ঈশাম ঘুমাচ্ছে। এতই ঘুম দিয়েছে যে জোরে জোরে নি: শাসের শব্দ নীরার কানে ভেসে আসছে । গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ঈশাম। নীরা তাকিয়ে আছে ঈশামের দিকে। এখন নীরার লজ্জা লাগছে না। কারন ঈশামের চোখ বন্ধ। যদি ঈশামের চোখ খোলা থাকত নিশ্চয় এতক্ষন নীরা ঈশামের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারত না, চোখ ফিরিয়ে নিত।
.
বিছানার পাশে বইয়ের টেবিল। নীরা এক হাত বাড়িয়ে সামনে থাকা একটি বই নিল। বইটি নেড়েচেড়ে মাঝখানের পৃষ্ঠা খুলে ফেলল।
বড় বড় হেডলাইনে লিখা-
আল্লাহ ব্যতীত অন্য কাউকে সিজদা করার অনুমতি থাকলে স্ত্রী তার স্বামী কে সিজদা করতে হত।
নীরা এই লিখাটি দেখে তার চোখ কপালে উঠল। এমন একটি কথা এখানে লিখা?
আসলে ব্যাপারটা কি?
কৌতূহলী হয়ে নীরা পরের অংশে চলে গেল বিষয়টা জানতে।
হযরত আবু হুরায়রা ( রা) হতে বর্নিত, নবী কারীম ( সা) বলেছেন-
আমি যদি কাউকে সিজদা করার অনুমতি প্রদান করতাম তাহলে স্ত্রীদেরকে তাদের স্বামী কে সিজদা করার অনুমতি দিতাম। ( তিরমিজি- ১-১৩৮)।
.
এত সম্মানিত স্বামী স্ত্রীদের কাছে?
একটা কবুল বলার পর একটা ছেলে এতই সম্মানিত হয়ে যায় একটা মেয়ের কাছে?
নীরা ভাবছে। এরপর পরতে লাগল,
হযরত কায়েস বিন সাদ ( রা) এর বর্ননায় রয়েছে যে, তিনি হিরা প্রদেশে গিয়ে দেখতে পেলেন ইহুদীরা তাদের ধর্মগুরু কে সিজদা করছে। সেখান থেকে তিনি ফিরে এসে নবী কারীম ( সা) কে এ বিষয়ে অবহিত করলেন এবং বললেন,
হে আল্লাহর রাসূল ( সা)! সিজদা পাওয়ার অধিকারি আপনিও ।
রাসূলুল্লাহ ( সা) বললেন-
আমার কবরের পাশ দিয়ে যাবার সময়ও কি কবরে সিজদা করবে?
আমি বললাম- না।
রাসূলুল্লাহ ( সা) বললেন-
আমি যদি সিজদা করার হুকুমই করতাম তাহলে স্ত্রী কে আদেশ করতাম সে যেন তার স্বামী কে সিজদা করে। কারন আল্লাহ পাক তাদের এ অধিকার রেখেছেন। অর্থ্যাত, সম্মানের সিজদা করতে আদেশ করতাম।
( আল্লাহ ব্যতীত কাউকে সিজদা করতে বলা হয় নি)।
.
নীরা ঈশামের কাছে অনেক হাদিস শুনেছে। সব কাজেই হাদিস দ্বারা বুঝিয়ে দিত। এবার নীরা ঈশামের দিকে তাকাল।
কি ঘুম! ঘুমের মধ্যে যে কি স্বপ্ন দেখছে আল্লাহ জানে!
নীরা তার মুখটা ঈশামের কাছে নিয়ে গেল।
এত কাছ থেকে নীরা কখনও ঈশামকে দেখে নি।
আহা! কি মায়াবি চেহারা! চাপ দাড়ি যেন চিকচিক করছে। হালকা গড়নের মুখ। কি মমতার চাদরে পুরো মুখটা ছেয়ে আছে।
আমি এই জিনিসটা এত দিন দেখি নি। কিসের জন্য দেখতে চাই নি? এত মায়ায় কেন পরতে চাই নি?
ঈশাম? তুমি কি আমাকে কখনও ক্ষমা করবে? আমি যে তোমার প্রতি খুব দুর্বল হয়ে পড়ছি। আমি কেন তা তোমাকে বুঝাতে পারছি না। তুমি যে আমার স্বামী, আমার জীবনসংগি! এটা আমার হৃদয়ে গেথে গেছে! কেন আমি তোমাকে বলতে পারছি না?
.
ঈশামের দিক থেকে মুখ টা ফিরিয়ে আবার বইয়ের পাতায় ফিরাল নীরা।
হযরত আবু হুরায়রা ( রা) নবী কারীম ( সা) থেকে বর্ননা করেন, নবী কারীম ( সা) বলেছেন, স্বামী তার স্ত্রী কে বিছানাতে আহবান করলে স্ত্রী তার আহবানে সাড়া না দিলে ভোর পর্যন্ত ফেরেশতারা উক্ত স্ত্রীর উপর লানত করতে থাকে। ( বুখারি- ২/২৮২)।
.
হাদিসটায় কি বলল?
বুঝল না নীরা! আবার পড়ল। পরতেই লাগল।
কি বলেছে হাদিসটায়?
হযরত তালক ইবনে আলী ( রা) বলেন, নবি কারীম ( সা) বলেছেন, স্বামী – স্ত্রীকে আহবান করলে সঙ্গে সঙ্গে চলে আসতে হবে। যদিও স্ত্রী চুলার পাশে বসা থাকুক না কেন।( তিরমিযি, তারগীব ৩/৩৮)।
নীরা এবার বুঝেছে। হাদিসটা কিসের ইংগিত করেছে।
নীরা তো ঈশামকে সেই অধিকার দেয়ই নি। সেখানে যদি স্বামীর ডাকে স্ত্রী সাড়া না দেয় তাহলে ফেরেশতারা লানত করতে থাকে আর নীরা ঈশাম কে তাকে ছুতে পর্যন্ত দেয় নি। তাহলে কি ফেরেশতারা আমাকে লানত করেছে? আজ বিয়ের কত দিন হয়ে গেল। কখনো ঈশাম তাকে জোর করে নি। ওই যে বিয়ের প্রথম রাতে ঈশামকে নীরা বলেছিল পারমিশন ছাড়া নীরাকে যাতে স্পর্শ না করে।
কেন নীরা এ কথা বলতে গেল? একটা মেয়েকে কতটুকু ভালবাসলে কত শ্রদ্ধা করলে একটা ছেলে এত ধৈর্য্য ধরতে পারে?
নাহ! নীরা আর কিছু ভাবতে পারছে না।
যেখানে একজন স্বামী একটি স্ত্রীর ভরন পোষন করছে, ভালবাসা দিচ্ছে, শ্রদ্ধা করছে তার কি এতটুকু পাওয়ার অধিকার নেই?
কেনই বা আমি এরকম একটা কাজ করলাম?
.
নীরা খুব অস্থির হয়ে উঠল। নিজেকে অপরাধী ভাবল সে।
ঈশাম কি আমাকে ক্ষমা করবে? আর আল্লাহ?
নীরার চোখ দিয়ে যেন পানি গড়িয়ে পরতে চাইল।
কিন্তু নীরা সামাল দিয়ে শক্ত হয়ে বসে রইল। কিন্তু পরক্ষনেই আবার অস্থির হয়ে উঠল।
দু ফোটা চোখের পানি বইয়ের কাগজে গড়িয়ে পরল।
.
নাকের পানি টানার শব্দে ঈশামের ঘুম ভেঙে গেল। কে এরকম করে কানছে এত রাতে?
ঈশাম ভাল করে চোখ খুলে দেখে পাশে নীরা নাক টানছে, চোখে পানি।
ঈশাম ভয় পেয়ে জিজ্ঞাসা করল,
– নীরু! এই নীরু! কি হইছে?কানতেছ কেন? তোমার কি শরীর খারাপ?
এই বলে ঈশাম নীরার মাথায় হাত দিতে যাবে তখনি সাথে সাথে ঈশাম হাত নিচে নামিয়ে ফেলল।
– কি হইছে নীরু? তুমি কি সিক?
– নীরা কিছু বলে না।
ঈশাম নীরাকে স্বাভাবিক করার জন্য বলল,
– আরেহ ছিহ! ছোট বাচ্ছাদের মত কান্না করে! আবার দেখো নাক দিয়ে কি পরতেছে?
– নীরা হাত দিয়ে নাকের পানি মুছে ফেলল।
– এই দেখ আবার আসছে। ছিহ! এ্যা!
– আপনাকে তাকাতে বলছে কে?
– তা ওরকম করে কান্না করছ কেন?
– এমনি!
– বলা যাবে না?
– না।
– তাইলে প্লিজ নাকের পানি মুছো।
এই বলে ঈশাম টেবিলে থাকা টিস্যু দিয়ে নীরার নাক পরিষ্কার করে দিল।
– এবার বল।
ঈশাম লক্ষ করল নীরার কাছে বই। তাতে স্বামী স্ত্রীর হক, অধিকার সম্পকে লিখা আছে।
– তুমি কি বই পরে কান্না করছ?
– নীরা সায় দিল না।
ঈশাম নীরার হাত থেকে বইটা কেড়ে নিল।
পৃষ্ঠা উল্টিয়ে নীরা কে বলল,
– জানো নীরা! দুনিয়ায় যদি কোনো স্ত্রী তার স্বামী কে কষ্ট দেয় তাহলে বেহেশতের স্ত্রীরা দুনিয়ার স্ত্রীকে বদ দোঅা করে?
– নীরা চুপ।
– হযরত মুয়াজ ( রা) নবী পাক ( সা) হতে বর্ননা করেন যে, রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন, কোন স্ত্রী তার স্বামী কে দুনিয়াতে কষ্ট দিলে হুরেঈন স্ত্রীরা বলে, তাকে কষ্ট দিও না। আল্লাহ তোমার অমঙ্গল করুন, সে তোমার নিকট মাত্র কিছুদিন বাস করবে। অরিচেই তোমার কাছ থেকে পৃথক হয়ে আমাদের কাছে চলে আসবে। ( মিশকাত, তিরমিযি, ইবনে মাজাহ, মিরকাত ৬/৪২)।
– নীরু! তুমি কিন্ত আমাকে কষ্ট দিয়েছ!
– নীরা ঈশামের দিকে তাকাল।
– হুম সত্যিই! এই যে! রাতে একা একা কান্না করছ? আমার কোনো কাজে কষ্ট পেয়ে কান্না করছ নাকি অন্য কিছুতে তা আমি জানি না। কিন্তু ওই চোখ থেকে অশ্রু ঝড়াটা আমার পছন্দের না। বুকের বা পাশটায় ব্যাথা হয়।
– নীরা কি বলবে ঈশামকে?
– নীরু! এটা কি স্বামী কে কষ্ট দেওয়া না?
– হুম।
– তাহলে? ঘুমিয়ে যাও। না হলে শরীর খারাপ করবে।
– হুম।
নীরা শুয়ে পড়ল। ঈশাম ওদিকে ভাবছে- আমাকে কি তোমার মনের কথা কখনও জানতে দিবে না?
.
সকাল বেলা ঈশাম অফিসে চলে গেলে নীরা তার শাশুড়ির কাছে গেল। রান্না করতে ব্যস্ত উনি।
– কি নীরা? কিছু কি বলবে?
– জি মা।
– বল?
– আজ থেকে আমাকেও এই রান্নাঘরের ভাগ দিতে হবে মা!
– নীরার শাশুড়ি হাসতেছে। রান্নাবান্না পারো কি?
– শিখিয়ে দিবেন।
– তাতো দিবই। আমি অবসরে গেলে তোমাকেই। তো এই সংসার চালাতে হবে তাই না।
– হ্যা মা।
নীরা শাশুড়ির সাথে কাজে হাত দিল। নীরাকে অতি যত্নে শিখিয়ে দিচ্ছেন।
নীরার একটা ইচ্ছা হচ্ছে। নিজের হাতে ঈশামের জন্য রান্না করবে। কিন্তু নীরার যে রান্না! থাক আগে শিখি তারপর সুন্দর করে রান্না করে খাওয়াব।
.
নীরা ঈশামকে ভালবেসে ফেলেছে। খুব ভালবেসে ফেলেছে। প্রথম ভালাবাসার অনুভূতি কি রকম হয় তা নীরা বুঝতে পারছে। কিন্তু ঈশামকে বলবে কি ভাবে?
এভাবে বলবে – ঈশাম আমি তোমাকে ভালবাসি; না ভালবাসি বলা টা কেমন লাগছে হঠাত করে বলা যায় নাকি ভালবাসি? এভাবে বলতে হবে যে- আমি তোমাকে ভালবেসে ফেলেছি। হুম! না এভাবে বললে আবার কেমন দেখায়? উফফফফ! মেয়ে হয়ে আগে কিভাবে বলি – আমি তোমাকে ভালবাসি।
এই নাদান ঈশাম ও কিছু বলে না। আমি যে তার বউ তার তো অধিকার আছেই তো কি সে আমাকে বলতে পারে না? বোকা কোথাকার!!!!
নীরা ভাবছে ঈশামকে সে কিভাবে বুঝাবে যে নীরা ঈশামকে ভালবাসে। কোনো কিছুই যে তার মাথায় ঢুকছে না।
আচ্ছা? কাউকে ভালবাসলে বুঝি এমন হয়?
.
এর আগে কেন নীরা ঈশামকে বুঝে নি, কেন ঈশামকে এত দুরে রেখেছে? এসব যেন নীরার মাথায় ঘোরপাক খাচ্ছে । হঠাত দরজা নক করার শব্দ। নীরা দরজার দিকে ছুটে গেল। অবশ্য আজ পর্যন্ত নীরা কেউ আসলে দরজা খুলে নি। কিন্ত আজ যেন মনই মানতে চাইছে না । নীরার শাশুড়ি দরজার দিকে আসতেই দেখল নীরা দরজা খুলতে গেছে।
নীরা দরজা খুলে ঈশাম কে দেখল। ঈশাম ভাবছে নীরা দরজা খুলল?
– মা কোথায়?
– ঘরেই আছে। কেন মাই শুধু দরজা খুলতে পারে ঘরে কি আর কেউ নেই?
– না মানে ইয়ে কখনও খোলো নি তো। তাই……..
ঈশামের কথা শেষ হতে না হতে নীরা সুন্দর করে ঈশামের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে নিল।
ঈশাম ঘরে ঢুকার সাথে সাথে ঈশামের জুতা নীরা ঘরের ভিতর রেখে দিল।
আরেহ বাহ! ঈশাম তো পুরোই ভেবাচেকা খেয়ে গেল। এইটা কে? নীরু?
আমি কি স্বপ্ন দেখছি নাকি?
.
– কি ভাবছেন?
– ঘোর ফিরে ঈশামের উত্তর : না না কিছু না।
– নীরা এমন একটা হাসি দিল যেন এক মাতাল হাওয়া ঈশামের মাথাটাকেই ঘুড়িয়ে দিল।
.
– ফ্রেস হয়ে খেতে আসুন।
– আচ্ছা। ঈশাম নীরার দিকে তাকিয়ে আছে।
.
আজ নীরার এরূপ পরিবর্তন দেখে ঈশাম যেন কিছুতেই বিলিভ করতে পারছে না। নীরা দরজা থেকে রিসিভ করল, আ লত করে ব্যাগ নিল, এমনি আমার জুতা সে তুলে ঘরের ভিতর রাখল। এ কি নীরা? আমার বউ? আমার অর্ধাঙ্গিনী?
ঈশাম আজ মনে মনে এইটা ভাবছে না যে, নীরা ঈশামের প্রেমে পড়ে গেছে কিনা। কিন্তু আজ ঈশাম মনে মনে এইটাই বলছে,
” নীরু! তুমি সত্যিই আমার প্রেমে পরেছ।”
গল্প : #তোমায়_নিয়ে
পর্ব: ১৮
.
রাতের বেলা ঈশাম নীরা দুজন দুজনার বিপরীতে শুয়ে আছে।
গালের নিচে হাত রেখে নীরা জিজ্ঞাসা করল:
– আপনি আমাকে ভালবাসেন?
– ঈশাম কিছুটা থতমত খেয়ে গেল হঠাত এই প্রশ্নে। কি উত্তর দিবে সে….
– ভালবাসেন?
– ভালবাসার ডেফিনেশন নেই আমার কাছে। আর আমি ভালবাসি এটা ” হ্যা” বা ” না” এই শব্দ দ্বারা কখনই বুঝানো যাবে না।
– আপনার আধ্যাত্মিক কথা শুনতে চাই নি। সহজ করে প্রশ্ন করেছি সহজ করে উত্তর দিবেন।
– যদি আমি বলি অনেক ভালবাসি আমি তোমাকে, তাহলে বলেই কি হবে আর তুমি শুনেই কি করবে?
– অনেক কিছু।
– তাই বুঝি?
– আচ্ছা বলতে হবে না। বুঝে গেছি।
– কি বুঝেছ?
– ভালবাসা টু দি পাওয়ার ইনফিনিটি। আপনার থিওরি এটাই বলে।
– ঈশাম নীরার কথায় মুচকি একটা হাসি দিল। বলল: সবই তো জান। তাহলে জিজ্ঞাসা করলে কেন?
– এমনিতেই। ঘুমান।
– ঈশাম নীরার দিকে তাকাল।
নীরার চোখ ঈশামের দিকে পরতেই চোখ সরিয়ে নিল। তাকিয়ে থাকার সাহস নেই নীরার।
.
নীরা জানালার দিকে তাকিয়ে রাতের আকাশ দেখছে। চাদের অালো যেন তার মুখে মুক্তার দানার মত আছড়ে পরছে। কি সুন্দর রাতের আকাশ! ঝিকিমিকি করছে ওই দুরের তারা গুলো। কত ছোট ওগুলো? আসলেই কি ছোট? না। মূলত সূর্যের থেকেও বড় একেকটা। কি সুভ্র রাতের আকাশ! দেখেই যেন মনে হয় ওখান থেকে ঘুরে আসি।
চাদের বুড়ির কথা ছোটবেলায় শুনেছি। আসলেই কি ওই চাদে বুড়ি সুতো কাটে? যদি কাটত তাহলে গেলে হয়ত দেখা পেয়ে যেত নীরা!
কি ভাবছে নীরা অদ্ভুত তো? চাদে কি বুড়ি থাকে? ছোট বাচ্চাদের মত ভাবনা! নীরা মনে মনে হাসতেছিল!
ঈশাম! তুমি ভালবাসার ডেফিনেশন এর জন্য আমার প্রতি যে তোমার ভালবাসা তা বলতে পার নি। কিন্তু আমি জানি! তোমার ভালবাসার কোনো সীমা নেই। অসীম। বাউন্ডারি দিয়ে তোমার ভালবাসা যাচাই করার সাহস আমার নেই।
সেই রবের কাছে আমার চির কৃতজ্ঞতা! যিনি আমাকে তোমার জীবনসংগিনী হিসেবে দিয়েছেন।
আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ!
আমি আমার রবের প্রতি সন্তুষ্ট।
.
আচ্ছা! এত সুন্দর জোসনার রাত! জোসনা বিলাস করলে কেমন হয়? চাদের অালো গায়ে মেখে নিজের সুখ দুখের কথা বললে মন্দ হয় না মোটেও। জোসনার অালোয় স্নান হয়ে যাক কিছুক্ষন।
নীরার খুব মনে চাইল সে ঈশামকে নিয়ে জোসনা বিলাস করবে। ঈশামের ঘাড়ে মাথা রেখে দুজন দুজনার গল্প বলবে। নীরা ঈশামের হাতে হাত রেখে গল্প বলবে, যার কোনো শেষ হবে না। চলতে থাকবে ” হাজার বছর ধরে”……..
নীরা যেন কল্পনার রাজ্যে চলে গেল ঈশামকে নিয়ে। আসলেই কি একটা মেয়ে চায় এমন? জানি না কে কিরকম চায়। কিন্তু আমার তো এমনি চাইতে ইচ্ছে করে।
নীরার এই ভাললাগার মুহূর্তটা ঈশামের সাথে ভাগবাটোয়ারা করতে চায়। নীরা জানালার দিক হতে পাশ ফিরে ঈশামের দিকে তাকাতেই দেখল-
ঈশাম ঘুমে বেহুঁশ।
.
ঈশামের ঘুম দেখে নীরার সব ইচ্ছাই যেন ধূলিসাৎ হয়ে গেল। সব আশাই যেন ভেঙে চুরে চুরমার হয়ে গেল। মনে মনে নীরা রেগেমেগে বলল:
– এই ছেলে! এই!!! একটু না ঘুমালে কি হয় শুনি? কি সুন্দর নাক ডেকে ঘুমাচ্ছে! মনে হয় নাকটা চেপে ধরি!
এত সুন্দর রোমানটিক একটা মুডে ছিলাম! দিল তো নস্যাৎ করে!
পরেক্ষনেই নীরা বলল
ওর কি দোষ? আমিই তো বলছিলাম ঘুমাতে। বাধ্য ছেলে হয় এরকম বাধ্য ছেলে তাই বলে? উফফফ!!!
এই ছেলে!!!!
নীরা এপাশ ওপাশ করতে করতে ঘুমিয়ে গেল।
ঘুম ভাঙলো ফজরের নামাজের আযানে।
নীরা দেখল এখনও ঈশাম ঘুমে ।
গ্লাস থেকে পানি হাতে নিয়ে নীরা ঈশামের মুখে ঝাটকা মারল।
ঈশাম অপ্রস্তুত হয়ে উঠে বসল।
– কি হয়েছে নীরা?
নীরা দাত বের করে হাসতেছে।
– ঘুম শেষ আপনার?
– হঠাত পানির ঝাটকা মারলা কেন?
– বারে আপনি মারতে পারলে আমি পারব না?
– তা তো পারবে।
– জি হা! ইংশা আল্লাহ এখন থেকে এভাবেই জেগে তুলব।
– আগে তো এমন কর নি তাই বললাম আর কি।
– আগে করি নি মানে? আমার সাথে কি আপনার ৩০/৪০ বছর আগে বিয়ে হইছে যে বললেন আগে করি নি।
– আচ্ছা আচ্ছা ভুল হয়ে গেছে ।
– ইট’স ওকে।
– সরিই তো বলি নি ।
এবার নীরা রেগে যাচ্ছে।
ঈশাম বলল,
– সরি নীরু!
-ইট’স ওকে।
– আমি ফজরের নামাজ পরব ইংশা আল্লাহ। আপনি মসজিদে যান।
নীরার মুখে এ কথা শুনে ঈশামের শুধু এটিই মাথায় আসছে,
” আল্লাহ যাকে ইচ্ছে করেন তাকে সরল পথের দিকে পরিচালিত করেন। ” ( বাকারাহ- ২১৩)।
ঈশাম জোরে করে বলে উঠল,
– আলহামদুলিল্লাহ!
ঈশামের অনেক ইচ্ছে করছে নীরার কপালে একটা চুমু একে দিতে। কিন্তু নীরার পারমিশন নেই। আর ঈশামও ধৈর্য্য ধারন করছে। কারন নীরার কাছে সে শুধু স্বামীই নয় সে প্রিয় বন্ধু হতে চায়। স্বামী হিসেবে সব আদায় করাই যায় কিন্তু আমি নীরার কাছে উত্তম স্বামী এবং বন্ধু হতে চাই।
– ওকে ওকে! আমি মসজিদে যাচ্ছি। জাযাকিল্লাহ খইরন। আমাকে ডেকে দেওয়ার জন্য। অনেক সময় আমি উঠতে পারি না মসজিদে যাওয়ার জন্য।
– এখন থেকে আর দেরি হবে না। আমিই জেগে দিব। ইনশাআল্লাহ।
– ঈশাম হাসি দিয়ে বলল : তুমি আমাকে পানির ঝাটকাই বা মারলে কেন?
নীরা বলতে লাগল,
” হযরত আবু হুরায়রা ( রা) হতে বর্ণিত, নবী পাক ( সা) বলেছেন, যে মহিলা রাত জেগে নামাজ আদায় করে এবং স্বামী কে নামাজ আদায় করতে জাগিয়ে দেয় সে যদি না জাগে তাহলে মুখে পানির ঝাটকা মারে। এ ধরনের মহিলাদের প্রতি আল্লাহর রহম। ( আবু দাঊদ- ১/১৮৫)।
– তুমি জানলে কিভাবে?
– বইয়ে পরেছি।
– কিন্ত এই হাদিসে কিন্ত তাহাজ্জুদ আদায়কারী মহিলার কথা বলা হয়েছে।
– দেখুন আমি অতো জানি না। যা জেনেছি তাই…..
– সেটাই এপ্লাই করেছ, তাই না?
– হুম।
– মাশা আল্লাহ। এরপর থেকে তাহাজ্জুদে ডেকে দিবা। আল্লাহ তোমাকে দ্বীনের পথে কবুল করুন। আমীন।
– নীরা ঈশামের দিকে তাকিয়ে আবার চোখ সরিয়ে নিল।
– যান এবার।
– ওকে!!!! ম্যাডাম!
.
ঈশাম ফজরের নামাজ আদায় করতে মসজিদে চলে গেল। এদিকে নীরা ফজরের নামাজে দাড়িয়ে গেল।
এত শান্তি? ফজরের নামাজে? আগে জানা ছিল না নীরার!
আল্লাহর কাছে দোয়া করতে করতে কখন যে নীরার চোখে পানি এল তা নীরা বুঝতে পারল না।
না! এ অশ্রু আল্লাহর কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশের। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার ফয়সালার উপর সন্তুষ্টির। আগে নীরা তার রবকে চিনতে পারে নি। কিন্তু এখন আল্লাহ নীরাকে চিনিয়ে দিয়েছে যে, হে আমার বান্দি! আমি তোমার সৃষ্টিকর্তা! আমাকে চিনে নাও! আমিই তোমার অভিভাবক! আর আমিই তোমার জন্য যথেষ্ট!
.
ঈশাম সকাল বেলা অফিসে চলে গেছে।
আজ নীরাই ঈশামের অফিসে যাওয়ার জন্য সব রেডি করে দিয়েছে। ব্যাগ গুছিয়ে দেওয়া থেকে বাইরে জুতা রাখা পর্যন্ত সব করেছে।
নীরা একের পর এক কাজ করে দিচ্ছে আর ঈশাম খালি টাস্কিই খেয়ে যাচ্ছে। ঈশাম নীরার এমন চেঞ্জ কখনো কল্পনাতেও আনে নি। টাস্কি খেতে খেতেই ঈশাম অফিসের পথে রওনা হয়েছে।
.
নীরা রান্না ঘরে গিয়ে শাশুড়ি কে বলল,
– মা আজ আমি রান্না করি?
– পারবে তো?
– বলে দিয়েন একটু?
– শাশুড়ি হাসতে হাসতে বলল, কেন না?
নীরা আজ নিজের হাতে ঈশামের জন্য খাবার বানাবে। নীরার খুশি যেন ধরছেই না। কিন্ত এই খুশি মুহূর্তের মধ্যে বিলিন হয়ে যায় যখন তার মনে হয় তার তো রান্নার হাত ভাল না। কি যে হবে আজকে আল্লাহ জানে।
অনেক কষ্ট করে নীরা রান্না করল।
শশুড় এসে বলে,
– আজ নীরা মা রান্না করছে নাকি?
– জি বাবা! যেমনই হোক খেতে হবে কিন্ত?
– অবশ্যই অবশ্যই। বউমার হাতের রান্না বলে কথা!
.
– মা?
– কি নীরা?
– আমি একটা জিনিস পারি না। আমাকে একটু সাহায্য করবেন?
– কি কাজ?
– আমাকে আজ শাড়ি পরিয়ে দিবেন?
– নীরার কথা শুনে শাশুড়িই যেন বেশি লজ্জা পেলেন। আচ্ছা ঠিক আছে। আমাকে ডাক দিও। আমি পরিয়ে দিব।
– আচ্ছা মা!
নীরা খুব খুশি মনে চলে গেল।
.
সন্ধা বেলা নীরা তার শাশুড়ির কাছ থেকে শাড়ি পরে নিল। ওইযে বিয়ের দিনে যে শাড়িটা পরেছিল সেটা।
– কি নীরা? ঠিক হয়েছে পরা?
– জি মা?
শাশুড়ি হাসতে হাসতে রুম থেকে চলে গেল।
.
নীরার শশুড় শাশুড়ি রাত ৮ টার মধ্যে খানাপিনা শেষ করে খুব দ্রুতই শুয়ে পরে। আজও তার ব্যতিক্রম হল না । নীরার শশুড় শাশুড়ি খেয়ে দেয়ে শুয়ে পরল।
এদিকে ঈশাম এখনো কেন আসতেছে না অনেক দেরি হয়ে গেছে, নীরার কপালে চিন্তার রেখা ফুটে উঠল।
সে আজ নিজে রান্না করেছে ঈশামকে খাওয়াবে বলে, আজ ঈশামের জন্য সারপ্রাইজ আছে, কিন্তু এই ছেলেটা কেন আসছে না। আজ এতই বা কাজ কিসের? আজই দেরি করতে হল?
নীরা ঈশামকে ফোন দিয়ে বসল,
– আসসালামু আলাইকুম।
– ও আলাইকুমুসসালাম। নীরা?
– জি হা! আপনার বিয়ে করা বউ। এত দেরি হচ্ছে কেন আসতে আপনার?
নীরার কথা শুনে মনে হচ্ছে সে আসলেই পাক্কা গৃহিণী হয়ে গেছে , আহা! কি শাসন! এরকম শাসনই তো ঈশাম চেয়েছিল। তা আজ পূরন হয়ে গেল।
– হ্যালো!
– হ্যা বল নীরু?
– আপনিই বলেন এত দেরি হচ্ছে কেন?
– আজ একটু কাজ ছিল।আমি বের হয়েছি অফিস থেকে। এই তো জ্যামে পরেছি।
– ও আচ্ছা। তাড়াতাড়ি আসুন।
– আচ্ছা।
.
নীরা ঈশামকে ফোন দিয়ে জিজ্ঞাসা করছে দেরি হচ্ছে কেন? ঈশাম কি সত্যিই এটা শুনেছে?
নীরা আমাকে সালাম দিল? আর শাসনের সুরে বলছে এত দেরি কেন?
ঈশামের তো আর মন মানে না। পারলে জ্যাম ঠেলে গাড়ির উপর দিয়ে দৌড়ে যায়, নাহলে প্যারাসুট নিয়ে উড়ে চলে যায় নীরুর কাছে।
আমার তাড়াতাড়ি বা দেরি হওয়া যার কাছে কোনো ব্যাপার ছিল না আজ সে কিনা আমাকে বাসায় তাড়াতাড়ি ফিরতে বলছে। ঈশামের দিলে তো মনে হয় কয়েকটা লাড্ডু ব্রাস্ট হইছে এতক্ষনে।
.
ঈশাম ভাবছে এই ব্যস্ত শহরের মানুষ কি জানে, এই জ্যামে পরা মানুষ কি বুঝতে পেরেছে, এই লোকাল বাসে বসে থাকা মানুষ গুলো কি জানে ঈশামের মনে এত আনন্দ কেন?
কেউ জানে না।
শুধু জানে একজন।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা। যিনি অন্তর্যামী।
.
রাস্তা যেন আজ ফুরোতেই চাচ্ছে না। এত তাড়াতাড়ি করছে বাসায় ফিরার জন্য আর রাস্তা যেন পিছেই যাচ্ছে।
বাস থেকে নেমে ফুটপাতের দোকান থেকে বেলি ফুলের মালা কিনল ঈশাম।
এরপর দ্রুত পদে বাসায় পৌছাতে লাগল।
বাসায় এসে দরজা নক করতেই দরজা খুলে ঈশামের চোখ তো ছানাবড়া…………………
.
( চলবে ইনশাআল্লাহ)
গল্প : তোমায় নিয়ে
পর্ব: (১৯+২০)
.
নীরা দরজা খুলে দাড়িয়ে আছে। লাল বেনারসি যে শাড়ি পরে নীরা ঈশামের ঘরে প্রথম পা দিয়েছিল। চোখে কাজল, ঠোটে লিপস্টিক, হাত ভর্তি চুরি। নীরা আজ এত সুন্দর করে সেজেছে যে ঈশাম মুগ্ধ নয়নে অপলক দৃষ্টিতে ঢ্যাবঢ্যাব করে চেয়ে আছে।
– আসসালামু আলাইকুম।
– ও আলাইকুমুসসালাম। বাইরেই থাকবা নাকি ঘরে আসবে?
– ও আচ্ছা!
নীরা ঈশামের হাত থেকে ব্যাগ নিয়ে জুতা ঘরে তুলল।
ঈশাম বুঝতেছে না ব্যাপারটা কি। জিজ্ঞাসাও করতে পারছে না কেন এত সুন্দর করে সেজেছ।
সে যাই হোক! বউ সুন্দর করে সেজে থাকলে পরিপাটি হয়ে থাকলে, ঘরে ফিরেই সকল ক্লান্তি দূর হয়ে যায়।
– ফ্রেস হয়ে নামাজ পরে আস আমি খাবার দিচ্ছি।
– আমি নামাজ মসজিদ থেকে পরে এসেছি।
– তাহলে তাড়াতাড়ি ফ্রেস হয়ে আস। আমি তোমার জন্য ভাত বাড়ছি। তাড়াতাড়িই আসবা নাইলে কিন্ত ঠান্ডা হয়ে যাবে ।
নীরার কথা শুনে ঈশাম ঘরে গেল। গিয়ে দেখল আজ বিছানায় নতুন চাদর এবং খুব সুন্দর করে সাজিয়েছে নীরা। কিন্ত ঈশাম তো পুরোই কনফিউজড। বউ বেনারসি পড়া, বিছানা সাজানো, কিন্তু বিয়ে তো করছি কয়েক মাস হইল। ঈশাম মনে মনে বলল,
মে বি সামথিং, সামথিং!!!
.
ঈশাম গোসল সেরে মাথা মুছতে মুছতে খাবার খেতে আসল। ঈশাম দেখছে আজ তরকারি কেমন যেন অন্যরকম লাগছে, তরকারির ঘ্রান অন্যরকম, আর দেখতেও আগের মত লাগছে না। ঈশাম ভাবছে নীরার রান্না হবে এইটা।
নীরা খুব যত্ন করে বাড়ছে। আর ঈশাম ভ্যালভ্যাল করে নীরার দিকে তাকিয়ে আছে মনে হচ্ছে জীবনেও দেখে নি বউকে। আসলেই তো এমন নীরাকে তো ঈশাম আগে কখনো দেখেই নি।
দুজনই ভাত নিল।
ঈশাম বিসমিল্লাহ্ বলে এক লোকমা মুখে দিতে যাবে আর তখনি নীরা তার হাতটা ঈশামের দিকে বাড়িয়ে দিয়েছে।
– প্রথম লোকমাটা আমার কাছ থেকে নাও।
.
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা স্বামী স্ত্রীর মাঝে এত মহব্বত, এত প্রেম, এত ভালবাসা দিয়েছে যা আর অন্য কোনো সম্পকে পাওয়া যাবে না। দুজন অপরিচিত মানুষ যারা বিয়ের আগ পর্যন্ত জানতও না যে, তারা একই ছাদের নিচে একই বিছানায় সারাটা জীবন কাটাবে। একে অপরের সুখ দুখের সাথী হবে । আল্লাহ তা’য়ালার নির্দেশে তারা এক হয়। কি সুন্দর একটা পবিত্র বন্ধন আল্লাহর তরফ থেকে।
.
ঈশাম দেরি না করেই নীরার হাত থেকে লোকমা খেল।
– নীরু? আমার কাছ থেকে নেবে না?
নীরা একটা মুচকি হাসি দিয়ে ইয়া বড় একটা হা করল।
খাওয়ার মাঝখানে ঈশাম বলল,
– আজকে আমার বউ রান্না করেছে?
নীরা খুব উতফুল্ল ভাবে বলল,
– হুম! হুম! আমি আমি। আমি রান্না করছি। কেমন হইছে? বলো বলো?
ঈশাম এতক্ষনে শুনতে পেল নীরা তাকে আপনি থেকে তুমি তুমি বলে সম্বোধন করছে।
– মাশা আল্লাহ। আরও ট্রাই করতে হবে।
– সত্য কথা বলার জন্য শুকরিয়া জনাব। আমিও জানি অত ভাল হয় নি।
– কিন্তু আমি তো এটা বলি নি যে, তেমন ভাল হয় নি।
– জি বুঝেছি, সেটাই বলছি, মাশা আল্লাহ বলেছ যাতে আমার রান্না আরও ভাল হয়।
– ঈশাম বলল, হুম।
.
খাওয়ার পর ঈশাম হাত ধুয়ে বসে আছে, নীরা ছোট একটা কাগজ ঈশামের হাতে গুজে দিয়ে প্লেট গুলা রান্না রুমে ধুতে নিয়ে গেল।
ঈশাম কাগজে কি লিখা আছে তা পরতে কাগজের ভাজ খুলে ফেলল। তাতে লিখা-
” আজ থেকে আর তোমাকে অপেক্ষা করতে হবে না। তুমি আমার কাছে আসতে পার। আমাকে ক্ষমা করে দিও এত দিন তোমাকে আমার কাছ থেকে দূরে সরিয়ে রাখার জন্য। আজ আমাদের জন্য স্পেশাল নাইট। আর একটা কথা ” আই লাভ ইউ সোনা বর- ইতি তোমার সোনা বউ নীরু”।।।।।।।।।
.
ঈশাম নীরার জন্য অপেক্ষা করছে। হাতের কাজ সেরেই আসবে সে। নীরার দেরি হচ্ছে দেখে ঈশাম কিচ্ছুক্ষণ বই পড়া যাক এজন্য টেবিলের কাছে গিয়ে বই নিতেই নীরা পিছন থেকে এসে ঈশামকে জড়িয়ে ধরল।
নীরা খুব শক্ত করে আকড়ে ধরে আছে।
কিছুক্ষন পর নীরার চোখের পানি ঈশামের সাদা শার্টে লাগতেই ঈশাম বুঝতে পারল নীরা কান্না করছে। নীরার চোখের পানিতে তার চোখের কাজল লেপ্টে গেছে।
ঈশাম নীরাকে ছাড়িয়ে নিয়ে সামনা সামনি জিজ্ঞাসা করল,
নীরু! কান্না করছ কেন? এই নীরু?
নীরু এক নি: শাসে বলল,
আমি জীবনে অনেক গোনাহ করেছি, আল্লাহ কি আমার গোনাহ মাফ করবে?
আমি আল্লাহর অনেক অবাধ্য হয়েছি, আল্লাহ কি আমাকে মাফ করবে বল?
আমি অনেক নাফরমানি করেছি জীবনে, আল্লাহ কি আমার তাওবা কবুল করবেন?
আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, তুমি আমার স্বামী হিসেবেও আমি তোমাকে স্বামীর অধিকার থেকে এত দিন বঞ্চিত করে রেখেছি, আল্লাহ কি ক্ষমা আমাকে করবেন?
তুমি কি আমাকে ক্ষমা করবে?
আমি তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি, কথায় এবং কাজে, প্লিজ আমার উপর অসন্তুষ্ট হইও না। আমি মারা গেলে আল্লাহও আমাকে ক্ষমা করবেন না।
এই জীবনে এতই গোনাহ করেছি যে আমি বুঝতে পারছি না আল্লাহ আমাকে কিভাবে ক্ষমা করবেন?
আমি পাগল হয়ে যাব! এত গোনাহ নিয়ে আমি আল্লাহর নিকট দাড়াব কিভাবে?
.
এক নাগারে নীরা কথা গুলো বলে ফেলল ঈশামকে। ঈশাম বুঝতে পেরেছে নীরা তার কৃতকর্মের জন্য অনুতপ্ত। এদিকে নীরার কান্নার তার চোখের কাজল ছ্যারাবেড়া অবস্থা। ঈশাম নীরাকে শান’ত করার জন্য নীরাকে বিছানায় বসিয়ে দিল।
টিস্যু নিয়ে এসে আস্তে আস্তে করে নীরার কাজল ঠিক করে দিল।
– নীরু! তোমার খোপায় কি যেন মিসিং!
– নীরা তার খোপায় হাত দিল।
ঈশাম অফিস থেকে ফিরার পথে যে বেলি ফুলের মালা কিনেছিল তা বের করে নীরার খোপায় গুজে দিল।
– এইবার পারফেক্ট!
কিন্তু নীরার চোখ দিয়ে যেন শ্রাবনের অশ্রু কিছুতেই থামছে না। নাকের পানি চোখের পানি মিশে একাকার। ঈশাম বলল,
– আরেহ ছিহ!!! আজকেও? নাক দিয়ে কি পরতেছে!!!
– নীরা হাত দিয়ে নাকের পানি মুছে ফেলল।
– নীরু! তুমি এত গেদুর কেন? হাত দিয়ে যে মুছলা দেখ তো হাতে লাগছে না?
নীরা এইবার কান্না থামিয়ে ঈশামের দিকে চোখ রাঙালো।
ঈশাম টিস্যু দিয়ে সুন্দর করে চোখের পানি নাকের পানি মুছে দিল।
আচ্ছা কোনো স্বামী কি এই কাজ করে? ( হাউ রোমানটিক)
ঈশাম দুই হাত দিয়ে নীরার চোখ মুছে দিল।
– নীরু!
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা বলেছেন-
” নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কারী ও অপবিত্রতা থেকে যারা বেচে থাকে তাদেরকে পছন্দ করেন। ” ( বাকারাহ- ২২২)।
তুমি কি আল্লাহর কাছে তওবা করেছ?
– নীরার উত্তর : হুম।
– আলহামদুলিল্লাহ।
– তোমার প্রশ্ন হল এত দিন আল্লাহর অবাধ্য হয়েছ আল্লাহর নাফরমানি করেছ, আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন কিনা? আল্লাহ তোমার তাওবা কবুল করবেন কিনা? তাহলে শুনো আল্লাহ কি বলেন,
” অবশ্যই আল্লাহ তাদের তওবা কবুল করবেন, যারা ভুলবশত মন্দ কাজ করে, অত:পর অনতিবিলম্বে তওবা করে, এরাই হল সেসব লোক যাদেরকে আল্লাহ ক্ষমা করে দেবেন। আল্লাহ মহাজ্ঞানী, রহস্যবিদ। ( সূরা আন নিসা- ১৭)।
.
আল্লাহর কাছে তাওবা করার কথা আল্লাহ নিজেই বলেছেন, এবং তাওবা করার পর আল্লাহ তাকে যে ক্ষমা করবেন সেটিও আল্লাহ বলেছেন-
” তারা আল্লাহর কাছে তওবা করে না কেন, এবং ক্ষমা প্রার্থনা করে না কেন? আল্লাহ যে ক্ষমাশীল, দয়ালু। ( মায়িদা- ৭৪)।
.
তওবা সম্পকে আল্লাহ আরো বলেন,
” যে গোনাহ করে কিংবা নিজের অনিষ্ট করে, অতপর আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনা করে, সে আল্লাহকে ক্ষমাশীল, করুনাময় পায়। ” ( আন নিসা- ১১০)।
” আর যারা মন্দ কাজ করে, তারপর তওবা করে নেয় এবং ঈমান নিয়ে আসে, তবে নিশ্চয়ই তোমার পরওয়ারদেগার তওবার পর অবশ্য ক্ষমাকারী করুনাময়। ( আল আরাফ- ১৫৩)।
” আমি বলছি তোমরা নিজেদের প্রতিপালকের কাছে ক্ষমা চাও। নি: সন্দেহে তিনি অতিশয় ক্ষমাশীল। ( নূহ- ১০)।
.
– নীরু! তোমার প্রশ্ন আল্লাহ তোমাকে ক্ষমা করবেন কিনা তার উত্তর তুমি পেয়েছ, কিন্তু আল্লাহ আরো সুসংবাদ দিয়েছেন এই তওবা কারীদের জন্য।
– নীরু বলল: কি?
– তাহলে শুনো,
” যারা আল্লাহর সাথে অন্য উপাস্যের এবাদত করে না, আল্লাহ যার হত্যা অবৈধ করেছেন, সংগত কারন ব্যাতিত তাকে হত্যা করে না, এবং ব্যভিচার করে না। যারা একাজ করে, তারা শাস্তির সম্মুখিন হবে।
কেয়ামতের দিন তাদের শাস্তি দ্বীগুন হবে এবং তথায় লাঞ্চিত অবস্থায় চিরকাল বসবাস করবে।
কিন্তু যারা তওবা করে বিশাস স্থাপন করে এবং সতকর্ম করে, আল্লাহ তাদের গোনাহকে পূন্য দ্বারা পরিবর্তিত করে দেবেন। আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু।
যে তওবা করে সতকর্ম করে, সে ফিরে আসার স্থান আল্লাহর দিকে ফিরে আসে। ( সূরা ফুরকান- ৬৮-৭০)।
– নীরু কিছু বুঝতে পেরেছ?
– জি।
– মানে যারা তওবা করে আল্লাহ তো তাদের ক্ষমা করবেনই সাথে সাথে তাদের যে গোনাহ ছিল তা পূন্যে পরিবর্তিত করে দিবেন।
– নীরা বলে উঠল: সুবহানাল্লাহ!
– কি খুশি তো?
– আলহামদুলিল্লাহ।
.
– রাসূলুল্লাহ ( সা) কি বলেছেন জান?
– কি?
– রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন, আল্লাহ বলেন, আর যে ব্যক্তি প্রায় পৃথিবী সমান পাপ করে আমার সঙ্গে সাক্ষাৎ করবে, অথচ সে আমার সাথে শিরক করে নি, তার সাথে আমি তত পরিমানই ক্ষমা নিয়ে সাক্ষাৎ করব। ( মুসলিম- ৭০০৯)।
তার মানে এখানে কি বলা হয়েছে বল তো?
– আল্লাহর সাথে শিরক কিরা যাবে না।
– ঠিক তাই। আল্লাহর সাথে শিরক না করলে অবশ্যই আল্লাহ আমাদের ক্ষমা করবেন। তুমি কি জান? তওবাকারী ব্যক্তি তওবার পর কিরকম হয়?
– নাতো।
– বলছি, হযরত ইবাদা বিন আবদুল্লাহ তার পিতা থেকে বর্ননা করেন, রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন- গোনাহ থেকে তওবা কারী গোনাহ করে নাই ব্যক্তির মত হয়ে যায়। ( ইবনে মাজাহ- ৪২৫০)।
– আরও সুসংবাদ হল, আল্লাহর ভয়ে যে কাদে জাহান্নামের আগুন তার জন্য হারাম।
– কিভাবে?
– রাসুল ( সা) বলেছেন- যে ব্যক্তি আল্লাহর ভয়ে ক্রন্দন করে সে ব্যক্তি কে ( জাহান্নামের) অগ্নি স্পর্শ করা সম্ভব নয় যদিও দোহনকৃত দুধ উলানে ফেরানো সম্ভব হয়। আর জাহান্নামের ধোয়া এবং আল্লাহর পথে ( চলার কারনে) উড়ন্ত ধূলি কখনও একসাথে হতে পারে না। ( নাসায়ী- ৩১০৮)।
.
– নীরু! তুমি কার কাছে গোনাহের জন্য ক্ষমা চাইবে?
– আল্লাহর কাছে।
– আল্লাহ ছাড়া আর কেউ আছে যে বান্দার গোনাহ ক্ষমা করবে?
– নাহ।
– তাই আল্লাহ বলেন-
” তারা কখনও কোনো অশ্লীল কাজ করে ফেললে কিংবা কোনো মন্দ কাজে জড়িত হয়ে নিজের উপর জুলুম করে ফেললে আল্লাহকে স্মরন করে এবং নিজের পাপের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করে। আল্লাহ ছাড়া আর কে পাপ ক্ষমা করবেন? তারা নিজের কৃতকর্মের জন্য হঠকারিতা প্রদর্শন করে না। এবং জেনে শুনে তাই করতে থাকে। ( আলে ইমরান- ১৩৫)।
– জি বুঝেছি।
– কখনও নিরাশ হবে না আল্লাহর রহমত থেকে।
” বলুন! হে আমার বান্দাগন! যারা নিজেদের উপর জুলুম করেছ তোমরা আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ হয়ো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ সমস্ত গোনাহ মাফ করেন। তিনি ক্ষমাশীল পরম দয়ালু। ( আয যুমার- ৫৩)।
.
– আচ্ছা আমাকে একটা প্রশ্নের উত্তর দাও।
– বল।
– মনে কর তোমার সন্তান হারিয়ে গেল তাহলে কেমন লাগবে তোমার?
– খুব কষ্ট পাব।
– আর যদি সেই সন্তান কে তুমি ফিরে পাও তাহলে কেমন লাগবে?
– দুনিয়ার সবচেয়ে বেশি খুশি হব।
– হুম! ঠিক তেমনি আল্লাহ ও তার বান্দার সাথে তওবার সম্পক।
” রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন- আল্লাহ তার বান্দার তওবা করার কারনে এর চেয়ে আনন্দিত হন, কোন লোক বন জঙ্গলে তার উট হারিয়ে ফেলার পর আবার তা ফিরে পেলে যেরূপ আনন্দিত হন। ( বুখারি- ৫৮৭০)।
আল্লাহ কিন্তু এর চেয়েও খুশি হন যখম তার বান্দা বান্দি আল্লাহর নিকট তওবা করে। বুঝলা?
– হুম।
.
– নীরু! তওবা সহিহ হওয়ার জন্য ৩ টি শর্ত মানতে হবে। তুমি কি রাজি?
– ইনশাআল্লাহ।
– ১) গোনাহ করে ফেললে সাথে সাথে গোনাহের কাজটি ছেড়ে দিতে হবে। আজ থেকে করবে তো?
– জি ইংশা আল্লাহ।
– ২) ভবিষতে এই গোনাহটি না করার দৃঢ় সংকল্প করতে হবে।
৩) গোনাহের জন্য অনুতপ্ত হয়ে আল্লাহর কাছে ক্ষমা চাইতে হবে।
– ইংশা আল্লাহ। আমি তাই করার চেষ্টা করব।
– মাশা আল্লাহ। শুনে খুব খুশি হলাম। তুমি খুশি তো?
– আলহামদুলিল্লাহ।
– ঈশাম?
– হুম বল?
– তুমি আমাকে ক্ষমা করেছ তো? আমার প্রতি সন্তুষ্ট হয়ে যাও প্লিজ!
ঈশাম দুই হাত দিয়ে নীরার মাথা ধরে কপালে আ লত করে একটি চুমু একে দিল।
– কি নীরু? আরও কিছু? উত্তর পেয়েছ?
– নীরা লজ্জায় মাথা নীচু করে বলল : হুম।
.
কিছুক্ষন দুজনই চুপ ছিল।
ঈশাম আর ধৈর্য্য রাখতে না পেরে নীরাকে বলে ফেলল,
” নীরু! কিছুক্ষন পর তো ফজরেরই আযান দিবে! “
নীরা ঈশামের কথা শুনে হাত মুষ্ঠি করে ঈশামকে কয়েকটা কিল ঘুষি দিতে লাগল।
.
( চলবে ইনশাআল্লাহ)
গল্প : #তোমায়_নিয়ে
পর্ব: ২০
.
সকালে ঈশামের জন্য নীরা চা বানাল। সেই বিখ্যাত চা। যেই চা খেয়ে নীরার বাবা বলেছিল- এইভাবেই কি স্বামীর জন্য চা বানাবে কিনা।
কি জানি! নীরার চা বানানো কেন ভাল হয় না। তা হোক গা! যা মন চায় তাই! বানিয়েই ফেলি। ভাল না হলে ঢকঢক করে গিলে ফেলব।
নীরা অতি যত্ন সহকারে চা বানিয়ে ঈশামের নিকট দিল।
আজ শুক্রবার। ছুটির দিন। তাই সকাল ঈশাম বই পড়ায় ব্যস্ত।
– এই যে ধরেন!
বই থেকে মুখ উচিয়ে দেখল নীরা চা নিয়ে দাড়িয়ে আছে।
আহা! কি সুন্দর জীবন আলহামদুলিল্লাহ! বউ চা নিয়ে দাড়িয়ে আছে, এমন দৃশ্য দেখার জন্য কত ছেলেই না জানি প্রহর গুনে। আজ পালা ঈশামের।
– জাযাকিল্লাহ খইরন! জাযাকিল্লাহ খইরন! এই বলে নীরার হাত থেকে চা নিল ঈশাম।
প্রথম চুমুক মুখে দিয়েই ঈশাম যেন কোথায় হারিয়ে গেল।
– এই যে! কি হইছে?
– না মানে! ভাল হইছে চা।
– আমি কি এইটা জিজ্ঞাসা করেছি কেমন হইছে চা।
– তা?
– চা কেমন হইছে তা আমি জানি।
– আচ্ছা? তুমি নিজে বানিয়েছ তুমি নিজেই জান? তা বেশ ভাল! তুমিই বল কেমন হয়েছে?
– তোমার চাহনি দেখেই বুঝছি। আমার বাবা তো আমার হাতের চা খেয়ে ৯০, ১৮০ পারলে ৩৬০ ডিগ্রী মুখ বাকা করে।
– ঈশাম জোরে করে হেসে উঠল।
– হাসতেছ?
– হুম! আমার শশুড় মশাই তো বেশ লোক!
– তা বটে।
নীরা ঢকঢক করে চা গিলে ফেলল মনে হচ্ছে শরবত খাচ্ছে।
ঈশাম বেচারা কি করবে? চায়ের দামে সেও শরবত খেল।
নীরা ঈশামের হাত থেকে চায়ের কাপটা নিয়েই জিজ্ঞাসা করল,
– আচ্ছা একটা কথা জিজ্ঞাসা করি?
– জি অবশ্যই।
– তোমার সাথে আমার বিয়ের ৩ মাস হল। আমি তোমাকে মানা করেছিলাম আমার অনুমতি ব্যতিত স্পর্শ না করতে। কিন্তু স্বামী হিসেবে তুমি তো সেই অধিকার রাখতে। তুমি আমাকে জোরও করতে পারতে। কারন তোমার অধিকার আছে। কেন…….
নীরার প্রশ্ন শেষ হতে না হতেই ঈশাম বলে উঠল,
– আমি যদি তোমাকে জোরই করতাম তাহলে তাহলে তুমি আমাকে সব পুরুষই এক এরকম টাইটেল দিতে। কি দিতে না?
নীরা কিছু বলল না।
– শুনো নীরা! যৌন সম্পক স্বামী স্ত্রীর মধ্যে অতি গুরুত্ব পূর্ণ। এটার মাধ্যমে স্বামী স্ত্রীর মধ্যে ভালবাসা গাঢ় হয়, তাছাড়া সন্তান জন্মের প্রক্রিয়া এটা। স্বামী স্ত্রীর জন্য খুবই পবিত্র এটি। বিয়ে হয়ে যাওয়ার পর দেনমহর দেওয়া হয় মূলত স্ত্রীদের লজ্জাস্থানকে হালাল হিসেবে গ্রহন করতে। বিয়ের পর স্বামী স্ত্রীর মধ্যে সব কিছুই বৈধ। বিয়ের প্রথম দিন থেকেই স্বামী স্ত্রীর সাথে সব কিছু করতে পারে।
কিন্তু! যে মেয়ে বিয়ের পর চেনা জায়গা থেকে অচেনা একটা পরিবেশে অচেনা মানুষের সাথে একই ছাদের নিচে যখন আসে তার সব কিছু ছেড়ে তখন সেই মেয়েটির মানসিক অবস্থার কথাও মাথায় রাখতে হবে। কারন অনেকেই স্বাভাবিক থাকতে পারে না। আমি এই বিষয়টা কে আমি খুবই সেনসিটিভ ভাবি। কারন স্বামীর অধিকার আছে ঠিক আছে কিন্তু স্ত্রী মানসিক ভাবে প্রস্তুত কিনা সেটা যদি না ভাবি তাহলে কি হল ব্যাপারটা। আরে? সারাজীবনের জন্য বউ করে ঘরে আনলাম, আমি তো তাকে অবশ্যই পাব কিন্তু যখন সে মানসিক ভাবে প্রস্তুতই না তখন কেন আমি জোরজবরদস্তি করব?
তুমি কি প্রস্তুত ছিলে নীরা?
– না।
– তো? তুমি সেদিন প্রস্তুত ছিলে না। যদি আমি তোমাকে জোর করতাম তাহলে তুমি কি আমাকে সেই দলে ফেলে দিতে না?
– হুম।
– দেখ! বিষয়টা কে কিভাবে নেয় আমি জানি না। আমি কোনো তর্কেও যেতে চাই না। কিন্তু আমি তোমার কাছে শুধু স্বামী না, বন্ধুও হতে চেয়েছি। স্ত্রীর মানসিক দিক দেখাটাও ইসলাম বলে। স্ত্রীর অসুস্থতা, মানসিক দুর্বলতা থাকতেই পারে। সেজন্য স্ত্রী কে মানসিক ভাবে প্রস্তুত নেওয়ার সময় দেওয়া দরকার আমি মনে করি। আমি তোমার স্বামী। অধিকার অবশ্যই পাব। কিন্তু আমি চাইনা আমার পশুত্ব আচরনের কারনে তোমার কাছে আমি সারাজীবন অপছন্দের মানুষ হিসেবে থাকি। আর সেইদিন ধৈর্য্য ধরেছিলাম বলেই আমি আজ তোমার কাছে সম্মানিত। কি নীরা ঠিক বলছি না?
– ঈশামের কথা শুনে নীরা বাকরুদ্ধ!
নীরা বলল,
– তোমার মত করে যদি সবাই ভাবত! কত মেয়ের যে জীবন সুন্দর হত আল্লাহ মালুম!
.
নীরা বলল,
তোমার মত স্বামী পেয়ে আমি সত্যিই ধন্য।
ঈশাম মুচকি হেসে উত্তর দিল,
All credit goes to ALLAH ( Swt).
.
– দাও তো তোমার কোন শার্ট গুলো ময়লা হয়েছে।
– কি করবা?
– কি করব আর? ময়লা শার্ট নিয়ে নিশ্চয় আমি গায়ে দিব না। ধুয়ে দিব।
– তুমি?
– বারে! কেন আমি না?
– না মানে……
– তুমি কি বলতে চাচ্ছ আমি জামা কাপড় ধুতে পারি না? এতই আনাঢ়ী আমি?
– না তা বলি নি।
– ঈশাম তুমি জান না পুরুষের কাপড় ধুয়ে দেওয়া সুন্নাত। হযরত আয়েশা ( রা) উম্মুল মো’মেনীন হয়ে যদি উনার স্বামী হযরত মুহাম্মাদ ( সা) এর কাপড় যদি ধুয়ে দেয় তাহলে আমি তোমার স্ত্রী আমি কেন পারব না?
” হযরত আয়েশা (রা) বলেন, আমি নবী কারীম ( সা) এর কাপড় থেকে নাপাক দূর করতাম। অতপর তা পরিধান করে হুজুর ( সা) নামাজের জন্য চলে যেতেন।
তাছাড়া কাপড় ধুয়ে দেওয়াও স্বামী সেবার অন্তর্ভুক্ত। হযরত আয়েশা ( রা) এর আমলের সাথে আমল মিলে যায় এমন সৌভাগ্যের কাজ আর কি হতে পারে? বিশ্বের শ্রেষ্ঠতম মহিলা হযরত আয়েশা ( রা) তার স্বামী নবী কারীম ( সা) এর কাপড় ধুতে পারলে এবং এটা গৌরবের কাজ হলে আমি করব না কেন?
– বাহ! মাশা আল্লাহ! আমার বউ তো দেখি অনেক কিছুই শিখে গেছে।
– জি হা জনাব! দোয়ার প্রার্থী।
– তোমাকে একটা সুন্দর হাদিস বলি, খুবই সুন্দর..
আনসারী মহিলা হযরত আসমা বিনতে ইয়াজিদ ( রা) এর ঘটনা।
একদা তিনি নবী কারীম ( সা) এর খেদমতে এলেন। সেখানে তখন অনেক সাহাবিও উপস্থিত ছিলেন। মহিলা বললেন,
আমার পিতামাতা আপনার প্রতি কুরবান হউন। আমি মহিলাদের পক্ষ থেকে দায়িত্বশীল হয়ে আপনার দরবারে এসেছি। আমার প্রান আপনার উপর উতসর্গ হউক, পূর্ব পশ্চিমের কোন মহিলা আমার আগমনের সংবাদ জানে না, না কেউ শুনেছে, কিন্তু অনেকেই আমার মত বুদ্ধি রাখে । হে আল্লাহর নবী! আল্লাহ পাক আপনাকে নারী পুরুষ সকলেরই কাছে প্রেরন করেছেন। আমি আপনার উপর এবং আপনি যা নিয়ে আগমন করেছেন তার উপর ঈমান এনেছি। আমরা মহিলারা ঘরে আবদ্ধ থেকে পুরুষের প্রয়োজন পূর্ন করে থাকি। গর্ভে সন্তান নিয়ে তা সহ্য করি। আর পুরুষেরা জুমার নামাযে , জামায়াতে, রোগীর সেবায়, জানাযাতে শরিক হয়, হজ্জের পর হজ্জ করে, এবং আল্লাহর রাস্তায় জিহাদ করার কারনে প্রচুর সাওয়াব পেয়ে থাকে। সমস্ত পুরুষ যখন হজ্জ ওমরা করতে আল্লাহর রাস্তায় বের হয়ে যাত তখন আমরা তাদের ধন সম্পদ পাহারা দেই। তাদের সন্তান দেখা শুনা করি। হে আল্লাহর রাসূল ( সা)! এতে আমাদের কি পরিমান সাওয়াব হয়?
.
এবার রাসূলুল্লাহ ( সা) স্বীয় দিক পরিবর্তন করে সাহাবায়ে কেরামের দিকে ফিরে বললেন,
মহিলার প্রশ্ন গুলো শুনে রাখ সে দ্বীনের ব্যাপারে কেমন প্রশ্ন করেছে।
সাহাবায়ে কেরাম আরয করলেন,
হে আল্লাহর নবী! এ ব্যাপারে আমরা জানি না।
অতপর হুজুর ( সা) মহিলার দিকে ফিরে বললেন- যাও! তুমি ছাড়া অন্যান্য মহিলাদের জানিয়ে দাও যে , তোমরা মহিলারা স্বামীর সাথে উত্তম আচরন করবে , তাদের মন যোগাবে, তাদের কথার বিপরীত কাজ করবে না। এ সমস্ত কাজ পুরুষদের অন্যান্য কাজের সমতুল্য।
সুতরাং মহিলাটি অত্যন্ত খুশি হয়ে তাকবীর দিতে দিতে চলে গেল। ( বায়হাকী, শেয়াবুল ঈমান-৬/ ৪৬১)।
.
নীরা দেখ! একজন আনসারী মহিলা তার আমলের ব্যাপারে কতই যত্নশীল ছিলেন যে, উনি মনে করেছিলেন যে পুরুষেরা যে যে আমল করতে পারে এর ফলে পুরুষেরা সব সাওয়াব নিয়ে গেল, আর আমরা নারী হয়ে পুরুষের প্রয়োজন মিটাই, সন্তান, তাদের ধন সম্পদ, সংসার দেখভাল করি, তাহলে আমরা নারীরা কি তাদের আমলের তুলনায় পিছিয়ে পরছি?
এরপর রাসূলুল্লাহ ( সা) বলে দিলেন, স্বামীর সাথে ভাল আচরন, তাদের প্রয়োজন পূর্ন, তাদের কথা বিপরীতে কাজ না করলে পুরুষের সমান সাওয়াব তারাও লাভ করবে। সুবহানাল্লাহ! আল্লাহর সিস্টেম কতই না চমতকার!
.
নীরা ও ঈশাম গল্প করছে। এরপর নীরা ঈশামের কাপড় চোপড় ধুতে গেল। দুপুর ১২ টার দিকে নীরার ডাক….
– এই যে মহাশয়! আসুন গোসল সেরে নিন। জুমার নামাজে যাবেন না? আমি আপনার গোসলের পানি রেডি করে রেখেছি।
– মেঘ না চাইতেই বৃষ্টি?
– জি হা! তুমি কি জান না, হযরত আয়েশা ( রা) নবি কারীম ( সা) এর জন্য ওযু গোসলের জন্য পানি প্রস্তুত করে রাখতেন।
” হযরত আয়েশা ( রা) বলেন, রাতের বেলা আমি নবী কারীম ( সা) এর জন্য পানির তিনটি পাত্র প্রস্তুত রাখতাম।
১) পানির পাত্র, এই পাত্র দ্বারা রাসূলুল্লাহ ( সা) পেশাব- পায়খানা ওযু ইত্যাদি করতেন।
২) মিসওয়াক এর।
৩) পান করার পাত্র।
সো! আমিও তাই করব।
– ঈশাম নীরার কাজ দেখে খুবই খুশি হল।
– তোমার আরাম আয়েশের ব্যাপারেও আমাকে সতর্ক থাকতে হবে। তুমিই আমার জান্নাত, আবার তুমিই আমার জাহান্নাম। তুমি যদি সন্তুষ্ট থাক তাহলে আল্লাহ আমাকে আল্লাহর ইচ্ছায় জান্নাতে দিবেন, আর যদি অসন্তুষ্ট থাক তাহলে আল্লাহ, আল্লাহর ইচ্ছায় আমাকে জাহান্নামে দিবেন।
– ঈশাম বলে উঠল! আলহামদুলিল্লাহ! আমি সন্তুষ্ট !
এই বলে ঈশাম নীরাকে দুইহাতে জড়িয়ে ধরতেই নীরা চিতকার করে বলে উঠল,
– মা!!!!!
তাড়াতাড়ি করে ঈশাম নীরাকে দিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যেতে লাগল, আর পিছন ফিরে নীরাকে বলল,
– মনে থাকে যেন।
নীরার কি যে হাসি!
.
গোসল সেরে ঈশাম দেখল নীরা পাজামা, পাঞ্জাবী, টুপি বিছানার উপর রেখে দিয়েছে। ঈশাম তা পড়ে নিল।
নীরা হাতে চিরুনি নিয়ে ছোট বাচ্চাদের যেমন করে মায়েরা চিরুনি দিয়ে আচরিয়ে দেয় ঠিক তেমনি করে ঈশামের মাথার চুল আচরিয়ে দিচ্ছে।
ঈশাম কিছুই বলল না। কারন বলারও কিছু ছিল না। শুধু আল্লাহ কে শুকরিয়া জানাচ্ছিল।
নীরা বলে উঠল,
হযরত আয়েশা ( রা) বলেন, আমি হায়েয অবস্থায় রাসূলুল্লাহ ( সা) এর মাথায় চিরুনি করতাম। ( বুখারি- ৫৫০১)
তাই আমিও করেছি।
– তুমি দেখছি অনেক কিছুই শিখে ফেলেছ।
– হুম! হুম! দাড়াও আরেকটা কাজ বাকি আছে।
– কি?
– নীরা দৌড়ে গিয়ে আতরের শিশি নিয়ে আসল। এরপর ঈশামের পাঞ্জাবীর কলার ধরে নীরার কাছে নিয়ে এসে পাঞ্জাবীতে আতর লাগাতে লাগল।
ঈশাম চুপ করে নীরার কর্মকাণ্ড গুলো দেখছে।
” হযরত আয়েশা ( রা) বলেন, আমি নিজ হাতে নবী কারীম ( সা) এর গায়ে এহরাম বাধার সময় খুশবু লাগিয়েছি এবং তওয়াফে যেয়ারতের আগে মিনায়ও খুশবু লাগিয়েছি। ( বুখারি- ৫৪৯৮)।
– এবার নামাজে যাও।
– তুমিই তো সব করলা। আমাকে তো কিছুই করতে দিলা না।
– তুমি আবার কি করবা?
– ঈশাম নীরার কপালে মিষ্টি একটা ঈশামের ঠোটের একটা স্পর্শ লাগিয়ে দিল।
– ওকে! এইবার আমার কাজটা করলাম।
নীরা মুখ নিচু করে আছে।
– যাও তো এবার মসজিদে।
– আচ্ছা! আচ্ছা! যাচ্ছি তো! ঠেলো না!
.
নীরা এখন খাস পর্দা করে। হাত পা মোজা পরিধান করে। এখন সে পর্দা করে শুধু আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য। হেদায়েত পাওয়ার আগে নীরা অনিচ্ছাকৃত ভাবে পর্দা করত কিন্তু এখন শুধু আল্লাহর জন্যই করে ইচ্ছাকৃত ভাবে।
নীরা এখন নামাজ পরে, আল্লাহর জন্য। ঈশামকে তাহাজ্জুদে ডেকে দেয়, ফজরের সময়ে মসজিদে পাঠিয়ে দেয়।
নীরার ফোনে আর গান নেই, আছে কুরঅানের এপস।
নীরার অবসর সময় কাটে ইসলামিক বই পড়ে।
নীরা কিছুদিনের মধ্যেই সংসার বুঝে গেছে। শাশুড়ির সাথে কাজ করে সংসারের।
স্বামী সেবায় নীরা কোনো ত্রুটি রাখতে নারাজ।
ঈশাম কোন কাজে খুশি হবে সেই কাজটি করতে পারলে যেন, তার আনন্দের সীমা থাকে না।
ছোট ছোট আমল সে একদম জব্দ করে ফেলেছে, কম আমল করলেও নীরা নিয়মিত করে।
শশুড় শাশুড়ির মন জয় করে ফেলেছে।
আনাঢ়ী মেয়ে নীরার এমন পরিবর্তন দেখে ঈশাম তার রবের নিকট কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আর স্ত্রী নীরার জন্য আল্লাহর দরবারে দোয়া করে।
ঈশাম নীরার সাথেই জান্নাতে যেতে। জান্নাতে নীরাকে সঙ্গি হিসেবে পেতে চায়। আল্লাহর দরবারে চোখের অশ্রু ফেলে সে কি মিনতি ঈশামের।
অপর দিকে নীরাও ঠিক একই দোয়া করে।
দুজন দুদিকে দোয়া করে । কিন্তু শ্রোতা একজন। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা।
তিনিই উত্তম পরিকল্পনাকারী।
.
কয়েক মাস পর……….
নীরার শরীর খুব খারাপ সকাল থেকে।
ঈশামকে ফোন দিল নীরা,
– আসসালামু আলাইকুম।
– ও আলাইকুমুসসালাম। নীরু? তোমার কন্ঠ এমন শোনাচ্ছে কেন? শরীর খারাপ তোমার?
– হুম! সকাল থেকে শরীরটা অনেক খারাপ লাগছে।
– মা কে বলেছ?
– হুম। কিন্তু তুমি আস তাড়াতাড়ি।
– ইনশাআল্লাহ।
.
অনেক চেষ্টা করেও ঈশাম আজকে তাড়াতাড়ি ছুটি নিতে পারে নি। অফিস আওয়ার শেষ হলেই যেতে পারবে এর আগে না। নীরাকে ফোন করে জানাল ঈশাম। নীরা হেসে বলল, আমি জানি সব ঈশাম, তুমি এত ব্যস্ত হইও না। আমি এখন সুস্থ আছি আলহামদুলিল্লাহ।
অফিস শেষে ঈশাম বাসায় আসল।
– নীরু কেমন আছ?
– আলহামদুলিল্লাহ ভাল।
– কি হইছিল?
– জানি না। হঠাত করে বমি করেছি। বমি করতে করতে একদম কাহিল আমি।
.
( চলবে ইনশাআল্লাহ)