ঘাস ফড়িং 3,4

ঘাস ফড়িং

ঘাস ফড়িং সকল পর্ব👈 

ঘাস ফড়িং-৩

___________
★★★
তাকিয়া সকলের মলিন মুখ দেখে খুবই বিস্মিত হলো। কেউই তাকে কিছু বলছে না। সবাই নিরব। তাকিয়া জানালা দিয়ে বাহিরে উঁকি দিলো। উঠোনে তার মা বোন মুখে কাপর দিয়ে কান্না করছে। আসে পাশে অনেক মানুষ তাদের বাড়ি ঘিরে দাড়িয়ে আছে। তাকিয়া বিষয়টি সুক্ষ ভাবে বুঝার চেষ্টা করলো। সে নিচে নামলো।উঠোনে সাদা কাপড়ে আবৃত একটি লাশ সোজা হয়ে শুয়ে আছে।তাকিয়া বিষয়টি বুঝার জন্য সকলের দিকে উৎসুক দৃষ্টিতে তাকালো।কেউ কিছু বললোনা।বরঞ্চ তার দিকে দৃষ্টি পড়তেই তারা দৃষ্টি নামিয়ে নিলো। একজন ব্যক্তি তাকিয়াকে কাছে ডাকলো।এবং লাশের মুখ থেকে কাপড় খানা সরিয়ে দিলো।তাকিয়া লাশটির দিকে এক নজর তাকালো। সে মূর্তির মত দাঁড়িয়ে আছে। তবে এ মূহুর্ত বেশিক্ষন স্থায়ী হলো না।সে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে ছটফট করতে থাকলো।১১ বছরের একটা শিশু এই মুহুর্তে কি ই বা আর করতে পারে। তাকিয়ার কান্নার আর্তনাদে বাড়ির প্রতিটি গাছপালা থেকে শুরু করে বালু কণারা পর্যন্ত দুঃখ বিলাশে মগ্ন হচ্ছে।বাতাসের সাথে সাথে দীর্ঘ শ্বাসের আবাস পাওয়া যাচ্ছে। বাতাসের প্রকট যেন ধীরে ধীরে বেড়েই চলেছে। মনে হচ্ছে ঝড় আসবে।এ অন্যায় কেউই মেনে নিতে পারছে না হয়তো।কিন্তু সবাই কি করেই বা জানবে? কি হয়েছিলো হানিফ সাহেবের সাথে। কেউই জানতে পারবেনা।টাকার দাপটের কাছে দলীল প্রমান তো উধাও।এ সমাজে এভাবেই হয়তো প্রতিটা অপরাধী মাথা উচু করে দিন পার করে যাচ্ছে।কিন্তু আল্লাহ ছাড়বেন না অপরাধীদের। আজ না হয় কাল এদের দাড় হতেই হবে শাস্তির কাঠগড়ায়। আপনার অতীত শিশির ভেজা স্বচ্ছ ঘাসের ন্যায় মনোরম কাটতেই পারে।তাই ভবিষ্যতও যে এমনি হবে? এতটা নিশ্চিত কিভাবে হচ্ছেন? অপরাধী অবশ্যই শাস্তি পাবে।হয়তো তা সঠিক সময়ে।
সাত দিন পার হয়ে গেলো। তাকিয়া এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি।নিজেকে শান্ত করতে পারেনি।রাফিয়া যদিও তার সাথে খারাপ ব্যবহার করে।কিন্তু রেবেকা তার মুখোশ টি এখনো উন্মোচন করেনি।হয়তো সে সুযোগ খুঁজছে। অথবা অপেক্ষা করছে তাকিয়া প্রাপ্তবয়স্ক হওয়া পর্যন্ত।তাকিয়ার এখন খারাপ সময় যাচ্ছে। একেক করে সবাই তার কাছে মুখোশ বিহীন আসল চেহারায় উপস্থিত হচ্ছে। যদিও তার এসবে মাথা ব্যথা নেই।কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতার মত কষ্ট কি সহজেই সহ্য করা যায়?কিন্তু এ ক্ষেত্রে আনিকা একদম ভিন্ন।সে তার সইয়ের খারাপ সময়ে তাকে ছেড়ে যায়নি। আনিকার দাদি এসেছে তাকিয়া কে দেখার জন্য। সে তার রুমে গুটিশুটি হয়ে শুয়ে আছে।দাদিকে দেখেই জড়িয়ে ধরলো।অঝোরে কাঁদতে আরম্ভ করলো।দাদি তাকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে নিলেন।মাথায় হাত বুলাতে থাকলেন। সেই সাথে কিছুক্ষন কতক রকম সান্ত্বনামূলক বাণী শুনালেন।তিনি তাকে স্বাভাবিক হতে বললেন। জীবনের মর্ম বুঝালেন। এতকিছুর পরও তিনি তাকে তার সৎ মা সম্পর্কে কোন প্রকার বিদ্বেষ মূলক কথা বললেন না।তিনি বুঝালেন তোমাকে তাদের নিয়েই বাচতে হবে। তাদেরকে পরিবারের মত ভালোবাসতে হবে।আবারো পড়া লিখায় মনোযোগি হও। তুমি মাদ্রাসায় যাচ্ছোনা বিধায় আনিকাও যাচ্ছেনা।
তুমি যদি জ্ঞান অর্জন না করো তাহলে কিভাবে আল্লাহকে জানবে? আল্লাহকে জানার জন্য, ভালোবাসার জন্য হলেও তোমাকে জ্ঞান অর্জন করা উচিত। এখন তাকিয়ার কিছুটা হালকা লাগছে।কারণ কেউ তাকে ভালোবাসা দিয়ে জীবন সম্পর্কে বুঝাচ্ছে।’ ভালোবাসা’ চারটি বাক্য এতে। কিন্তু এ চারটি বাক্যই অসম্ভব শক্তিশালী। যা আপনি রাগ বা শাসন দিয়ে করতে পারবেননা।তা আপনি এ চারটি বাক্য দিয়ে করতে পারবেন।
তাকিয়ার বাবার মৃত্যুর অনেক দিন হয়ে গিয়েছে। এর মাঝে অনেক কিছু পরিবর্তন হয়েছে। তাকিয়া আর রাফিয়া একই মাদ্রাসায় পড়তো।হানিফ সাহেব তাদেরকে শহরের স্বনামধন্য এক মাদ্রাসায় ভর্তি করেছিলেন।কিন্তু রাফিয়ার মাদ্রাসায় পড়তে একদমই ভালো লাগতোনা।সে বাধ্য হয়ে সেখানে যেত।এখন হানিফ সাহেবের মৃত্যুর পর সে এই সময় টিকে কাজে লাগিয়েছে।সে তার মাকে পুরো বিষয়টি খুলে বললো। রেবেকাও চায়না মেয়ে মাদ্রাসায় পড়ুক। তাই মেয়েকে পাঠিয়ে দিলো ঢাকা, তার খালার বাড়ি। সেখানে থেকেই তাকে বড় একটি স্কুলে ভর্তি করে দিলো। আর তাকিয়াকে ওই মাদ্রাসা থেকে এনে ছোট খাটো একটি এতীমখানায় ভর্তি করলো। তাকিয়া যদিও কষ্ট পেয়েছিলো।কিন্তু সে কোন প্রতিবাদ করেনি।এর পিছনেও যথেষ্ট কারন ছিলো।তাকিয়া মাদ্রাসায় থাকা কালীন সময় একজন শিক্ষিকা তাকে কিছু নাসিহত করেছিলেন। যা এখনো তার মনে দাগ কেটে আছে।তিনি কুরআনের কিছু আয়াত তাকে শুনিয়েছিলেন।তন্মধ্যে একটি হলো এমন।
ভেঙে পড়ো না, নিরাশ হইও না।সাহায্য আসবেই এটা আল্লাহর ওয়াদা,জেনে রাখো, আল্লাহর সাহায্য অতি নিকটে।
সুরা বাকারা।
বাহির থেকে নিক্ষিপ্ত তীর যতই আঘাত করুক না কেন।তুমি হাল ছাড়বেনা। ভেঙে পড়বেনা।হতাশ হবেনা।আল্লাহর উপর ভরসা করে থাকবে।দেখবে অলৌকিক ভাবে একদিন সব ক্ষত নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।
তাকিয়াও এমটিই ভাবে। যেখানে স্বয়ং আল্লাহ তায়ালা নিজে তাকে সাহায্য করবেন বলে ওয়াদা করেছেন।সুতরাং কিসের হতাশা? কিসের আক্ষেপ? তাই সে সেদিন কিছু না বলে মায়ের প্রতিটি সিদ্ধান্ত মাথা পেতে মেনে নিয়েছিলো।
রেবেকার ধারনা ছিলো।ছোট খাটো প্রতিষ্ঠান গুলোতে হয়তো পড়া লেখা হয়না।কিন্তু সে ভুলে গিয়েছে। ইচ্ছা শক্তি টা হচ্ছে নিজের কাছে।তাকিয়া ছোট প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী হলেও সে খুব মেধাবী। সে এখানেই মন লাগিয়ে পড়তে থাকলো।সামনে তার বোর্ড পরীক্ষা।তাকে ভালো কিছু করতেই হবে। আলহামদুলিল্লাহ আল্লাহ তার ইচ্ছে পূরণ করলেন। সে বাংলাদেশ বোর্ড থেকে পরিক্ষা দিয়ে পুরো বাংলাদেশে মেধা তালিকায় ৫ম স্থান অধিকার করলো।অন্যদিকে রাফিয়া পুরোই এর বিপরীত। কোনরকম অল্প কিছু নাম্বার দিয়ে সে উপরের ক্লাসে উঠার চেষ্টা করছে।দুজনের মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য। অপরাধীদের বিচার হয়তো আল্লাহ তায়ালা এভাবেই ইনসাফের সাথে ধীরে ধীরে নিয়ে থাকেন।
রাফিয়া ঢাকা এসেছে ২ বছর হয়ে গিয়েছে।এই ২ বছরে রাফিয়ার মনে বই খাতা না থাকলেও সাদাত রাফিয়ার মনের পুরোটা জুরেই আছে। সাদাতরা হচ্ছে তাদের বাড়িওয়ালা। সে যদিও রাফিয়া কে পাত্তা দেয়না। তাতেকি? তবুও রাফিয়া সাদাত কে বিরক্ত করতেই পছন্দ করে।যেমন সাদাতের আসার সময়টাতে সিড়ির সামনে দাড়িয়ে থাকা।খালামনি কিছু রান্না করে দিলে নিজেই খাবার গুলো সাদাত দের ফ্ল্যাট যেয়ে দিয়ে আসা। কারণ অকারণে বিভিন্ন বাহানায় তাদের ঘরে প্রবেশ করা ইত্যাদি ইত্যাদি। কিন্তু সাদাতের এদিকে কোন ভ্রুক্ষেপ নেই। সে ভালো করে চেয়েও দেখে না রাফিয়ার দিকে।রাফিয়া অবশ্য, সুন্দর, সুদর্শন, বড়লোক ছেলেদের খুব পছন্দ করে। আর এই দুটো গুন সাদাতের মধ্যে পুরোপুরি বিদ্যমান।সাদাত যদিও মাদ্রাসার স্টুডেন্ট। সেই হিসাবে তার আচার আচরণ খুবই সুন্দর। এই বিষয়টিও রাফিয়ার মুগ্ধতার কারন।একদিন দুপুরের কাহিনী। সাদাত সবে মাত্র মাদ্রাসা থেকে এসেছে।বড্ড ক্লান্ত। ঘরে ঢুকতে যাবে তখনি খেয়াল করলো। দরজার মেঝেতে একটি চিরকুট ফেলা। বিষয়টি তার বাবা মায়ের দৃষ্টিগোচর হতে পারে।তাই সে চিরকুট টি উঠালো।হাতে নিতেই বুঝা হয়ে গেলো এটা কার কাজ।সাদাত পুরো বিষয়টিতেই ভ্রুক্ষেপহীন। তাই সে তেমন আগ্রহ দেখালোনা।যদিও এসব নতুন না।পূর্ব থেকেই এমন করে আসছে রাফিয়া।কিন্তু এবার সাদাতের প্রচন্ড রাগ হলো। সে ফ্রেশ হয়ে চিরকুট টি খুললো। তার মধ্যে ভালোবাসার প্রস্তাবটি সাজিয়ে গুছিয়ে
লেখা হয়েছে। যদিও এসব লিখা সাদাত কে আকর্ষণ করেনি।কিন্তু মাথা গরম অবশ্যই করেছে।ইচ্ছা করছিলো এখনি মেয়েটিকে যেয়ে বলবে। ঢাকায় এসেছো প্রেম করতে নাকি পড়া লেখা করতে।কিন্তু সে নিজেকে সংবরণ করলো।তাছাড়া মেয়েটির বাড়ি লক্ষিপুরে।লক্ষিপুর গ্রামটির প্রতি তার আলাদা টান রয়েছে।এর পিছনেও অবশ্য সুন্দর একটি কারন লুকিয়ে আছে।সে অন্যবারের মত এবারো তেমন মাথাঘামালোনা। সে চাইলেই পারে তার বাবাকে বলে রাফিয়াদের বাড়ি থেকে বের করে দিতে।কিন্তু সে এটা করেনা।কারন ওইযে লক্ষিপুর গ্রাম! সাদাত বিরক্তি ভাব নিয়ে চিরকুট টির নিচে লিখে দিলো। সামনে থেকে এরকম আজে বাজে কাজ করলে এই বাড়ি থেকে আপনাদের বের করে দেওয়া হবে।লিখা শেষ করে চিঠিটি খামে ভরে দিলো। সুযোগ বুঝে চিরকুটটি মেয়েটিকে দিয়ে দিবে।সাদাত কিছু একটা ভাবলো। আক্ষেপের স্বরে বললো যদি তুমি এই চিঠি আমায় দিতে! তাহলে সযত্নে আমি সেটা রেখে দিতাম। সে ভাবনার জগতে বেশিক্ষণ ডুবে থাকলোনা। সে জানে তাকে পড়া লিখা শেষ করতে হবে।এবং সেই কাংখিত মানুষটি কাছে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে যেতে হবে।তাদের এই অপেক্ষার পর্ব হয়তো তখনি শেষ হবে। যদি আল্লাহ চান।
তার মাথায় ঘুমপরীরা হাত বুলাচ্ছে।কিন্তু ঘুমালে তো চলবে না। দুপুরে খেয়েই তাকরার জন্য আবার বের হতে হবে।
আসছে।
ঘাসফড়িং – ৪
____________
রাফিয়া সাদাতের কাছ থেকে এমন উত্তর আশা করেনি। সে ভেবেছিলো সাদাত তার প্রস্তাবে রাজী হবে।কিন্তু রাফিয়াকে সে অবাক করে প্রেম প্রস্তাব ফিরিয়ে দিলো। রাফিয়া হাল ছাড়ার পাত্রী নয়।যে করেই হোক সাদাতের মন জয় করতে হবে। সামনে পরীক্ষা। সেদিকে তার কোনো খেয়াল নেই।পরীক্ষার সময় টুকু অন্তত এসব চিন্তা মাথায় না আনলেই হয়। সে বই নিয়ে টেবিলে বসলো।গুনে গুনে দু পৃষ্ঠা পড়লো।আর পড়তে ইচ্ছে করছেনা।বই রেখে দিলো। কিছুতেই মাথা থেকে সাদাতের চিন্তা নামাতে পারছে না। জানালের পাশে গিয়ে দাড়ালো।আজকের আবহাওয়া খুবই সুন্দর। একধরনের ঠান্ডা বাতাস আনমনে ঘরে প্রবেশ করছে। রাফিয়া জানালায় মাথা ঠেকালো।অস্থির লাগছে।তার মাথায় নতুন বুদ্ধির উদয় হয়েছে।সাদাতের চাচাতো বোন তার স্কুলেই পড়ে।তার সাথে বন্ধুত্ব করলে কেমন হয়? রাফিয়া বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস।সাদাতের আপন কোন বোন নেই।খালাতো, চাচাতো বোনরা রয়েছে। সাদাত তার বাবা মায়ের একটাই সন্তান। খুব আদরের।রাফিয়া জানালা থেকে সরে এসে বিছানায় বসলো।ঠোঁটের কোনে হাসির রেখা ফুটে উঠলো।এখন আর অস্থির লাগছেনা।এখন শুধু সাদাতের বোন আনিধাকে হাত করতে পারলেই হয়।
_______
সাদাত রাস্তা দিয়ে অন্যমনস্ক হয়ে হেটে যাচ্ছে।আশে পাশের কোনদিকে খেয়াল নেই।দু হাত পিছনে মুষ্টি বদ্ধ করা।দৃষ্টি নিচের দিকে নিবদ্ধ। পাশে অনেক রিকশাওয়ালারা রিকশার হ্যান্ডেল ধরে দাঁড়িয়ে আছেন।কারো কারো কাঁধে গামছা ঝুলছে। একজন রিকশাওয়ালা সাদাত কে ডাক দিলো।তার ডাকে সাদাতের হুশ ফিরলো।
ভাই যাবেন?
সাদাত দু দিকে মাথা নাড়ালো। বুঝালো সে যাবেনা।রিকশা চালক আশাহত হলেন। কিন্তু এ অবস্থায় বেশিক্ষণ ডুবে থাকলেননা।পরক্ষনেই আবার অন্য যাত্রীদেরকে ডাকা শুরু করলেন।
লোকটি ঘেমে গিয়েছে।কপাল বেয়ে ঘাম গড়িয়ে পড়ছে।নিচে পড়ার পূর্বেই সে গামছা দিয়ে আবার গাল মুছে নিচ্ছে।সাদাত ব্যাপারটি লক্ষ করলো।মায়া হলো তার। মন সায় না দিলেও রিকশা চালকের দিকে এগিয়ে গেলো সে। ছোট একটি নিশ্বাস ফেললো।এবং বললো।
মামা চলুন। আমি যাবো। মুহুর্তের মধ্যেই লোকটির মুখখানি হাসোজ্জল হয়ে উঠলো।সাদাত বিষয়টি উপভোগ করলো।রিকশা নিজ গতিতে এগিয়ে চলছে।বাতাসের আনাগোনা প্রচুর। মুহুর্তেই সাদাতের পুরো গাত্রের রন্ধ্রে রন্ধ্রে তা ঢুকে পড়ছে।সে চোখ বন্ধ করলো। তার সুন্দর মুখ খানি একটু এগিয়ে দিলো। বাতাস স্বীয় হাত দ্বারা তার মুখ বুলিয়ে দিচ্ছে।মাথার টুপি ভেদ করে চুলের আনাচে কানাচে সানন্দেই তা প্রবেশ করছে।সাদাত চোখ খুললোনা।সহসা ছোট একটি মেয়ের প্রতিচ্ছবি তার চোখে ভেসে উঠলো।তার চুল গুলো লাল ফিতা দ্বারা বেণি করা। ফিরোজা কালারের একটি ফ্রগ পড়ে সাদাতের সামনে দাড়িয়ে আছে। মলিন মুখ নিয়ে বলছে। প্লিজ যাসনা।তুই গেলে আমি কার সাথে মিশবো।সাদাত কান্না চাপিয়ে মেয়েটাকে উদ্দেশ্য করে বলছে।এভাবে কাদিস না।দেখবি আমি খুব তারাতাড়ি ফিরে আসবো।আবারো আমরা মাঠে এসে কানামাছি খেলবো।অনেক মজা হবে।কিন্তু সাদাত তার সেদিনের কথা রাখতে পারেনি। ছোট মেয়েটিকে সাদাত এখনো খুব মনে করে। কেন করে সে জানেনা।সাদাতের ধারণা। পরীর মত ছোট মেয়েটি এখন অনেক বড় হয়ে গিয়েছে।এবং তাকে পুরোপুরি ভুলে গিয়েছে।
সাদাত চোখ বুজেই বললো।আমি আসবো খুব তাড়াতাড়ি, আসবো তোমার কাছে।
“রিকশা চালক সাদাতের ক্ষীণ স্বর শুনে বললেন। আমারে কিছু কইলেন।
“সাদাত চোখ মেললো। নিজেকে প্রস্তুত করে বললো।না, আপনাকে কিছু বলিনি।আপনি চলুন।
রিকশা এসে সাদাতদের বাড়ির সামনে থামলো।
সে মানিব্যাগ থেকে ৫০ টাকার একটি নোট বের করলো।এবং তার হাতে গুজে দিলো।রিকশা চালক খুশি হলেন।এক ফালি হাসি দিয়ে অপর দিকে রিকশা ঘুরালেন।সাদাত বাড়িতে প্রবেশ করবে।খেয়াল করলো, তাদের গেটের সামনে একটি মেয়ে রিকশাওয়ালার সাথে তর্ক করছে।মেয়েটি করছে বললে ভুল হবে।বরং রিকশা ওয়ালার আওয়াজ টাই বেশি শুনা যাচ্ছে।সাদাতের মাথায় সুক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে।ঝামেলায় যেতে ইচ্ছে করছেনা।কিন্তু নিজের বাড়ির সামনেই এই কাণ্ড ঘটছে,তা দেখে সে সেদিকে এগিয়ে গেলো।মেয়েটির দিকে তাকালোনা। সরাসরি রিকশা ওয়ালা কে উদ্দেশ্য করে বললো।
“কি মামা বাসার সামনে এভাবে ঝগড়া করছেন কেন?
” লোকটি রাগী স্বরে বললেন।আরে মিঞা ঝগড়া করমুনা তয় কি করমু।এই মেয়ে আমারে একটি ছিড়া নোট দিছে, আমি কইছি এই টাহা বদলায় দিতে হইবো। কিন্তু হেয় কইতাসে তার কাছে নাকি কোন টাহা নেই।
“সাদাত হালকা দীর্ঘ শ্বাস টেনে বললো এটুকু ক্ষমা করতে পারেন না।আচ্ছা আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি। কতটাকা দিতে হবে বলেন।
” ৩০ টাকা।
“এই নেন।
রিকশা চালক টাকা পেয়ে আর কথা বাড়ালেননা।কাধে থাকা গামছাটি ভালোমত স্বীয় স্থানে রেখে রিকশা নিয়ে স্থান ত্যাগ করলেন। মুহূর্তেই রিকশাটি তার চোখের আড়াল হয়ে গেলো।সাদাত পিছনে ঘুরলো। রাফিয়া সবগুলো দাত বের করে তার দিকে তাকিয়ে আছে।সাদাত চোখ নামিয়ে নিলো।সে গেটের ভিতরে চলে গেলো।রাফিয়া পিছন থেকে সাদাতকে ডাকলো। সে মাথা ঘুরালোনা।এই মেয়েকে দেখলেই তার মাথা দ্বিগুণ গরম হয়ে যায়।কেন হয় সে জানেনা। রাফিয়া আবারো ডাকলো।সাদাত চলার গতিবেগ থামালো।কিন্তু ঘুরে তাকালোনা।
রাফিয়া মৃদুস্বরে বললো।
“আজকের জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
সাদাত কিছুই বললোনা।সামনে চলতে থাকলো।রাফিয়া আবারো ডাক দিলো।সাদাতের রাগ চরম পর্যায়ে পৌঁছিয়েছে।ইচ্ছে করছে মেয়েটার গালে একটা চর বসিয়ে দিবে।সাদাত নিজেকে সংবরণ করলো। পিছনে না ফিরেই বললো।
” ধন্যবাদ দেওয়ার কিছু নেই।আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলেও আমি এমনটাই করতাম।
“রাফিয়া অস্ফুট স্বরে বললো।সেদিনের জন্য আমি দুঃখিত।
“সাদাত কিছুক্ষন চুপ থাকলো।এরপর বললো। সমস্যা নেই, সামনে থেকে এমন করবেন না।
সে লিফটে ঢুকেই দ্রুত বাটন চেপে দিলো।চতুর্থ তলায় এসে লিফট থেমে গেলো।রাফিয়া নিচেই দাঁড়িয়ে থাকলো।লিফট আবারো নিচে ফিরে আসলো। তবুও সে আজ খুব খুশি। বাসায় যেয়ে মার স্কুল ড্রেস খুলে ফ্রেশ হয়ে নিলো।এবং আয়নার সামনে গিয়ে দাড়ালো। ঘুরেফিরে নিজেকে দেখছিলো।তার ধারণা। সাদাত তাকে পছন্দ করে। না হলে সে সাহায্য করতে এগিয়ে আসতোনা।
____
রাত বাজে ৭ টা। পাখিরা একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। ঝিঁঝি পোকারা জেগে উঠেছে। একমনে ডেকে যাচ্ছে।তাকিয়া নামাজ শেষ করে বারান্দায় এসে বসলো। চোখ দুটো বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে।বাহির থেকে আসা বাতাস তার দীর্ঘ শ্বাসের ভারোত্ব অনুভব করতে পারছে। তাকিয়া আকাশের দিকে তাকালো।কান্না বিজড়িত কন্ঠে বললো।আল্লাহ আমার খুব কষ্ট হয় বাবাকে আর মাকে ছাড়া থাকতে।সৎ মা ভালো,,ঠিক আছে।কিন্তু তার চোখে আমি খারাপ। আমি মাদ্রাসা থেকে আসলে আমার খুব ক্ষুধা পায়।খাবার খেতে চাইলে জরিনা জানায় ভাত নেই।জরিনা তার খাবার থেকে প্রতিদিন আমার জন্য কিছু রেখে দেয়।তুমিই বলো?জরিনা নিজে না খেয়ে আমার জন্য রেখে দেয়, এটা কি খেতে ইচ্ছে করে?তাই এখন আর মাদ্রাসা থেকে আসলে আমার ক্ষুধা পায়না। পায়না বললে ভুল হবে।আমি অভিনয় করেই বেঁচে আছি।বাবা চলে যাওয়ার পর মা তার সমস্ত ব্যবসা নিজেই দেখাশুনা করে।মা সারাদিনই ব্যস্ত থাকে।তাকে কিছু বললেও সে বিরক্ত হয়।তাই এখন আর মাকে বিরক্ত করিনা।মা নিজেই জরিনা কে বলেছে একটা ভাত যেন অপচয় না হয়। আমি একবেলা খেলে অপচয় হয়ে যাবে তাইনা? তাকিয়ার গলা আটকে আসছে।বুকে তীক্ষ যন্ত্রণা হচ্ছে।সে থামলো।হাত দিয়ে চোখ মুছলো। কোলে থাকা কলমটির দিকে দৃষ্টি পড়তেই আবারো চোখ টলমল করে উঠলো।সব কিছু ঝাপসা দেখাচ্ছে।তবুও সে আকাশের দিকে তাকালো। কিছুটা অভিযোগের স্বরে বলল। রাফিয়া আপু মাফির দেওয়া কলম টি ভেঙে দিয়েছে। বাড়ি থেকে যাওয়ার আগে আপুর সাথে আমার ঝগড়া হয়। দোষটি আমারি ছিলো।আপু আমাকে বলেছিলো।ঘর গুছিয়ে দিতে, কিন্তু আমি ভুলে গিয়েছিলাম।
তাই আপু আমার ঘরে এসে আমাকে খুব বকা দিলো। সে সেদিন খুব রেগে গিয়েছিলো।ড্রেসিং টেবিলে গুছিয়ে রাখা কলম টির দিকে তার নজর পড়লো।সে সেটি তুলে নিলো।কর্কশ স্বরে বললো।তোকে দেখি বেশির ভাগ সময় কলমটিকে হাতের মধ্যে রেখে দিস এটা নষ্ট করে দিলেই তুই বেশি কষ্ট পাবি। আপুকে অনেক বলেছিলাম।তুমি আমার সব কলম নষ্ট করে দেও কিন্তু এটা করো না সে শুনেনি। আমার এখন বড্ড ক্লান্ত লাগে। ধীরে ধীরে একাকিত্ব বোধ যেন বেড়েই যাচ্ছে।সুযোগ পেলেই তাকিয়া এভাবে একা বসে বসে কান্না করে।সে বিশ্বাস করে। এই সময় গুলো একদিন শেষ হবে।কিন্তু কখন? কবে? সে জানেনা।জরিনার ডাকে তাকিয়া নড়েচড়ে বসলো।ওড়না দিয়ে ভালো মত মাথা ডাকলো।তরায় চোখের পানি মুছে নিলো।
” জরিনা বললো।একটা কথা বলতে চাইছিলাম।
“হুম বলো।
” না এখন আপনের মন খারাপ।কওয়া যাইবোনা।
“তুমি বললেই আমার মন ভালো হয়ে যাবে।বলো।
জরিনা তাকিয়ার কোলের দিকে তাকালো।ভাঙা কলমটির দিকে তার দৃষ্টি পড়লো। সে দীর্ঘ শ্বাস ফেললো।এবং বললো।আফনে কি মাফি ভাইয়ের কথা মনে করে কাদতেছেন?
” আমি কই কাঁদলাম।
“আফনেরে দেখেই বুঝেছি আমি।
” তেমন কিছুনা বাবা মায়ের কথা মনে পড়ছিলো।
“তা যাই হোক।তয় একটা কথা জানেন।আমরা তাদেরকেই বেশি মনে রাখি। যারা আমগো রে মনে রাখেনা।
” তাকিয়া জরিনার কথা বুঝতে পারলো।কিন্তু সে কিছু বললোনা।
জরিনা আগ্রহ নিয়ে বললো।
আইচ্ছা মাফি ভাই একবার এহেনে আইতেওতো পারে? সেই যে গেছে আর কোনো খবর নাই হের।
একটা কথা কই কিছু মনে কইরেননা।সে মনে হয় আফনেরে ভুইলা গেছে।আফনে শুধু শুধু তার কথা ভাইবা কষ্ট পাইতেছেন।
তাকিয়া জরিনার দিকে ফিরে বললো।একটু বেশিই কথা বলো তুমি।জরিনা থেমে গেলো।কথা বাড়ালোনা।দুজনেই চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।চন্দ্রমামার আশেপাশে তারকারাজিরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কি অপরুপ লাগছে। তাকিয়া জরিনার দিকে ফিরলো।জরিনা এক দৃষ্টিতে চাঁদের দিকে তাকিয়ে আছে।সে গম্ভীর স্বরে বললো। জানো জরিনা মানুষের স্মৃতিতে অতীতের মানুষ গুলো তখনি বেশি করে উপস্থিত হয়। যখন সে বর্তমান মানুষ গুলো থেকে তার প্রাপ্য ভালোবাসা পায়না।সবাই শুধু নিজেকে নিয়েই ব্যস্ত।আনাচে-কানাচে শুধু স্বার্থপর, প্রতারক, অভিনেতাদের ভীর।
“জরিনা সুন্দর চাঁদ থেকে দৃষ্টি সরালো।সে তাকিয়াকে প্রতিত্তোর স্বরুপ কিছুই বললো না।সে বুঝতে পেরেছে কথাটার ওজন প্রচণ্ড ভারী।
আসছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *