাবেন না।…”
[সহিহ বুখারি ৫৭৮৪, সহিহ মুসলিম ২০৮৫]
.
এই হাদিসটির বিধান কেবল পুরুষদের জন্য প্রযোজ্য, নারীদের জন্য নয় যা আরেকটি সহিহ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় –
أَخْبَرَنَا نُوحُ بْنُ حَبِيبٍ، قَالَ حَدَّثَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ، قَالَ حَدَّثَنَا مَعْمَرٌ، عَنْ أَيُّوبَ، عَنْ نَافِعٍ، عَنِ ابْنِ عُمَرَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ” مَنْ جَرَّ ثَوْبَهُ مِنَ الْخُيَلاَءِ لَمْ يَنْظُرِ اللَّهُ إِلَيْهِ ” . قَالَتْ أُمُّ سَلَمَةَ يَا رَسُولَ اللَّهِ فَكَيْفَ تَصْنَعُ النِّسَاءُ بِذُيُولِهِنَّ قَالَ ” تُرْخِينَهُ شِبْرًا ” . قَالَتْ إِذًا تَنْكَشِفَ أَقْدَامُهُنَّ . قَالَ ” تُرْخِينَهُ ذِرَاعًا لاَ تَزِدْنَ عَلَيْهِ ”
ইবনে উমার (রদিআল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,
‘যে ব্যক্তি গর্বভরে তার কাপড় হেঁচড়িয়ে চলে ক্বিয়ামত দিবসে আল্লাহ তার দিকে (রহমতের দৃষ্টিতে) তাকাবেন না।’ উম্মে সালামাহ বললেন, তাহলে মহিলারা তাদের আঁচল কী করবে? রাসূলুল্লাহ ﷺ বললেন, ‘এক বিঘত ঝুলিয়ে পরিধান করবে।’
উম্মে সালামাহ বললেন, ‘তাহলেও তো তাদের পা প্রকাশ হয়ে পড়বে।’ তখন নবী করীম ﷺ বললেন, ‘তাহলে এক হাত ঝুলিয়ে দিবে, তার থেকে বেশি না।’
[সুনানে নাসাঈ ৫৩৩৬, সহিহ]
.
উক্ত হাদিসটি মহিলাদের পা ঢেকে রাখা ওয়াজিব হওয়ার দলিল। আর এটা মহিলা সাহাবিদের নিকট সুস্পষ্ট ও জানা ছিল। আরদু’পায়ের গোড়ালির সৌন্দর্য্য তো সম্পূর্ণ মুখমন্ডল ও হাতের সৌন্দর্য্যের তুলনায় কিছুই নয়!
.
কেননা, এ বাস্তবতা অনস্বীকার্য যে মুখমণ্ডলেই মানুষের প্রকৃত সৌন্দর্য্য প্রতিফলিত হয়। তাই মুখের নিকাবও আবহমানকাল ধরে ওয়াজিব। আর সাহাবিয়্যাতদের সময় যে তা প্রচলিত ছিল তা নিচের দলিলেই স্পষ্ট হয়।
.
তৃতীয় দলিল
.
وَلاَ تَنْتَقِبِ الْمَرْأَةُ الْمُحْرِمَةُ وَلاَ تَلْبَسِ الْقُفَّازَيْنِ
“মুহরিমা (ইহরাম গ্রহণকারী নারী) যেন নিকাব ও হাতমোজা পরিধান না করে।”
[সহিহ বুখারি ১৮৩৮; সুনানে আবু দাঊদ ১৮২৫, ১৮২৬; সুনানে নাসাঈ ২৬৮১ ইত্যাদি]
এ হাদিস থেকে প্রমাণিত হয় যে, রাসূলুল্লাহর ﷺ যুগের নারীরা অর্থাৎ সাহাবিয়্যাতগণ সাধারণ অবস্থায় নিকাব এবং হাতমোজা উভয়ই ব্যবহার করতেন। আর এজন্যই ইহরাম অবস্থায় তা বিশেষভাবে নিষেধ করা হয়েছে! সাহাবিয়াতগণ যদি নিকাব আর হাতমোজা নাই পরিধান করতেন তবে ইহরাম অবস্থার জন্য এমন খাস নির্দেশ আসতো না।
.
এছাড়া শরীআতের হিকমাহ হচ্ছে ছোট বা হালকা ফিতনায় বিধান হালকা করা এবং গুরুতর ফিতনার ক্ষেত্রে কঠিন করা। এর বিপরীত করলে সেটি হবে আল্লাহর হিকমাহ ও শরীআতের মধ্যে দন্দ্ব সৃষ্টি করা। কিছু বান্দারা বলে থাকেন, ফিতনাহ বেশি হলে নিকাব করতে আর ফিতনাহ কম হলে নিকাব বাদ দিলে সমস্যা নেই। তাহলে স্বয়ং রাসূলের ﷺ যুগে ফিতনাহের কথা ভেবে উম্মুল মু’মিনিন আর সাহাবিয়্যাতরা নিকাব করতেন আর আমাদের যুগে কিনা ফিতনাহ কম হয়ে গেল! সুবহান-আল্লাহ!
.
চতুর্থ দলিল
.
হযরত মুগীরা ইবনে শু’বা (রদিআল্লাহু আনহু) হতে বর্ণিত, তিনি বলেন,
حَدَّثَنَا الْحَسَنُ بْنُ أَبِي الرَّبِيعِ، أَنْبَأَنَا عَبْدُ الرَّزَّاقِ، عَنْ مَعْمَرٍ، عَنْ ثَابِتٍ الْبُنَانِيِّ، عَنْ بَكْرِ بْنِ عَبْدِ اللَّهِ الْمُزَنِيِّ، عَنِ الْمُغِيرَةِ بْنِ شُعْبَةَ، قَالَ أَتَيْتُ النَّبِيَّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ فَذَكَرْتُ لَهُ امْرَأَةً أَخْطُبُهَا فَقَالَ “ اذْهَبْ فَانْظُرْ إِلَيْهَا فَإِنَّهُ أَجْدَرُ أَنْ يُؤْدَمَ بَيْنَكُمَا ” . فَأَتَيْتُ امْرَأَةً مِنَ الأَنْصَارِ فَخَطَبْتُهَا إِلَى أَبَوَيْهَا وَأَخْبَرْتُهُمَا بِقَوْلِ النَّبِيِّ ـ صلى الله عليه وسلم ـ . فَكَأَنَّهُمَا كَرِهَا ذَلِكَ . قَالَ فَسَمِعَتْ ذَلِكَ الْمَرْأَةُ وَهِيَ فِي خِدْرِهَا فَقَالَتْ إِنْ كَانَ رَسُولُ اللَّهِ ـ صلى الله عليه وسلم ـ أَمَرَكَ أَنْ تَنْظُرَ فَانْظُرْ . وَإِلاَّ فَإِنِّي أَنْشُدُكَ كَأَنَّهَا أَعْظَمَتْ ذَلِكَ . قَالَ فَنَظَرْتُ إِلَيْهَا فَتَزَوَّجْتُهَا . فَذَكَرَ مِنْ مُوَافَقَتِهَا .
আমি জনৈক মেয়েকে বিবাহ করার জন্য প্রস্তাব দেই এবং বিষয়টা রাসূলুল্লাহকে ﷺ বলি। রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে বললেন, “তুমি কি তাকে দেখেছো?” আমি বললাম, “না।” তিনি ﷺ বললেন, “তুমি তাকে দেখে এসো । কারণ- এ দেখাটা তোমাদের মাঝে সৌহার্দ্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে বেশ উপযোগী হবে।” ফলে আমি মেয়েটিকে দেখার জন্য যাই।
.
তখন তার বাবা-মা সেখানে ছিল এবং মেয়েটি পর্দার আড়ালে লুকিয়ে ছিল। তখন আমি বললাম, “রাসূলুল্লাহ ﷺ মেয়েটিকে দেখার জন্য আমাকে নির্দেশ দিয়েছেন।” আমার একথায় তার বাবা-মা নীরব রইলেন। অন্য বর্ণনায় আছে – “যেন তারা আমার এ কথাকে অপছন্দ করলেন।” (অর্থাৎ তারা বিবাহের আগে পাত্রীকে দেখানোর পক্ষে ছিলেন না।)
.
ইতিমধ্যে মেয়েটি বলল, “যদি রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে দেখার জন্য আপনাকে আদেশ করে থাকেন, তাহলে আপনার দেখার সুবিধার্থে আমি আপনার সামনে আসছি। আর যদি রাসূলুল্লাহ ﷺ আমাকে দেখার জন্য আপনাকে নির্দেশ না দিয়ে থাকেন, তাহলে আপনি আমার দিকে দৃষ্টি দিবেন না।” তাঁর নিকট এটা যেন ছিল এক বিরাট ব্যাপার।
.
হযরত মুগীরা (রদিআল্লাহু আনহু) বলেন, “এরপর আমি তাকে দেখি এবং তাকে বিবাহ করি।” এবং তিনি উল্লেখ করেন যে তিনি কতটা সুখী হয়েছিলেন।
[সুনানে ইবনে মাজাহ, ১৮৬৬, সহিহ হাদিস]
.
আল্লাহ আমাদের প্রতি রহম করুন। নারী সাহাবাগণ কেমন আল্লাহভীরু ছিলেন। সাহাবিকে শপথ দিচ্ছেন – আল্লাহর রাসূল অনুমতি দিলে সে তার চেহারা দেখাবে, নয়ত নয়। অথচ আমরা আজ নিকাব ইসলামে নেই বলে বলে প্রচার করছি! সেই সাহাবিয়্যাত তার জন্য বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে আসা একজন সৎ, পরহেযগার সাহাবির সামনে একবার খোলা চেহারায় আসতে কতো সংকোচ করেছেন। অথচ আমরা চেহারা অনাবৃত রেখে, নকশি বোরকা গায়ে জড়িয়ে দ্বিধাহীন চিত্তে যত্রতত্র ঘুরে বেড়ানোর দলিল আঁচড়ে বের করায় ব্যস্ত! আল্লাহু আকবার! আমাদের আল্লাহকে সর্ববিষয়ে ভয় করা উচিত এবং তাঁর ইচ্ছাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।
.
একটি বিভ্রান্তি নিরসনঃ
আল-কুরআনের সূরা আন-নূরের ৩১ নং আয়াতে আল্লাহ রব্বুল আলামীন বলেন,
وَقُل لِّلۡمُؤۡمِنَـٰتِ يَغۡضُضۡنَ مِنۡ أَبۡصَـٰرِهِنَّ وَيَحۡفَظۡنَ فُرُوجَهُنَّ وَلَا يُبۡدِينَ زِينَتَهُنَّ إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنۡهَاۖ
“ঈমানদার নারীদেরকে বলুন, তারা যেন তাদের দৃষ্টিকে নত রাখে এবং তাদের লজ্জাস্থানের হিফাজত করে। তারা যেন সাধারণ অবস্থায় যা প্রকাশমান, তা ব্যতীত তাদের সৌন্দর্য্য প্রদর্শন না করে…”
[সূরা আন-নূর, ৩১]
.
অনেকে দাবি করেন যে এই আয়াতের إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا (ইল্লা মা- যহা-র মিনহা) অর্থাৎ ‘যা সাধারণত প্রকাশমান, তা ছাড়া’ দিয়ে চেহারা আর হাতের অবকাশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু আসলে চেহারা আর হাত এর উদ্দেশ্য নয়। إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا বলে আল্লাহ সুবহানাহুতাআলা সৌন্দর্য্য প্রকাশক সেসব বিষয়াদি পরিস্থিতিকে বাদ দিয়েছেন যা এমনিই প্রকাশ হয়ে যায় অর্থাৎ যার উপর বান্দার নিয়ন্ত্রণ নেই। যেমন নারীর দৈর্ঘ্য ও খর্বতা, কৃশতা ও স্থুলতা ইত্যাদি। আবার, অনেক সময় একদিক থেকে জোর বাতাস বইলে নারীর যথাযথ পর্দা থাকা স্বত্বেও একদিকের আকৃতির কিয়দাংশ বোঝা যেতে পারে যা সম্পূর্ণ অনিচ্ছাকৃত এবং এর উপর বান্দার চেষ্টা সত্ত্বেও আদতে নিয়ন্ত্রণ থাকে না। আর এই বিষয়গুলো বোঝাতেই আল্লাহ রব্বুল আ’লামীন إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا বা ‘যা সাধারণত প্রকাশমান’ বলেছেন।
.
কিন্তু তিনি সুবহানাহুতা’লা إِلَّا مَا ظَهَرَت (ইল্লা মা- যহা-রতু) বা ‘নারী নিজ ইচ্ছায় যা প্রকাশ করে’ বলেন নাই।
.
সুতরাং, আল্লাহর আয়াতটির إِلَّا مَا ظَهَرَ مِنْهَا (ইল্লা মা- যহা-র মিনহা) বা ‘যা সাধারণত প্রকাশমান’ এর উদ্দেশ্য হল,
যে বিষয়াদিগুলো ইচ্ছা ব্যতীত এমনিতেই স্বাভাবিকভাবে প্রকাশিত হয়ে যায় সেগুলো।
.
সুতরাং আমাদের আল্লাহকেই যথার্থরূপে ভয় করে তাঁর বিধান মেনে নেওয়াই কল্যাণকর।
يَـٰٓأَيُّہَا ٱلَّذِينَ ءَامَنُواْ ٱتَّقُواْ ٱللَّهَ حَقَّ تُقَاتِهِۦ وَلَا تَمُوتُنَّ إِلَّا وَأَنتُم مُّسۡلِمُونَ (١٠٢)
“ওহে যারা ঈমান এনেছো! তোমরা আল্লাহকে সেভাবে ভয় করো যেভাবে ভয় করা উচিত। আর তাঁর নিকট পরিপূর্ণ আত্নসমর্পণকারী (মুসলিম) না হয়ে মৃত্যুবরণ করো না।”
[সূরা আল-ইমরান, ১০২]
.
এখানে কেবল উল্লেখযোগ্য দলিলগুলো দেওয়া হয়েছে। ইসলামের এই ওয়াজিব বিধানটির ওয়াল্লাহি আরও বহু দলিল রয়েছে।
.
পরিশেষে
.
আমাদের সামনে যখন কোনো বোনের নিকাব বা হিজাব নিয়ে ঠাট্টা করা হবে বা কথা শোনানো হবে তখন তা আসলে কেবলই সেই বোনের জন্য পরীক্ষা নয়। বরং তা আমাদেরও পরীক্ষা সুবহানাল্লাহ! কারণ তখন আসলে ইসলামের একটি বিধানকে আক্রমণ করা হয়েছে! তাই সামনে এগিয়ে তখন কথা না বললে নিজে কতটুকু দ্বীন ধারণ করি, পালন করি সেই প্রশ্নের চেয়ে নিজের দ্বীন কতটুকু বাকি রইল সেই প্রশ্নই গুরুতর হয়ে যায়।
.
অনেকেই শাইখ আলবানি সহ পূর্ববর্তী ইমামগণের ‘মুখ খোলা রাখা জায়েজ’ মতামত নিয়ে আসেন। প্রিয় ভাই ও বোন, কন্টেক্সট বোঝার চেষ্টা করুন। ‘ইসলামে নেই’ আর ‘ভিন্নমতও রয়েছে’ – এই দু’টো সম্পূর্ণ আলাদা ব্যাপার সুবহান-আল্লাহ!
.
যে বোনেরা আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য নিকাব করেন – তারাও ইমামদের একটা সুপ্রতিষ্ঠিত মতই অনুসরণ করছেন। তাহলে ‘ইসলামে নিকাব নেই’ এমন দাবি তো মানা যায় না। তাই ভিন্নমতের অনুসারী মুসলিমদেরও তো কাফির-তাগুতদের বিরুদ্ধে মাজলুম ভাইবোনদের পক্ষই নিতে হবে। কিন্তু হায়! চিন্তার অসারতা আমাদেরকে কীভাবেই না জেঁকে ধরেছে!
.
আর আল্লাহকে ভালবেসে আল্লাহর বিধান মেনে নিয়ে হিজাব করতে পারলে, আল্লাহর জন্যই নিকাবও করা যায়। তাছাড়া আমাদের ইমামদের কোন মতগুলো আমাদের আখিরাতের নিরাপত্তা দেয় আর কোন মতগুলো দুনিয়াবি খাহেশাত পূরণের সুযোগ করে দেয় সেটা নিজের কাছেই প্রশ্ন করা যেতে পারে। অবশ্য নফসের কারণে নিজেকেও ধোঁকা দিয়ে দেওয়া সম্ভব, কিন্তু আল্লাহকে তো ধোঁকা দেওয়া সম্ভব নয়! তাই আমরা যেন সিদ্ধান্ত নেওয়ার সময় আল্লাহ রব্বুল আ’লামীনকে যথার্থ ভয় করি।
.
আল্লাহ আমাদের যথার্থরূপে ইসলামের বিধানগুলো মেনে নেবার এবং মেনে চলবার তাওফিক দিন। আল্লাহ আমাদের যথার্থরূপে সৎ কাজের উপদেশ ও অসৎ কাজে বাধা দেওয়ার তাওফিক দিন। আল্লাহ আমাদের চেষ্টাগুলোকে কবুল করুন।
.
লেখা – তানভীর আহমেদ