ঘাস ফড়িং 5,6,7

ঘাস ফড়িং 5,6,7

ঘাস ফড়িং সকল পর্ব👈 

ঘাস ফড়িং -৫
____________
তাকিয়া এখন ১৬ বছরের কিশোরী। দেখতে মায়ের মত হয়েছে।জ্ঞানের দিক দিয়েও বেশ পাকা পোক্ত।দীর্ঘ কালো কেশ গুচ্ছ তার সৌন্দর্যের আরেকটি উপমা।তা কটিদেশ ছাড়িয়ে গেছে।অক্ষিযুগলের কথা আর কি বলবো?
ছোট বেলা থেকেইতো সুন্দর অক্ষির ( চোখ) প্রশংসা বেশ কুড়িয়েছে সে।কজ্জল (কাজল) না দিলেও কেউ অভিযোগ করবেনা।বরং সকলে মানতে বাধ্য বেচারি বোধহয় চুলা থেকে দু ফোটা কালি নিয়ে চোখ দুটো সাজিয়ে রেখেছে।
মানুষটি যে শুধু বাহ্যিক ভাবেই সুন্দরী তেমননা,তার মন টাও বেশ সুন্দর।
অন্যদিকে রাফিয়া তার বিপরীত। গায়ের রং পুরোপুরি ফর্সা না হলেও দেখতে ভালোই লাগে।কিন্তু রুপোক সৌন্দর্য এর ব্যবধান তাকিয়ার থেকেও বিশাল ফারাক। সেটা তাকিয়ার মত এতটা বিশুদ্ধ নয়।
সে অনেকটা তার মায়ের মত হয়েছে মাথায় ভালো বুদ্ধি না থাকলেও কূটবুদ্ধি কম নেই। সে জন্যইতো খুব সহজে সাদাতের মায়ের মনে এত দিনে জায়গা করে নিয়েছে। তিনি সবসময় রাফিয়ার প্রশংসায় পঞ্চমুখ ।প্রশংসা না করে উপায় কি? রাফিয়া বেশ বুদ্ধি খাটিয়ে আনিধাকে হাত করেছে।এখন সাদাতের বাসায় যাতায়াতের পথ টাও খুব সহজ।
সময় পেলেই সে সেথায় চলে যায়। সাদাতের মাকে রান্নাঘরে দেখলে দৌড়ে তার কাছে গিয়ে কথায় ভুলাতে থাকে।বেশির ভাগ সময়ই তার কাজে সাহায্য করে যেমনঃ রান্নার কাজে, ঘরের কাজে।ইত্যাদি ।তার সামনে ভালো মানুষির মুখোশ পরিধান করে থাকতে সে খুবই পটু।অথচ বাসায় তার কাজ গুলো অন্য কারো করে দিতে হয়। যাইহোক,রাফিয়ার দিন কাল হেসে খেলে পার হয়ে গেলেও,তাকিয়ার সাথে তা হচ্ছেনা।তাকিয়া আগের থেকেও আরো নিরব হয়ে গেছে।সে হাসতে ভুলে গেছে।শান্তি জিনিস টি কেমন, তার স্মৃতিতে এখন আর তা বহমান নেই।যত বড় হচ্ছে ততোই তার উপর নির্যাতনের প্রকট বাড়ছে।
ঘরের সব কাজ এখন তাকিয়াকেই করতে হয়।জরিনার বিয়ে হয়ে গেছে।সে এখন আর তাদের বাসায় থাকেনা।এ নিয়েও অনেক কাহিনী হয়েছে।
জরিনা একদিন বাজারে যাচ্ছিলো। সেখানেরই এক দোকানদারের ছেলের জরিনাকে ভালো লেগে যায়।সে তার বাবা মায়ের মাধ্যমে রেবেকার কাছে প্রস্তাব পাঠায়।কিন্তু রেবেকা প্রস্তাব নাকচ করে দেয়।রেবেকা জরিনাকে সেদিন বুঝিয়েছিলো বিয়েশাদি করার থেকে না করাই ভালো। যদি খারাপ কিছু হয় তাহলে কোথায় যাবি?এরপর অনেক দিন কেটে যায়।জরিনা প্রায়ই মনমরা হয়ে থাকতো।তাকিয়া জরিনাকে বুঝতে পারে।একদিন ভাগ্যক্রমে ছেলেটি আবারো রেবেকার কাছে প্রস্তাব পাঠায়।কিন্তু এবারো রেবেকা পূর্বের ন্যায় জরিনাকে বুঝায়।জরিনা কিছু বলতে চেয়েও চুপ হয়ে যায়।তাকিয়া পুরো বিষয়টিই বুঝতে পারে।সে জরিনাকে সেদিন আশ্বাস দিয়ে বলেছিলো।আমি তোমাকে বুঝতে পারছি,তুমি ভেঙে পড়োনা। ছেলের সাথে তুমি কথা বলো,এবং তার কাছে চলে যাও।কারন মা কখনোই তোমায় বিয়ে দিবেনা।জরিনা নিচু গলায় বলেছিলো।আমি চইলা গেলে আফনে একদম একা হইয়া যাইবেন। আফনার কিছু না হওয়া পর্যন্ত আমি যাইবার চাইনা।
“আমি তোমার মন পড়তে পারছি।তোমার চোখই আমাকে সেটা পড়তে সাহায্য করছে।তুমি ছেলেটাকে পছন্দ করো আমি জানি।নিজের ভবিষ্যতের রাস্তা নিজেই খুজে নাও।আমাকে নিয়ে ভেবোনা।আল্লাহ আছেন আমার জন্য।
অনেক বুঝানোর পর জরিনা সেদিন সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করেছিল।এবং ছেলেটির সাথে পালিয়ে গিয়েছিল ।তাকিয়াই তাকে পালাতে সাহায্য করেছে।কিন্তু এতে জরিনার লাভ হলেও তাকিয়ার কোন লাভ হয়নি।বরঞ্চ তাকিয়ার উপর মানসিক আঘাতের রুপ বদল হয়ে শারীরিক আঘাতের পর্যায় চলে গিয়েছে ।সত্য খুব দ্রুতই প্রকাশ হয়।রেবেকাও জেনে গিয়েছে ,জরিনার পালানোর ক্ষেত্রে তাকিয়ারই হাত রয়েছে। সে জরিনার সমস্ত কাজ তাকিয়ার উপর চাপিয়ে দেয়।সেদিন তাকিয়ার কোন অভিযোগ শুনা হয়নি।সেও নিরুপায় ছিলো।কিইবা করার ছিলো তার। এতোকিছুর পরও সে দিব্যি এই মানুষটির সাথেই সময় পার করছিলো।তার ভাষ্যমতে,সে যতই অত্যাচার করুক না কেন সে আমার মা।কিন্তু এভাবে হয়তো মহিলাটি একবার ও ভাবেনি।আচ্ছা ভাবলে কি অনেক বড় ক্ষতি হয়ে যেতো?মোটেও না, বরং কিছু মানুষ এমনি।তারা খারাপ কাজ করতে করতে তাদের মনে খারাবীর একটা দাগ পড়ে যায়। এতো কিছুর পরও তাকিয়া খুব খুশি। কারন জরিনা অনেক সুখে আছে।ভালো মানুষ গুলোর ক্ষেত্রে এমনি হয়। অন্যের ভালো থাকায় তারা সুখ খুজে নেয়।
______
আজ সাদাতদের বাড়ি ভর্তি মেহমান। তার চাচাতো খালাতো ভাই বোনেরা এসেছে।সাদাত খুব আনন্দিত তাদের পেয়ে।আনিধার সাথে রাফিয়াও এসেছে।সে শুধু লুকিয়ে লুকিয়ে দেখছে সাদাতকে।সাদাতের অবশ্য সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই।সে ড্রয়িং রুমে ভাইদের সাথে গল্পে মজে আছে।একেকজন একেকজনকে বিয়ে নিয়ে খোঁচাচ্ছে।সাদাতের কাজিন নাফি সাদাতের থেকে এক বছরের বড়।সে খুবই দুষ্ট। পাশের মানুষটিকে না হাসানো অবধি তার ক্ষান্ত নেই।সেই মূলত সকলকে বিয়ে নিয়ে খোঁচাচ্ছে।সবাই একেকটা মজার উত্তর দিয়ে নিশ্চুপ হয়ে যাচ্ছে। ঘুরে ঘুরে সাদাতের পালা আসতেই সে চুপ হয়ে গেলো। কিছু বললোনা।নাফি বিরতিহীন ভাবে তার কাধে মেরে যাচ্ছে আর বলছে।কিরে চুপ কেন বল শুনি শুনি।নাকি কাওকে পছন্দ করিস। সাদাত মুচকি হাসলো।
সকলে জোর গলায় বললো। হুম বুঝতে পেরেছি।কিন্তু তারা কথার ইতি টানতে পারলোনা।এর আগেই তার বাপ চাচারা রুমে প্রবেশ করলো।একেকজন একেক সোফায় যেয়ে আসন পাতলো।তারা এখন জায়গা সম্পত্তি নিয়ে আলোচনা করবে।সাদাতের ভাইয়েরা জিভে কামড় দিয়ে স্থান ত্যাগ করলো,এবং তারা ছাদের দিকে পা বাড়ালো।আর যাই হোক মুরুব্বিদের সামনে দুষ্টুমি করার সাহস তাদের নেই। সাদাত কিছুটা আনমনা হয়ে আছে।আজ কেন জানি বড্ড মনে পড়ছে তার প্রিয় মানুষটিকে। সহসা তার মন খারাপ হয়ে গেলো।মন খারাপ লুকাতে সে সকলের থেকে বিদায় নিয়ে তার রুমে চলে আসলো।রুমে পা রাখতেই রাফিয়া আর আনিধা কে তার রুমে পায়চারী করতে দেখলো।কিন্তু বিষয়টি নিয়ে সে তেমন মাথা ঘামালোনা। তাকে দেখেই দুজনে রুম থেকে বেরিয়ে পড়লো। সাদাত কোন দিকে খেয়াল না করেই বিছানায় গা এলিয়ে দিলো। ফ্যানের দিকে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে।ফ্যানের পাখা যে তিনটি সেটা আঁচ করা যাচ্ছেনা।ক্লান্তিহীন ভাবে সেটা ঘুরে যাচ্ছে।সাদাত সেথা থেকে দৃষ্টি হটালো।বালিশের নিচ থেকে ফোন খুজে বের করলো। কন্টাক্ট সেভ অপশনে কারো নাম্বার খুজছে সে।অনেকটা অপেক্ষা করতে হলোনা।নাম্বার টি সামনে আসতেই চোখ মুখে আলোকোজ্জ্বলের রেশ দেখা গেলো।মনে রয়েছে একপ্রকার অভয়।সে ভাবতে থাকলো ফোন কি দেবে? নাকি দেবেনা? তার মন বলছে পূর্বের ন্যায় সে আবারো নিরাশ হবে।তবুও ফোন দিলো। সে প্রতি মাসেই একবার হলেও এই নাম্বারে কল দিতো। প্রতিবারই নাম্বারটি সুইচ অফ দেখা যেতো।কিন্তু আজ ভিন্ন কিছু হলো।কল যাচ্ছে,সাদাত উঠে বসলো। তার হৃদপিণ্ড কাপছে।কিন্তু কলটি রিসিভ হলোনা।সে এবার বসা থেকে উঠে দাড়ালো।আবারো কল দিলো।
তিনবারের মাথায় কলটি রিসিভ হলো।
অপর পাশে কে আছে বিষয়টি না জেনেই সাদাত উৎসুক স্বরে বললো।
“তাকিয়া আমি মাফি।এতো দিন কত ফোন দিয়েছি।তুমি ফোন বন্ধ করে রেখেছিলে কেন?
” ও মাফি ভাইয়া। কেমন আছেন ভাই।ভাই আপনি এতদিন কই ছিলেন।আপনি জানেন তাকিয়া আপনাকে কতটা মিস করে।
“তাকিয়া আমাকে মিস করে তাহলে আপনি কে?
” ভাই আমি তাদের বাসায় কাজ করতাম। আমার নাম জরিনা।আমার স্বামী যখন আমারে বিয়ের প্রস্তাব দেয়।তখন তাকিয়া আমারে বাসা থেকে পালাইতে সাহায্য করে।কারন এ ছাড়া কোন উপায় ছিলো না।তার সৎ মা কখনো চাইতো না আমি বিয়ে শাধি কইরা সংসার করি।সেদিন আসার সময় একটা পুরান বন্ধ সিম আমারে দিয়াছিলো। যেন আমি তারে আমার অবস্থা জানাইতে পারি।এবং তার সাথে যোগাযোগ রাখবার পারি।
জরিনা পুরো কথা শেষ না করতেই সাদাত বললো
“ও জরিনা!হুম আমি চিনতে পেরেছি তোমাকে।তুমি আমাকে বলো তাকিয়া কেমন আছে।
” জরিনা একটু কাঁদো কাঁদো স্বরে বললো।
আফনি ফোন দিছেন ভালা করছেন। আজ আমি সব বলবো।এখন বলার সময় হইছে।তাকিয়া ভালা নেই ভাই।আপনি চলে আসার পর হের বাবা এক মহিলারে বিয়া করছে।ওই মহিলার কাছেই এহন তাকিয়া থাকে। হের বাবা রোড এক্সিডেন্টে মারা গেছে।এরপর থেইকাই শুরু হয় হের উপর নির্যাতন। আমি একদিন ফোন দিছিলাম এরপর আর ফোন দেয়ার সাহস হয়নাই।কারন হের সৎ মা ফোন নিয়া গেছে।আর আমারে কইছে,যদি আমি ফোন দেই তাইলে তাকিয়ার সাথে খারাপ কিছু হইবো।কিন্তু জানেন ভাই মেয়েটা অনেক ভালা।এমন ভালা মাইয়া এই দুনিয়ায় কমই পাওয়া যাইবো।
“সাদাত এর চোখ টলমল করছে। সে যেন বিশ্বাস করতে পারছেনা এসব। সে অস্ফুট কন্ঠে বললো।
তাকিয়া ভালো নেই। আমি বিশ্বাস করতে পারছি না।আমি তাকিয়ার সাথে কথা বলবো।আমাকে তার নাম্বার দাও।
” ভাই এই কাজ টা আফনি জীবনেও কইরেন না।আফনি বরং সরাসরি তার সাথে কথা কন।তার বাসায় বিয়ের প্রস্তাব পাঠান।এবং তাকে আফনার কাছে নিয়া যান।আফনি তারে ফোন করলে তার উপর নির্যাতন আরো বাড়ব। তয় একটা কথা কই আফনেরে।সে আফনারে খুব ভালোবাসে।আফনার কলমটি নিয়ে এখনো বইসা বইসা কান্না করে। সে মনে করে আফনি তারে ভুইলা গেছেন।কিন্তু সে আফনারে ভুলেনাই।
“তোমার কি মনে হয় আমি তাকে ভুলে গিয়েছি।আমি আমার প্রতিটি নিশ্বাসে নিশ্বাসে তাকে স্বরন করি।
” আমিও মনে করতাম আফনি মনে হয় তাকিয়াকে ভুইলা গেছেন। তাই আমি আপনারে অনেক বকাবকিও করতাম।আমারে মাফ কইরা দেন ভাই।কিন্তু আপনার ছোট বোইন হিসাবে একটাই চাওয়া আপনি তাকিয়ারে এই নরক
থেকে মুক্ত করেন।আর তার সাথে দেখা হইলে বইলেন।আমি খুব ভালা আছি।
“হু
সাদাতের মুখ থেকে আর কোন কথা বের হচ্ছে না।
সে বললো
“আচ্ছা ফোন রেখে দাও জরিনা।আমি কথা বলতে পারছিনা।শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে।
জরিনা আর কথা বাড়ালোনা, ফোন রেখে দিলো।ফোন রাখার মূহুর্তে সে আবারো বললো।মানুষ টাকে এই নরক থেকে বাঁচান খুব কষ্টে আছে সে।
সাদাত ফোন রেখে দিলো।সাথে সাথেই সে হাঁপাতে লাগলো।এমনটি তার ছোট বেলা থেকেই হয়ে আসছে।সে বেশি কষ্ট পেলে ঠিকমত শ্বাস নিতে পারে না।আজও তার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।সে বুকে হাত দিয়ে বড় বড় শ্বাস নিতে থাকলো।মাকে ডাক দিতে চাচ্ছে।কিন্তু আওয়াজ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। বাসার সবাই এখন ব্যস্ত।ইশ যদি একটি বার তার মা রুমে আসতো।এভাবে কতক্ষন থাকতে পারবে. কে জানে।বড্ড পানি তেষ্টা পেয়েছে। সে বুক চেপে ধরেই উঠে দাড়ালো। পা ভর সইলোনা। মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো।মাকে ডাকলো।কিন্তু আওয়াজ হয়তো মায়ের কান অবধি পৌঁছালোনা।সাদাত পর্দার ফাঁক দিয়ে বাহিরে তাকালো।কাওকে দেখা যাচ্ছেনা।কিন্তু কথা বলার আওয়াজ গুলো ঠিকই সানন্দে তার রুমে প্রবেশ করছে।সে মেঝেতে পড়েই ছটফট করতে থাকলো।
আসছে।
ঘাসফড়িং –৬
_____________
রাফিয়া কিছুক্ষন পর পরই সাদাতের রুমে উঁকি দিচ্ছে।সে হয়তো সাদাতের বের হওয়ার অপেক্ষা করছে। কিন্তু সাদাত তো একটু পানির জন্য মরিয়া হয়ে উঠেছে।রাফিয়া রুমের আশে পাশে ঘুর ঘুর করছে।সহসা সে সাদাতের গোঙানির শব্দ শুনতে পেলো।রাফিয়া রুমে উঁকি দিলো।কিন্তু যা দেখলো তার মন খারাপ হওয়ার জন্য সেটা যথেষ্ট ছিল।সে চিৎকার করে বললো ভাইয়া,,,, কি হয়েছে আপনার? সাদাতের আওয়াজ সীমিত। সে ভালো মত কথা বলতে পারছেনা।তবুও সে কথা বলার বৃথা চেষ্টা করলো।ভাঙা ভাঙা গলায় বললো।
মাকে ডাকুন।রাফিয়া এক মূহুর্তও অপেক্ষা করলোনা।দৌড়ে হেনা বেগমের কাছে গেলো।তার ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত,চেহারায় গভীর তমসা বিরাজ করছে। হেনা বেগম আঁচ করতে পারলেন খারাপ কিছু হয়েছে।হেনা এবং জাফর সাহেব উৎসুক হয়ে আছেন,রাফিয়া কি বলতে চায় তা শুনার জন্য।
অবশেষে রাফিয়া বললো।
আন্টি,,, সাদাত ভাইয়া জানি কেমন করছে।হেনা তার বুকে শক্ত করে হাত দিয়ে চেপে ধরলেন।সকাল থেকেই তার খারাপ লাগছিলো।মনে হচ্ছিলো খারাপ কিছু হবে,তাই হলো। জাফর আর হেনা কেউই রাফিয়ার কাছে জানতে চাইলো না কি হয়েছে,দুজনেই ললাটে চিন্তার রেখা নিয়ে ছেলের রুমের দিকে পা বাড়ালেন।হেনা বেগম ছেলের অবস্থা দেখেই হাউ মাউ করে কেঁদে উঠলেন।হাটু ভাজ করে ছেলের সামনে বসলেন,ত্বরান্বিত করে ছেলের মাথা কোলে তুলে নিলেন ।তাদের একটাই সন্তান, খুব আদরের। আর আদর না করে উপায় আছে?সাদাত তার বাবা মায়ের খুব বাধ্য।হেনা বেগম কিছুতেই নিজেকে শান্ত করতে পারছেননা। তার কান্নার আওয়াজ ভারী হচ্ছে।জাফর সাহেব এতে বিরক্ত হলেন। কঠিন গলায় বললেন।দেখছো এখানে ছেলের অবস্থা ভালো না আবার চিৎকার করছো কেন? আনিধা,, হেনাকে এখান থেকে নিয়ে যা তো। কিন্তু হেনা ছেলেকে রেখে যেতে নারাজ।তিনি হার মানলেন।কান্নার আওয়াজ ক্ষীণ করলেন।তাকে নৈরাশ্যবাদীদের অন্তর্ভুক্ত হতেই হবে।নিজেকে শক্ত করে পরাজয়ের ভঙ্গিতে বললেন।আচ্ছা ঠিকাছে আমি আর কান্না করবো না।সাদাতের সামনে পানির গ্লাস আনা হলো।এক গ্লাস খেয়ে তেষ্টা মিটলোনা।গুনে গুনে সে দু গ্লাস পানি খেলো।। জাফর সাহেব ছেলের বুকে হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন।হেনা ছেলের শিরের পাশে বসে নিরবে নয়ননীর ফেলছেন।বাড়ির সকল মেহমানের মন নিমিষেই ঘনঘটা তমিস্র তে পরিণত হলো।রাফিয়াও পাশে দাঁড়িয়ে অনবরত কেঁদে চলেছে।তার দু অক্ষি ক্লান্ত হচ্ছেনা। গাল বেয়ে অশ্রু গড়িয়ে নিচে পড়ছে। সকলকে কক্ষ থেকে চলে যেতে বলা হলো।সাদাত বিশ্রাম নিতে চায়।সবাই চলে গেলো।হেনা বেগম ছেলের পাশে বসে আছেন। তিনি পরম যত্নে তার শির মোবারকে ভালোবাসার পরশ বুলিয়ে দিচ্ছেন।আস্তে আস্তে সাদাত স্বাভাবিক হচ্ছে।কিন্তু এখন তার লম্বা ঘুমের প্রয়োজন। কিন্তু হেনার মনে প্রশ্নের ঝুরিগুলো এখন দানা বাধছে। তিনি নিজেকে শান্ত করলেন। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলেই হেনা হাজার টা প্রশ্ন করবে। কে তোমাকে কষ্ট দিয়েছে বাবা।কারো কথায় কি খুব আঘাত পেয়েছো? ইত্যাদি ইত্যাদি ।কারন হেনা তো ভালো করেই জানে ছেলের কি কারনে এমন হয়। হেনার ইচ্ছা করছে যার জন্য তার ছেলে কষ্ট পেয়েছে। তাকে সে হাজার টা কথা শুনিয়ে দিবে।ভালো ভালোই সে সুস্থ হলেই হয়।
রাফিয়া বেলকনির গ্রিল ধরে দাড়িয়ে আছে। সুন্দর শীতল কারক বাতাস ঘরে প্রবেশ করছে।
রাফিয়ার এসবে ভ্রুক্ষেপহীন ।সে আনমনে বাহিরে তাকিয়ে আছে,তার মন ভালো নেই। সাদাতের প্রতিটি কষ্ট যেন সে অনুভব করতে পারছে ।তার কি বড় কোনো রোগ আছে? নাকি অন্য কিছু,কিছুতো একটা আছেই যার দরুন তার শ্বসল ( শ্বাস প্রশ্বাস গ্রহন) গ্রহনে কষ্ট হয়। রাফিয়া এসব চিন্তায় মশগুল। দ্রুতই তার চিন্তার দেশ থেকে বের হতে হলো।খালামনি ডাকছে। তিনি তিন বার জোরগলায় ডাকলেন।রাফিয়া আসলোনা।এবার কর্কশ কন্ঠে ডাক দিলেন।রাফিয়ার পঞ্চ ইন্দ্রিয় এবার সোজাগ হলো।সে ছুটে গেলো তার খালামনির কাছে।তিনি লাউ কাটছেন, সামনে লাউশাক রাখা। রাফিয়া লাউ শাক হাতে নিয়ে বাছতে থাকলো এবং প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে খালামনির দিকে তাকালো৷
“খালামনি বললেন এত জোরে জোরে ডাকলাম শুনিসনাই।
” রাফিয়া পাল্টে প্রশ্ন করলো।আজ কি লাউ শাক ভাজি করবে?
“আমি তোকে কি প্রশ্ন করলাম আর তুই আমাকে কি বলছিস? আচ্ছা যাই হোক শোন তোকে একটা কথা বলবো কদিন যাবত ভাবছি।কিন্তু বলাই হচ্ছে না।
“কি কথা?
” তোর খালুর অফিস টঙ্গীর দিকে নেওয়া হয়েছে তাই বাসাটা ছেড়ে দিব আমরা । তুই চাইলে আমাদের সাথে যেতে পারিস।
“কিন্তু,,আমার কলেজ এখানে আমি টঙ্গী থেকে কি করবো?
” রাফিয়ার খালামনি লাউ কাটা থেকে মনোযোগ হটিয়ে বললেন।কিন্তু আমাদেরতো সেখানে যেতেই হবে।তুই কি এখানে একা থাকতে পারবি?
“আমি একজন মেয়ে মানুষ হয়ে এতো বড় বাড়ি তে একা কি করে থাকবো।তাছাড়া তুমিতো জানোই আমি কত ভিতু।
” তাহলে এক কাজ করলে কেমন হয়?তোকে না হয় সেখানের কোন কলেজে ভর্তি করে দিলাম।
“কথাটা শুনে রাফিয়ার হার্টবিট কেঁপে উঠলো। এটা কখনো করা যাবেনা।এটা করলে সে তার প্লানিং মোতাবেক আগাতে পারবেনা।কারন মনের আনাচে কানাচে ঘুরঘুর করছে সাদাত কে হাসিল করার লিপ্সা।তাই এই বাড়ি মোটেও পরিত্যাগ করা যাবেনা।রাফিয়া অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললো খালামনি সাদাত,,,,,,,
অমনি খালামনি উফ করে উঠলেন। বটির ধারালো অংশে আঙুলের অগ্রভাগ সামান্য কেটে গেছে। তিনি অপর হাত দিয়ে আঙ্গুল চেপে ধরে বললেন ।হে কি বলছিলি বল।
“রাফিয়া সজ্ঞানে ফিরে এসে বললো। কই কিছু না তো? আমি বলতে চাচ্ছিলাম মায়ের সাথে এ ব্যপারে তুমি আলোচনা করো। মা আশা করছি সুন্দর সিদ্ধান্তই নিবেন।
” হু এটা ঠিক বলেছিস।তোর মাই ঠিক টা বলতে পারবে। তার সাথে কথা বলতে হবে।
_______
তাকিয়ার ক্লাস এখন ফাঁকা।বসে বসে মুতায়ালা করছে সে,তাকে শরহে বেকায়ার মত কঠিন কিতাব টি তাকরা করাতে হয়। তার পাশে বসে আছে আনিকা।সে বকবক করে তার কান ঝালাপালা করছে। তাকিয়া বিরক্ত হচ্ছেনা,তাকে থামাচ্ছেও না, তাকে তার মত ছেড়ে দিয়েছে।কারন সে পুরোপুরিই তার পড়াতে মত্ত।কিছু ক্ষন পর দরসকক্ষে শিক্ষিকা উপস্থিত হলেন। সবাই চুপ হয়ে গেলো।এবং বই খুললো।
তাকিয়া এখন শরহে বেকায়াতে পড়ে। তাদের ক্লাস কেপ্টেন সে।কেপ্টেন হলে কি হবে? সবাই তাকিয়াকে ভালোবাসলেও তার আদেশের তোয়াক্কা কেউ করেনা। এর পিছনেও যথেষ্ট কারন রয়েছে। সে খুব নরম স্বভাবের মেয়ে। নরম মানুষদের এই একটাই দোষ।কাওকে ১০ টা বলে বসিয়ে রাখতে পারেনা।বরঞ্চ নিজেই প্রতিবাদ করতে যেয়ে ৪,৫ কথা শুনে চুপটি মেরে বসে থাকে।আচ্ছা সে যাই হোক।সবাই আগের দিনের পড়াতে একবার চোখ বুলিয়ে নিচ্ছে,একটু পরেই শিক্ষিকা পড়া ধরবেন।শিক্ষিরা গম্ভীরমুখে সবার দিকে একবার পরোখ করে নিলেন।তার দৃষ্টি পিছনে থাকা মেয়েটির দিকে আটকে গেলো। মেয়েটির নাম আয়েশা। আয়েশা পিছনে বসে বসে কান্না করছে।শিক্ষিকা তার কান্নার কারন জানতে চাইলেন। আয়েশা নিরবতা অবলম্বন করলো।কিছুক্ষণ পর নিজে থেকেই সে জানালো আমি বলবো, কিন্তু সবার সামনে না।আয়েশা শিক্ষিকার কাছে আসলো।তার মুখাবয়বের নৈকট্য শিক্ষিকার কর্ণের পাশে।তাকিয়া শিক্ষিকার বা পাশে।সে আচঁ করলো আয়েশার কথা গুলো খুব সহজেই তার কাছে পৌঁছবে। তাই সে স্থান ত্যাগ করতে চাইলো।আয়েশা বারণ করলো।এবং হাসি মুখে বললো।তুমি থাকলে আমার কোন সমস্যা নেই ।তাকিয়াকে ছোট বড় সবাই খুব পছন্দ করে।যার চরিত্র অসম্ভব সুন্দর তাকে পছন্দ না করে উপায় আছে?
আয়েশা বলতে আরম্ভ করলো।
আমার বাবা একজন লোকের সাথে আমার বিয়ে ঠিক করেছে।যার ইসলাম সম্পর্কে কোন ধারনাই নেই।তিনি যেদিন আমাকে দেখতে এসেছিলেন। সেদিন বলেছেন আমি যেন কখনো বরকা না পড়ি, এটা তার পছন্দ না।আর বোরকা পড়লেও যেন হিজাব দিয়ে শুধু চুল ডাকি।মুখ ডেকে রাখাটা তিনি পছন্দ করেননা। ওই দিন আমার মাথায় কাপড় দেওয়া ছিলো, তাই তার মা আমাকে বললেন, মাথায় কাপড় টি ফেলে দাও মা। আমরা তোমার চুল দেখবো,আমার সে দিন কতটা কষ্ট হয়েছিলো শুধু আল্লাহ জানেন,কারন সেখানে ছেলে ছাড়াও তার বন্ধুরা উপস্থিত ছিলো।
কিন্তু তারা খুব বড়লোক তাই বাবা সেখানেই আমাকে বিয়ে দিবেন বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আমার কোন কথাই তিনি শুনছেন না।
মাও একি কথা বলছে। কিন্তু আমি এই লোকটাকে বিয়ে করতে চাইনা,এই লোকটাকে বিয়ে করলে আমি দুনিয়া আখেরাত সব হারাবো।বড় বোন বলছে বিয়ের পর আমি বললে সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু আমি আশ্বাস পাচ্ছিনা।কারন সে এক প্রকার ইসলামবিদ্বেষীদের মত আচরণ করেছে।সে সরাসরিই জানিয়েছে তার দাড়ি রাখা পছন্দনীয় না। যেই মানুষটির ইসলাম সম্পর্কে বিন্দু পরিমানও ধারনা নেই। আমি তার সাথে কি ভাবে থাকবো? আয়েশার চোখ ভিজে উঠেছে।চোখ পানিতে টলমল করছে।সে আর কিছু বলতে পারলোনা।তাকিয়া এক দীর্ঘ শ্বাস ছেড়ে বললো। সত্যিই ওর সমস্যাটা খুব ভয়ানক।
সবাই একি কথাই বলে সব ঠিক হয়ে যাবে।কিন্তু পরে আর কিছুই ঠিক হয়না।
শিক্ষিকা বললেন।
“হু, আচ্ছা বাদ দাও আমার কথা শুনো আয়েশা, তুমি দাইয়্যুস বুঝোতো?
আয়েশা ভ্রু জোড়ার মাঝখানে ক্ষীণ ভাজ ফেললো। সে এমন করে হয়তো বুঝাতে চাচ্ছে।আমি এ সম্পর্কে পুরোপুরি বুঝিনা।
” আচ্ছা আমি তোমাকে বলছি।
শোনো।যে ব্যক্তি তার স্ত্রী সন্তানদের বেহায়াপনা, অশ্লীলতা করার সুযোগ দেয়।তারা বেপর্দায় থাকলেও তাদেরকে কিছু বলে না।তাদেরকে দাইয়ুস বলা হয়।রাসুল সাঃ বলেছেন।তিন ব্যক্তির জন্য জান্নাত হারাম করা হয়েছে।
এক, মাদকাসক্ত, দুই, পিতা মাতার অবাধ্য,
তিন, দাইউস ব্যক্তি।
মুসনাদে আহমাদ।
এখন তুমি আমাকে বলো।তুমি কি তোমার বাবা কে জাহান্নামে দেখতে চাও?
আয়েশা দু দিকে মাথা নাড়ালো।তার মানে না। তাকিয়া মাথায় হাত বুলাতে বুলাতে বললো।
শরিয়ত বিরোধী কোন কাজের আদেশ মান্য করা তোমার জন্য আবশ্যক নয়।এখন যেই আদেশই করুন না কেন। শিক্ষিকার বলা হাদিস টা তুমি তোমার বাবাকে বলবে। দেখবে তোমার বাবা মা কিছু হলেও বুঝবে।শিক্ষিকা তাকিয়ার কথা শুনে বললেন।হু তাকিয়া ঠিক বলেছে।আর নয় তুমি এক কাজ করতে পারো। তুমি তোমার মাকে আমার সাথে দেখা করতে বলবে আমি তাকে বুঝাবো।কারন আমরাও চাইনা লোকটির সাথে তোমার বিয়ে হোক। আর নিজেও বাবা মায়ের সামনে গিয়ে মার্জিতভাবে প্রতিবাদ করবে। তুমি যদি না বলো, তাহলে কখনো তারা তোমাকে জোর করতে পারবেনা।তোমার অনুমোদনই সব চেয়ে বেশি প্রয়োজনীয় এবং কার্যকরী। তুমি আজ বাসায় যেয়ে তোমার মাকে পাঠাবে কেমন?
“আয়েশা মাথা ঝুকালো।এখন কিছুটা হালকা অনুভূতি হচ্ছে।সে স্বস্তির নিশ্বাস ফেললো।
________
রাফিয়ার মা তাকিয়াকে নিয়ে দ্রুত ঢাকা রওনা হবেন।এদিকে তারাও ঢাকা রওনা দিবে।আর সাদাতও লক্ষিপুর রওনা হবে দেখা যাক কি হয়।
কি হয় সেটা জানতে আমাদের আরো অপেক্ষা করতে হবে।
আসছে।
ঘাসফড়িং –৭
_____________
তাকিয়া মাদ্রাসা থেকে এসে ফ্রেশ হয়ে নিলো।আজ তার মাকে বিষন্ন দেখা যাচ্ছে। শাহীন আংকেলের সাথে বিজনেস নিয়ে কথা বলছেন,কোনো ঝামেলা হয়েছে হয়তো। তাকিয়া সেদিকে মাথা ঘামালোনা।এখন অনেক কাজ করতে হবে,সে রান্না ঘরের দিকে এগিয়ে গেলো। ছোট একটি পাতিলে দুজনের জন্য চাল নিয়ে চুলায় বসিয়ে দিলো।পাশের জানালা থেকে ঘরে বাতাস প্রবেশ করছে,কিন্তু জানালাটি পুরোটা খোলা না, তাকিয়া বাতাস উপভোগ করতে চায়,তাই জানালা খুলে দিলো।অতঃপর ফ্রিজের দিকে এগিয়ে গেলো।ফ্রিজে লাল শাক,পটল, কুমড়া, লাউ, সেই সাথে আরো বিভিন্ন ধরনের মাছ রয়েছে।সে আপাতত ইলিশ মাছ এবং লাউ বের করলো।
তাকিয়ার ইলিশ মাছ খুব পছন্দ সে সাথে লাউ তরকারি , সে আগে এতো একটা পছন্দ করে খেতোনা। কিন্তু যখন থেকে শুনেছে রাসুল সাঃ লাউ খুব পছন্দ করে খেতেন। তখন থেকেই জিনিস টি তার পছন্দের তালিকায় যুক্ত হয়ে গিয়েছে।সে এক এক করে সবজি গুলো কেটে নিচ্ছে। অমনি তার মা এসে জানালো। আজকে রান্না করতে হবে না। হোটেল থেকে খাবার আনা হবে।
তাকিয়া মায়ের কথার অবাধ্য হলো না।
সবজি গুলো ফ্রিজে রেখে দিলো।
রেবেকা যাওয়ার সময় আবারো ঘুরে দাড়ালো।
তাকিয়ার চোখে মুখে প্রশ্নবোধক ভঙ্গি বিদ্যমান,বেশিক্ষণ তাকে অপেক্ষা করতে হলোনা,রেবেকা ভণিতা ছাড়াই বললো। আমি এখন বাহিরে বের হচ্ছি।বাড়ি থেকে বের হবেনা।রাতে এসে জরুরি আলাপ আছে।
“কার সাথে?
“তোমার সাথে।
” কি বিষয়ে বলা যাবে?
“বলা গেলেতো আগেই বলতাম।
তাকিয়া আর কথা বাড়ালোনা।সামনে তার পরীক্ষা প্রচুর পড়াশোনা করতে হবে।সে তার পায়ের গতিবেগ তার রুমের দিকে করলো।জানালা থেকে পর্দা সরিয়ে দিলো। বাহিরে বাতাসের উপদ্রব প্রচুর,যেন বৃক্ষলতাপাতারা এক জোট হয়ে ভুলোকের সকলকে ব্যজন (বাতাস)করায় ব্যস্ত।
সেই সাথে উৎপতদের (পাখি) ধ্বন্যাত্মক তো আছেই।তাকিয়া জানালা বন্ধ করে দিলো।এত অবিরাম পরিবেশে ঘুমানো গেলেও পড়া হবেনা নিশ্চিত,অথচ তাকে পরীক্ষার জন্য ভালো মত প্রস্তুত হতে হবে।
____
সাদাতের মা পুরোনো আলমারি থেকে জিনিস পত্র নামাচ্ছেন। ধুলোয় পুরো ঘর ভরে গেছে। আলমারি টা অনেক আগের,বিয়ের পর তার শাশুড়ীমা তাকে এটি উপহার দিয়েছিলেন।কিন্তু পুরাতন হওয়ার দরুন কাঠের এই আলমারির এক পাশে গুনি পোকারা রাজত্ব চালাচ্ছে।হেনা বেগম জিনিস পত্র গুলো ঝার দিয়ে খাটে গুছিয়ে রাখছেন। তিনি খুব সযত্নে আলমারি থেকে জিনিস গুলো নামাচ্ছেন।সহসা তিনি অনুভব করলেন,কেউ যেন তার মাথায় একটি ফুলের মালা গুজে দিচ্ছে।হেনা ঘুরে তাকালেননা এবং মানুষ টিকে দেখারও প্রয়োজন বোধ করলেনা।তিনি বুঝতে পারলেন এটা কে? মায়েরা নাকি এমনি হয়। সন্তানের শরিরের গন্ধ শুনেই উপস্থিতি টের পেয়ে যায়।
হেনা কাজের প্রতি মনোযোগ রেখেই বললেন, কি হয়েছে আজকে আবার নতুন কোন আবদার আছে নাকি।সাদাত পিছন থেকে এসে মায়ের সামনা সামনি দাড়ালো এবং বললো।
“তুমি সবসময় মনের কথা কিভাবে বুঝো?
” আমার সন্তানের মনের কথা আমি বুঝবো না তো কে বুঝবে? এখন বলে ফেল, কি চাচ্ছো?
“সাদাত অনেকটা করুনার স্বরে বললো।
মা আমি লক্ষিপুর যেতে চাই।
” তুমি পাগল হয়েছো? সেখানে তোমার বাবার সাথে কি অসম্মান করা হয়েছে তুমি কি ভুলে গেছো?
“মা, বাবাকে তার বিজনেস পার্টনাররা ঠকিয়েছে। এখানেতো পুরো গ্রামের কোন দোষ নেই।
” সে যাই হোক তুমি যাবেনা সেখানে।আর সেখানে কেন যেতে চাও?
“মা এই চেয়ার টা তে বসো।আমরা বসে কথা বলি?
” আমার অনেক কাজ আছে। বাবা বিরক্ত করিস না, যা এখান থেকে।
“মা শোনো না। আমি বন্ধুদের সাথে যাবো,কাল সকালে যাবো বিকেলেই চলে আসবো।রাজী হয়ে যাও মা, প্লিজ।
“না আমি কখনো তোমাকে অনুমতি দিব না।এবং তোমার বাবাকেও নিষেধ করবো।
” মা নাও, আরেকটি ফুল নাও, তবুও যেতে দাও।
হেনা হাসলেন, খুব জোরেই হাসলেন,কিছুক্ষণ পরেই নিজেকে স্বাভাবিক করে বললেন। অনুমতি দিতে পারি এক শর্তে।
“কি শর্ত বলো।
” তুমি সেখানে বেশি দিন থাকবেনা।
“আচ্ছা ঠিকাছে। খুব খুশি হয়েছি মা। আমি এখন তোমাকে একটু কাজে সাহায্য করি।
” না তোমার করতে হবে না।তুমি কাজ করার বদলে আমার কাজ আরো বাড়াবে।
“আচ্ছা আমি যাচ্ছি।
সাদাত রুমে আসলো,তার বন্ধুদের ফোন দিয়ে প্রস্তুত হতে বললো।সকাল হলেই তারা রওনা হয়ে যাবে লক্ষিপুরের উদ্দেশ্যে।
______
তাকিয়া মাগরিবের নামায, আমল সেরে নিয়েছে। তার মা কিছু একটা বলবে বলেছিলো, সে সেদিকেই যাচ্ছে,কিন্তু মায়ের রুমে প্রবেশ করতে পারলোনা। আনিকা মেইন গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তাকিয়াকে ডাকছে।
” তাকিয়া দরজা খোল।
“হ্যাঁ আসছি অপেক্ষা কর।
” আনিকার একটা বাজে অভ্যাস আছে গেট না খোলা অবধি সে চিল্লাতে থাকবে। তাকিয়া ভালোই অবগত আছে তার বান্ধবীর সম্পর্কে। সে আনিকার কন্ঠ শুনেই দৌড় লাগালো।দরজা খুলেই অন্যদিনের মত বললো।তোর অভ্যাস কি জীবনেও ঠিক হবেনা?
” আরে পরে রাগ করিস শোন আজ আমি খুব খুশি।
” কেন এতো খুশি কেন।কি হয়েছে বলতো?
“তোকে আমি বলেছিলাম না আমার খালাতো ভাইয়ের চাচাতো ভাই আমার দাদুকে ওই দিন হাসপাতালে নিয়ে গিয়েছিলো।
” হে বলেছিলি তো। সেই সাথে এটাও বলেছিলি।তোর খুব ভালো লেগেছিলো মানুষটিকে। তোর থেকে ১১ হাত লম্বা। আমি বুঝিনা! তুই দূর থেকে দাঁড়িয়ে হাইট ও মাপতে পারিস?
“ধুর তুই সেদিনের কথা নিয়ে এখন ফাইজলামি করছিস?
” না ফাইজলামি করবো কেন।আমি তোর অনুভবশক্তির প্রশংসা করছিলাম আরকি।
“বাদ দেতো এসব, শোন একটা মজার কথা?
“এখানেই দাঁড়িয়ে বলবি রুমে চল?
” তোর মা আছে?
“হু।
” তাহলে যাবোনা।
“আচ্ছা তোর মরজি,বল এবার কি বলতে চাচ্ছিলি।
“আনিকা মাথা নত করে বললো। ওই মানুষটি আমার দাদির কাছে প্রস্তাব পাঠিয়েছে।
” সত্যি? এটা তো খুশির কথা।তুই কি অনেক খুশি?
“হু অনেক।
“দেখতে আসার ব্যপারে কিছু বলেছে?
“আরে না সবে মাত্র প্রস্তাব দিয়েছে।আর দাদি হে বলেছে।আমি খবরটি শুনেই তোর কাছে ছুটে আসলাম।
” বিয়েটা হলে ভালোই হবে।তবে তোর থেকে ১১ হাত লম্বা এটা নিয়ে ভাবিস না।বলিস হাটু থেকে কেটে ফেলে দিতে।
“তুই সেদিনের কথা নিয়ে এখনো পড়ে আছিস।আমি ওইদিন এটা বলেছিলাম কারন উনি অনেক লম্বা তাই দুষ্টুমি করে বলেছিলাম আমার থেকে ১১ হাত বেশি লম্বা।
” আরে আমিওতো এটাই বলছি।
“দুষ্টুমি করতে থাকবি নাকি চলে যাবো?
” আরে যাসনা আমি মজা করছি।
দুজনের মুখেই হাসি।তবে ক্ষীণ আওয়াজে না,জোর আওয়াজে।উঠোনের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আছে তারা।রাত হওয়ায় হাসির আওয়াজ রেবেকার কান অবধি পৌঁছে গেলো।
রেবেকা সেদিকেই আসলো,বাড়ির প্রধান চৌকাঠে দাঁড়িয়ে বললো।আনিকা তোমাকে বলেছিলাম যখন তখন এই বাড়িতে আসবেনা।তুমি শুনতে পাওনি?
” আনিকা কিছুক্ষণ চুপ থেকে বললো
দুঃখিত আন্টি ভুল হয়ে গিয়েছে। চলে যাচ্ছি।
আনিকা কথা বাড়ালোনা।কিন্তু সে তাকিয়ার কর্ণের কাছে মুখ এনে বললো,ইচ্ছে করছে কিছু একটা বলি কিন্তু তোর কথা ভেবে আর বাকবিতন্ডায় জড়ালামনা।আনিকা চলে গেলো।সে রেবেকা কে ভালো করেই চিনে।আনিকার রাগ তিনি তাকিয়ার সাথে মিটাবেন।তাই আনিকা নিশ্চুপ ছিলো।আনিকা চলে যাওয়ার পর রেবেকা তাকিয়াকে বললো।
“তোমার সাথে কিছু কথা আছে।
” জী।
” শোনো কাল আমরা এখান থেকে রওনা হবো।
“রওনা হবো মানে কোথায় যাবো?
” ঢাকা,আমরা এখন থেকে সেখানেই থাকবো।
“কিন্তু মা।
” কোন কিন্তু না।
“আমার পরীক্ষা কয়দিন পর।
” আমি তোমাকে ঢাকা ভর্তি করে দিবো।এখন যাও ঘুমাতে যাও।
তাকিয়ার প্রচন্ড মন খারাপ হলো,অন্যদিনের মত আজও কিছু বলার অধিকার নেই তার।আর বললেও কোনো লাভ নেই।রেবেকা কখনোই তার কোনো সিদ্ধান্তকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করেনি।কিন্তু একবার জানালেওতো পারতো।অথচ রেবেকা এসবেরও প্রয়োজন মনে করলোনা।কাওকে কিছু না বলেই সে এখান থেকে চলে যাবে এটা ভেবেই তার মন ভিষণ কষ্ট পাচ্ছে।কিন্তু সে নিজেকে এ বলে শান্ত করলো,আল্লাহ যা করবেন ভালোর জন্যই করবেন।
____
পরদিন সকাল সকাল সাদাত বেরিয়ে পড়লো।
রাফিয়া বিষয়টি বেলকনি দিয়ে পর্যাবেক্ষন করলো।তার ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত,হয়তো বুঝার চেষ্টা করছে সাদাত কোথায় যাচ্ছে।সে নিজের ব্রেনের উপর জোর খাটালোনা।কারণ সে খুব সহজ উপায়ে এ প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবে।সে উপরে চলে গেলো। হেনা তাকে দেখে অবাক হলেননা।তিনি তার সামনে চায়ের কাপ এগিয়ে দিলেন।রাফিয়া চায়ে ফুক দিলো এবং কথার ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলো।আন্টি ভাইয়া এতো সকাল সকাল কোথায় যাচ্ছে?
“তোমাদের গ্রামে।
” সেখানে কেন।
“ওর ছোট বেলার একজন বন্ধু ছিলো তাকেই দেখতে যাচ্ছে হয়তো?
” ওহ, মেয়ে বন্ধু না ছেলে বন্ধু?
“মেয়ে।
রাফিয়ার হাতে থাকা চায়ের কাপ থেকে এখনো গরম ধোঁয়া উড়ছে ।সে ফুঁকে ফুঁকে তা শেষ করার বৃথা চেষ্টা করছে,মনে হচ্ছে যেন শরবত খাচ্ছে।কারণ এখন যা শুনেছে তা শুনার পর এখানে থাকার মত শক্তি তার নেই।তার বুকে সূক্ষ্ম যন্ত্রণা হচ্ছে।এখন শুধু রুমে প্রবেশ করে কপাট লাগাতে পারলেই হলো।সাদাত কে সে অনেক দিন যাবত দেখে আসছে। কখনো সে তাকে পাত্তা দেইনি।এমন কি অন্য সব মেয়েদের ক্ষেত্রেও সাদাতের কোন দুর্বলতা দেখেনি।সাদাত মেয়েদের দেখলেই মাথা নত করে ফেলতো।অথচ সে নাকি তার ছোট বেলার এক বন্ধুর সাথে দেখা করতে যাচ্ছে? কে সেই মেয়ে যাকে সে এখনও মনে রেখেছে?না আর ভাবতে পারছেনা রাফিয়া।সে বিছানায় শুয়ে পড়লো এবং বালিশ দিয়ে তার মাথা চেপে ধরলো।
আসছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *