ফজরের আজান দিয়ে নামাজ পড়ানোর উদ্দেশ্যে মুসুল্লিদের জন্য অপেক্ষারত আছে মুয়াজ্জিন সামছুল হক।যদিও মসজিদে আরো একজন মুয়াজ্জিন আছে।হক সাহেবের অনুপস্থিতিতে সেই আজান দেয়।তবে ফজরের আজান দেওয়াটা হক সাহেব কখনও মিস করে না । প্রায় ২৫ বছর ধরে গ্রামের পূর্ব পুরুষের দ্বারা নিজেদের জায়গার নির্মিত মসজিদের মুয়াজ্জিন হিসেবে দায়িত্ব পালন করে আসছে।শুধু তাই না গ্রামের একজন ভালো আর পরোপকারী মানুষ হিসেবেও যথেষ্ট নাম ডাক আছে তার।মাওলানা পাশ করেও চাকরীর জন্য গ্রাম ছেরে বাইরে কোথাও যায়নি শুধু গ্রামের মানুষগুলোর কথা ভেবে।তবে নিজের এলাকার মাদ্রাসায় শিক্ষকতা করে আসছে দীর্ঘ দিন ধরে।আর্থিক অবস্থা ও বেশ ভালো তার।
ধীরে ধীরে মুসুল্লিরা আসতে শুরু করেছে সালাত আদায়ের জন্য।সামছুল হক জানে প্রতিদিন কতো জন আসে তাই তাদের আসা পর্যন্ত অপেক্ষা করতে লাগলো ,সবাই আসলেই সালাত শুরু করে দিবে।
এদিকে সামছুল হকের বাড়ীতে তার স্ত্রী ছেলে মেয়েকে ডাকছে নামাজের জন্য কিন্তু তারা উঠছো না।অবশেষে ডাকতে ডাকতে তাদের উঠাতে সক্ষম হলো।ছেলেকে হাতমুখ ধুইয়ে ফ্রেশ করে মসজিদে পাঠালো আর মেয়েকে নিয়ে নিজে নামাজ পড়তে গেলো।
মসজিদের নামাজ শেষ করে সামছুল হক সবাই কে নিয়ে বসে অনেকক্ষণ সবার সাথে বিভিন্ন ধরনের কথা নিয়ে আলোচনা করে থাকে। এর মধ্যে কারো সুখ দুঃখ কষ্টের কথা অথবা গ্রামের কোথায় কি সমস্যা সে সব নিয়ে ও আলোচনা করে থাকে।এ সব সমস্যা পুরোটা সমাধান সে দিতে না পারলেও অন্তত আশি শতাংশ সমস্যার সমাধানের একটা পরিকল্পনা দিয়ে থাকে।আজও তাই করছে,
-সবাই কেমন আছো?
এক সাথে সবাই বলে উঠলো আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছি।
-কারোর কোনো সমস্যা থাকলে বলতে পারো।
হতোদরিদ্র কলিমউল্লাহ বলে উঠলো
-হুজুর আমার অবস্থা তো সবাই জানে ঘরে মেয়ে বড়ো হইছে বিয়া দিতে হইবো ,এক জায়গা দিয়া সমন্ধ আইছিলো পছন্দও হইছে ,হেরা ভারি ধরা ধরছে মেয়ে নিবোই তারা ।চাওয়া পাওয়া নাই তাগো কিন্তু এহোন আমি বিয়া দিতে গেলে ধুমধাম কইরা না দিলেও কিছু তো খরচ করতে হইবো ।আমার তো হেই সামর্থ ও নাই।কি কইরা মেয়েডারে বিয়া দিমু একটা পরামর্শ দেন হুজুর বলে চোখ মুছতে থাকলো।
সামছুল হক তাকে সান্তনা দিয়ে থামালো।
-এখানে যারা আছো সবাই তো মোটামুটি আমরা স্বচ্ছল তাই যে যার সামর্থ অনুযায়ী কলিমউল্লাহ কে সাহায্য করবে আর সেটা আমার কাছে দিবে নামাজ পরতে এসে মসজিদে দিয়ে যাবে।আমি চাই না পথে ঘাটে বা বাড়িতে এসে দিয়ে যাও।আর কলিমউল্লাহ আমিও আমার সাধ্যমতো সাহায্য করবো দেখবে ইন শাহ আল্লাহ ঠিক সময় মতো তোমার মেয়ের বিয়ে হবে।
কথা গুলো শুনে কলিমউল্লাহ খুশি হয়ে দুহাত তুলে দোয়া করে দিলো।
-আর কোনো সমস্যা আছে থাকলে বলতে পারো?
আরেকজন বলে উঠলো
-হুজুর উওর পাড়ার যে খাল আছে হেইহানের বাঁশের চাড় ভাইঙ্গা গেছে পার হইতে কষ্ট হয় ,বাচ্চা পোলাপাইন গুলা তো পার হইতে গেলে কান্দে ভয় পায় কি করা যায় কন তো?আর এগুলা গ্রামের মেম্বার রে কইলে কয় ঠিক কইরা দিমু কিন্তু দেয় না।এহোন আপনে কিছু করেন।
-আচ্ছা শোনো সবাই ,আর কারো কাছে যাওয়ার দরকার নাই তোমাদের।সবারই তো ছোটো বড়ো বাঁশ ঝাড় আছে তাই সবাই পছন্দ মতো বাশ কেটে কাল শুক্রবার যার যার বাশ এনে আর যা লাগে সাথে করে এনে জুম্মার আগে হাতে হাতে চাঁড় বানানোর কাজ শেষ করতে হবে।সবাই মিলে যদি এই ভাবে কাজটা একসাথে করি তা হলে আর কোনো সমস্যা থাকবে না।
মনে রাখবে সবাই একতা বদ্ধ হয়ে কাজ করলে অন্যের কাছে হাত পেতে দায় গ্রস্থ হওয়া লাগে না।
সবাই সামছুল হকের কথায় খুশি হলো আর একতা বদ্ধ হয়ে কাজ করবে বলে অঙ্গীকার বদ্ধ হলো।
-তা হলে এখন যাও সবাই আবার জহুরের ওয়াক্তে দেখা হবে।সামছুল হক ছেলেকে নিয়ে মসজিদ থেকে বের হয়ে বাড়ির দিকে হাঁটা ধরলো।বাড়ির দুরত্ব বেশি না একদম কাছেই।
~~~~~~
সামছুল হকের এক ছেলে এক মেয়ে ।মেয়ে “রুমাইসা হক রাইসা”এবার এইসএসসি দিবে যদিও এসএসসি মাদ্রাসা থেকে পাশ করে পরে কলেজে ভর্তি হয়েছিলো আর ছেলে তাওসীফ হক এবার মাদ্রাসায় ৫ম শ্রেনিতে পড়ে।
সামছুল হকের ভাই নেই একমাএ বোন ছিলো সেও একমাএ ছেলেকে রেখে পরপারে চলে গেছে।বোনের স্বামী দ্বিতীয় বিয়ে করে নিয়েছে তাই ভাগ্নে যাতে সৎমায়ের দ্বারা কোনো কষ্ট না পায় সে জন্য ছোটো থেকেই তাকে নিজ বাড়িতে রেখে লেখাপড়া শিখিয়ে একজন আদর্শ মানুষ হিসেবে গড়ে তুলেছে।কারন মৃত্যুর আগে বোনকে কথা দেওয়া লাগছে ছেলের সব দায়িত্ব যেনো ভাই নেয়।অক্ষরে অক্ষরে বোনের সব কথা রেখেছে শুধু আর একটা কথা রাখা বাকি সেটা হলেই সামছুল হকের মাথা থেকে যেনো পাথর পরিমাণ চিন্তাভাবনা দূর হয়।
“একমাএ ভাগ্নে নাম তার “অলীদ আহনাফ” মাদ্রাসা থেকে লেখাপড়া শেষ করে উচ্চতর স্নাতক পড়ার জন্য শহরে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত আছে।দেখতেও মা শাহ আল্লাহ অনেক সুন্দর একদেখায় যে কেউ পছন্দ করতে বাধ্য শুধু তাই না অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট,নিজ প্রচেষ্টা আর মামার অনুপ্রেরনায় এ পর্যন্ত আসতে পেরেছে।নিজে চলার জন্য কোম্পানির একটা জব ও করছে।মোটামুটি ভালোই চলে যাচ্ছে দিনকাল।”
বাড়ীর ভিতর ডুকেই হক সাহেব তার সহধর্মিনীকে ডাকতে শুরু করলো।
-কই গো রাইসার মা কোথায় তুমি?
-এই যে রান্না ঘরে আছে আপনি ঘরে বিশ্রাম নিন আমি নাস্তা বানিয়ে আনতেছি।
-আমার আম্মাজান কই এখনও ওঠেনি?
-আপনার আম্মাজান উঠে নামাজ পইড়া আবার ঘুমাইছে।
-ওহ আচ্ছা।রাইসার মা মনে আছে তো আজ কিন্তু আমাদের অলীদ আসবে ঢাকা থেকে।
-হা মনে আছে তো।আপনি নাস্তা করে বাজারে চলে যাবেন কিন্তু।
-হুম ঠিক আছে।
পাশ থেকে তাওসীফ আনন্দে লাফিয়ে উঠল
-ইয়ে আজ ভাইয়া আসবে খুব মজা হবে তা হলে।
তাওসীফের খুশি দেখে হক সাহেব ও মনে মনে খুশি।অলীদ কে তিনি যেমন ভালোবাসা দিয়ে বড়ো করছেন নিজের সন্তানের চাইতে কম অংশে যেমন ভালোবাসার কমতি ছিলো না তেমনি অলীদ ও তাওসীফ কে নিজের আপন ভাইয়ের মতো ভালোবাসে ।তাওসীফ যেনো অলীদ বলতে পাগল।
হক সাহেব খেয়ে দেয়ে বাজারে চলে গেলেন।রাইসার মা রাইসাকে ডেকে তুললেন
-রাইসা উঠ মা আজ ছেলেটা শহর থেকে আসতেছে ,খেয়ে দেয়ে ওর ঘরটা একটু গুছিয়ে দিয়ে আয় মা।
-উফ মা আমি পারবো না তুমি করো গিয়ে।বিরবিরিয়ে বলতে লাগলো আসতেছে লাট সাহেব ওনার জন্য বাড়িঘর গুছানো লাগবে কেমন জেনো নতুন জামাই আসতেছে!
-কি হলো উঠছিস মা?
-উঠছি উঠছি ,ওহ একটু শান্তি মতো ঘুমাতে পারলাম কই।

রাইসা ওঠে খেয়ে দেয়ে অলীদের ঘর গোছাতে লাগলো।এর মধ্যে তাওসীফ এসে বলতে লাগলো
-জানো আপু আজ ভাইয়া আমার জন্য অনেক চকলেট নিয়ে আসবে।
-তো আমাকে বলছিস কেনো?
-তুমি তো ভাইয়া কে পছন্দ করো না তাই তোমাকে দিবো না।
-এই যাবি এখান থেকে আমি কি তোর চকলেট খেতে চাইছি।
যা এখান থেকে ।
বোনের তাড়া খেয়ে তাওসীফ দৌড়ে চলে গেলো।
রুম গোছাতে গোছাতে রাইসা অলীদের অনেক আগের একটা ছবি পেলো।ছবিটা হাত বুলিয়ে দেখতে লাগলো ,এই ছবিটার সময় কাল যখন তখন রাইসা ক্লাস তৃতীয় না হয় চতুর্থ শ্রেণীতে পড়ে।
একদিন স্কুলে যাওয়ার সময় রাইসা অনেক সেজেগুজে বের হলো সাথে ওর ক্লাসের আরো কয়টা মেয়ে ছিলো।রাস্তা দিয়ে ওদের সাথে হাসছে আর কথা বলতে বলতে যাচ্ছে ঠিক তখনই অলীদ সামনে পরে যায় ।রাইসা কে একনজর দেখেই অলীদের মেজাজ ভিষণ খারাপ হয়ে যায় কেনোনা রাইসা ঠোঁটে গাড়ো লিপিস্টিক,কপালে টিপ আর স্কার্ফ টাও মাথায় ছিলো না এ অবস্থায় দেখে নিজের রাগ নিয়ন্তন করতে না পেরে দিলো এক চর শুধু তাই না হাত ধরে টানতে টানতে বাড়ি এনে মামার কাছে বিচার দিলো আর এর পরেই স্কুল থেকে রাইসা কে মাদ্রাসায় ভর্তি করানো হলো।ঐ ঘটনার পর থেকেই রাইসা অলীদ কে একদম সহ্য করতে পারেনা।কারন ও যেমন চলতে চাইতো সেটা অলীদের জন্য পারতো না।মুখে কিছু না বললেও মনে মনে রাগ ঠিকই ছিলো।
পূর্বের কথা ভাবতে ভাবতে মায়ের ডাকে হুসে এলো।একনজর ছবিটার দিকে তাকিয়ে ছবিটা ছিঁড়তে গিয়েও ছিঁড়লো না।ড্রয়ারে রেখে সব কিছু ঠিকঠাক করে রুম ঝাড় দিয়ে বের হয়ে গেলো।
হকসাহেব অনেক বাজার করে নিয়ে এসেছে সে গুলো রান্না ঘরে নেওয়া হয়েছে।রাইসার মাকে সে বলে দিয়েছে ছেলেটার যা যা পছন্দ সে গুলোই যেনো রান্না করে।মিসেস হক ও সায় দিলেন
-আরে এতো বলা লাগে আমি কি জানি না ? এতো বছর আমার কাছে ছিলো আর আমাকে আপনি বলে বলে দিচ্ছেন?
-বুঝো না অনেক খুশি লাগছে যে ,আজ অনেক দিন পর আসতেছে।আচ্ছা একটা কল করে জেনে নেই কতোদূরে আছে।
ফোন করে জানতে পারলো প্রায় কাছাকাছি চলে আসছে।
কতোক্ষণ পরেই তাওসীফ ডেকে ডেকে বাড়ি মাথায় করে তুলছে
-মা আব্বু আপু কই গেলে দেখো কে এসেছে
সবাই ঘর থেকে বের হয়ে অলীদ কে দেখে খুশি হলো মামা আর মামীর সাথে সালাম বিনিময় করে ঘরে উঠে বসলো ।কিন্তু ঘরের একজন সদস্য তার সামনে অনুপস্থিত ।অলীদের একজোড়া চোখ শুধু তাকেই খুঁজছে ,মনের মধ্যে যেনো অস্থিরতা বিরাজ করছে কিন্তু সে কই সামনে কেনো আসছে না ,নাকি আজও আমাকে ঘৃণা করে আমার সামনে আসতে দ্বিধা বোধ করছে….!!
(ইসলামিক,সামাজিক ও রোমান্টিক ক্যাটাগরির)
carnation e book