( কঠোরভাবে প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
অনিমা কিছুটা শান্ত হয়েছে। বিষয়টা বুঝতে সময় লাগলেও এখন বুঝে গেছে আয়ান তার সাথে খারাপ কিছু করতোনা। নিজেকে সামলে নিয়ে আয়ানের দিকে তাকাল অনিমা। ক্ষীণ স্বরে নিজের ভুল বুঝতে পেরে বললো,
” আমি বুঝতে পারিনি আয়ান। আর কখনো ওরকম করবোনা। এভাবে রাতে ঘরে আসার জন্য জোরাজোরিও করবো না।”
আয়ান আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো অনিমার ললাটে। হেসে বললো,
” তুমি দুষ্টমি না করলে আমার ভালো লাগবে না। তবে নিজেকে সামলে চলবে,যাতে আমার নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে কষ্ট না হয়। আচ্ছা ভয় পেয়েছো খুব? “
” হুম। “
” কষ্ট পেয়েছো?”
” না।”
” কী করলে ভয় কমবে? “
” জড়িয়ে থাকো দুমিনিট। “
অনিমার কথায় জোরে হেসে উঠলো আয়ান। যার স্পর্শে ভয় পেয়েছে আবার তাকেই বুকে জড়াতে চাইছে।
” ভয় লাগবে না?”
” উঁহু। বুকে না জরালে মনটা শান্ত হবে কীভাবে? জানো না ব্যথা যে দেয় আমরা তার বুকে মাথা রেখেই অশ্রু বিসর্জন দিতে পছন্দ করি?”
আয়ান আলগোছে জড়িয়ে নিলো অনিমাকে। পিঠে হাত বুলিয়ে দিলো একবার।
” বাব্বাহ! একেবারে বড়োদের মতো কথা বললে!”
” আমি কি ছোটো আছি? কলেজে ভর্তি হবো ক’দিন বাদেই। “
” ওওও। কলেজে ভর্তি হলে যে বড়ো হয় আগে জানা ছিলো না। “
হঠাৎ দরজায় ঠকঠক আওয়াজে লাফিয়ে উঠল অনিমা। চোখের পলকে আয়ানের কোল থেকে নেমে দাঁড়াল। দরজার বাইরে ওর বাবা ডাকাডাকি করছেন। আয়ানও ঘাবড়ে গেছে।
” অনিমা? কার সাথে কথা বলছো? ভেতরে কে হাসছে?”
গুরুগম্ভীর কন্ঠে ডেকে যাচ্ছে অনিমার বাবা। আয়ান ঘামছে রিতীমত! অনিমাও চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। কী করবে বুঝতে পারছে না কেউ। কিন্তু এভাবে চুপ করে থাকলে ঝামেলা বাড়বে বলে কমবে না।
” অনিমা! আমি স্পষ্ট শুনেছি ভেতর থেকে কোনো ছেলের হাসির শব্দ আসছিল। তাই অহেতুক দেরি না করে দরজা খুলে দিলেই ভালো হয়।”
অনিমা ও আয়ান বুঝতে পারছে আজকে মহাপ্রলয় হবে। কীভাবে সামলাবে সেসব আয়ান?
ঘড়িতে সময় রাত তিনটে বেজে পনেরো মিনিট। বিছানার মাঝখানে বসে আছে তৃষা। হঠাৎ করে ঘুম ভেঙে গেছে। অনিক পাশের ঘরে ঘুমায় এখন। দিনে দিনে সম্পর্কে দূরত্ব বেড়েছে। একটা সময় সবকিছু এতটাই অসহ্য লাগছিল তৃষার,যে স্বামী-স্ত্রী’র সম্পর্ক থেকে দূরে সরে এসেছে সে। শুধু বাইরের লোকজনের সামনে ওরা নিজেদের সাথে কথা বলে। এমনিতে কেউ কারো সাথে কথা বলে না। তবে অনিক আগের মতো তৃষার কাছাকাছি আসতে চায় না এখন। বিষয়টা নিয়ে তৃষা মাঝে মধ্যে ভাবে কিন্তু তেমন সিরিয়াস ভাবেও না। বিছানা থেকে নেমে ধীর পায়ে এগিয়ে গিয়ে দরজা খুললো তৃষা। আজকে হঠাৎ অনিকের জন্য ভীষণ মায়া হচ্ছে তার। যাইহোক, মানুষটা তো ভালোবাসা হারিয়ে ফেলার ভয়েই এমন আচরণ করে। তৃষা অনিকের ঘরের সামনে গিয়ে দেখে দরজা খোলা আছে। তবে রুম অন্ধকার! ফোনের ফ্ল্যাশ লাইট জ্বালিয়ে ঘরে ঢুকল তৃষা। বেচারা তৃষার ওড়না বুকের উপর রেখে ঘুমোচ্ছে। তৃষার দু-চোখ ছলছল করে উঠলো। কী করবে সে? একবার তো চায় সবকিছু মানিয়ে নিয়ে থাকবে কিন্তু অনিকের পাগলামি শেষ পর্যন্ত আর সহ্য করতে পারে না। আবার একেবারে ছেড়ে দিতেও তো পারছে না তৃষা। তৃষা ফোনটা বালিশের পাশে রাখল। এখন ঘরে অল্পস্বল্প আলো দেখা যাচ্ছে। সেন্ডো গেঞ্জি পরা অনিক,পরনে লুঙ্গি। মাথার উপর সিলিং ফ্যান ঘুরছে অবিরত। তৃষা কী মনে করে হঠাৎ অনিকের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। তারপর নাকের ডগায় তারপর গালে। পরিশেষে অধর কোণে ছোঁয়াল ওষ্ঠ। অনিকের ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ মেলে তাকাতেই এভাবে তৃষাকে কাছাকাছি দেখে চমকাল সে। কিন্তু কিছু বললো না। নিষ্ক্রিয় হয়ে শুয়ে রইলো। তৃষার কেমন ঘোরের মতো লাগছে। দীর্ঘদিন প্রিয়তমকে কাছাকাছি পায়নি সে। তাই আজ না চাইতেও মন অন্য কিছু চাইছে। অনিক ভালো করে তাকিয়ে বুঝতে চেষ্টা করছে তৃষার মতিগতি কী! তৃষা নিজের ওড়না খুলে বিছানার এক পাশে রাখল। তারপর অনিকের পাশে শুয়ে পড়লো। অনিকের ইচ্ছে করছে স্ত্রীকে আলিঙ্গন করতে। কিন্তু তার চেয়ে ভয় হচ্ছে দ্বিগুন। যদি আবারও রেগে গিয়ে কিছু বলে তৃষা? কিংবা বিরক্ত হয়! নাহ এই ভেবে নিজের মনকে শান্ত করার চেষ্টা করলো অনিক। তৃষা অনিকের বুকের উপর হাত রেখে চুপ করে শুয়ে রইলো। অনিকও চুপ করে আছে।
” কী হয়েছে তৃষা? কিছু লাগবে? “
অনিকের সহজসরল প্রশ্নে হকচকিয়ে গেল তৃষা। লোকটার কথা শুনে তো মনে হচ্ছে না এখন তার সমস্যা আছে কোনো। অথচ একটু বাইরের কেউ এলেই শুরু করে পাগলামি। তৃষা সেসব ভুলে মাথা নেড়ে বললো,
” হুম। “
” কী? আমাকে না-কি অন্য কিছু? “
” আপনার কাছে যখন এসেছি তখন আপনাকেই লাগবে। “
” সহ্য করতে পারবে পাগলামি? “
” এভাবে বলবেন না। আমার ইতস্তত লাগে ভীষণ। “
অনিক উত্তর পেয়ে গেছে। তৃষাকে আষ্টেপৃষ্টে নিজের সাথে মিশিয়ে নিলো সে। বন্ধুর সহযোগিতা নিয়ে ভালো ডাক্তার দেখিয়ে বেশ কিছুদিন যাবৎ ঔষধ সেবন করছে অনিক। এবার সে নিজে থেকেই চাচ্ছে সুস্থ হতে। কারণ এই অসুস্থতা নিয়ে তার পক্ষে তৃষাকে আঁটকে রাখা সম্ভব নয়। অতীতের প্রভাব বর্তমানে ফেলে সবকিছু নষ্ট করতে চায় না অনিক।
ভোর হতেই মায়ের নম্বর থেকে কল আসায় বুকটা ধুকধুক করতে শুরু করেছে তাহমির। ফোন হাতে নিয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছে মেয়েটা। সহন আলতো করে তাহমিকে ধাক্কা দিয়ে বললো,
” কল রিসিভ করছিস না কেন? হয় কথা বল নয়তো সাইলেন্ট করে রাখ। ঘুমোতে দে একটু, রাতেও ঘুমাতে দিসনি।”
সহনের কথায় মেজাজ বিগড়ে গেলো তাহমির। পিঠে এক কিল বসিয়ে দিলো সে।
” অসভ্য একটা তুই। মনে হচ্ছে আমি জোর করে তোকে ঘুমাতে না করেছিলাম। আম্মা কল দিছে। কথা বলে নিচ্ছি।”
সহন তাহমিকে ছেড়ে অন্য দিকে ফিরে শুয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে। তাহমি কল রিসিভ করে ফোন কানের কাছে ধরে বললো,
” আসসালামু আলাইকুম মা। কী খবর তোমাদের? “
” ওয়া আলাইকুম আসসালাম। খবর ভালো নাকি খারাপ আমি নিজেও বুঝতে পারছি না। তোর আদরের ভাই যা করছে তাতে শান্তিতে আর থাকতে পারছি কোথায়! তার উপর তৃষার জন্য তো চিন্তা আছেই!”
তাহমি মায়ের কন্ঠে স্পষ্ট অভিযোগ শুনতে পাচ্ছে। কী করলো আয়ান?
” কেনে মা? আয়ান কী করেছে? “
” কী করেছে আমি নিজেও জানি না। মিনিট দশেক আগে ওর ছাত্রীর বাবা কল দিয়েছিলেন। বললো উনাদের বাসায় যাতে এখুনি আমি এবং তোর বাবা যাই। আয়ান না-কি সারা রাত উনাদের বাসায় ছিলো। মানসম্মান কিছু থাকলো না তাহমি।”
তাহমি অবাক হলো কিছুটা। তার ভাই তো এমন নয় যে রাত কাটাবে মেয়েদের সাথে! তা-ও নিজের ছাত্রীর সাথে? ভালোবাসা কিংবা ভালোলাগা থাকলেও তো তৃষা অথবা তাকে কিছু জানাতো। না-কি ছেলেটাকে ওরা ফাঁসিয়ে দিলো কেউ?
” মা তুমি শান্ত হও একটু। আব্বুকেও শান্ত থাকতে বলো। বিপদের সময় মাথা ঠান্ডা রাখতে হয়।”
” আমরা যাচ্ছি। পরিস্থিতি কেমন জানি না কিছু। তেমন হলে সহনকে পাঠাতে হবে। আমরা কী করবো! শুনেছি ভদ্রলোক অনেক বড়োলোক। যদি আয়ানের ক্যারিয়ার শেষ করে দেন?”
” মা! এসব নেগেটিভ দিকগুলো জাস্ট ভুলে যাও। কিছু হবে না। ঠিকানা টেক্সট করে দাও,আমরা একটু পর আসছি ওখানে। “
” ঠিক আছে তাহমি। রাখছি।
পর্ব ৩৬
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
শেখ বাড়ির ড্রইং রুমে বসে আছে আয়ানের বাবা-মা ও বোন তাহমি। তাহমির স্বামী আয়ানের পাশে দাঁড়িয়ে আছে ঘরের উত্তর কোণে। অনিমা নিজের ঘরে আছে। এতগুলো মানুষের সামনে আসার মতো মুখ তার নেই। বদ্ধ ঘরে যেমনই থাকুক দু’জন, বাইরের লোকজন কখনো এটা বিশ্বাস করবে না তারা কোনো অন্যায় করেনি। সত্তার শেখ আয়ানের সামনে এসে দাঁড়িয়ে একবার দৃষ্টিপাত করলো তার দিকে। তারপর তাহমির বাবা-মায়ের সামনাসামনি সোফায় বসলেন । আয়ান চুপচাপ ফ্লোরের দিকে তাকিয়ে আছে। বাবা-মায়ের সামনে এভাবে দাঁড়াতে হবে ভুলেও কখনো ভাবেনি। লজ্জায় মাটিতে মিইয়ে যেতে ইচ্ছে করছে আয়ানের।
” ঘটনা কী সেটা আশা করি আপনারাও বুঝতে পারছেন এবং আমিও বুঝতে পারছি। কিন্তু বুঝতে একটু দেরি করে ফেলেছি আমি। আমার বোঝা উচিত ছিল। “
অনিমার বাবার স্পষ্ট কথায় আয়ানের বাবা-মা নড়েচড়ে বসলেন। আয়ানের বাবা বললেন,
” আমরা ভীষণ লজ্জিত। আসলে আমরাই আমাদের ছেলেকে ঠিকমতো শিক্ষা দিতে পারিনি। পারলে মাঝরাতে অন্য মেয়ের ঘরে এভাবে আসতে পারতো না।”
বাবার মুখে এরকম কথা শুনে ভীষণ কষ্ট হচ্ছে আয়ানের৷ সহন আয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে ভরসা দেওয়ার চেষ্টা করছে। তাহমি নিশ্চুপ, এখানে তার বলাট মতো কিছু নেই। সত্তার শেখ একটু ভেবে নিলেন তারপর বললেন,
” তাহলে বলতে চাচ্ছেন আমারও শিক্ষার অভাব ছিলো? “
অনিমার বাবার কথার মানে কেউ বুঝতে পারলো না। ইতস্ততভাবে আমেনা ইসলাম বলেন,
” না ভাইজান,আপনার বুঝতে ভুল হচ্ছে। আয়ানের কথা বললেন উনি।”
” সেটা আমি বুঝতে পেরেছি। আমি বললাম আমার কথা। আয়ানের মতো বয়সে তো আমিও এরকম ঘটনা ঘটাতাম। অনিমার মায়ের সাথে দেখা করতে বাড়ির পেছনে আসতে বলতাম রাতে। সেজন্যই বললাম আমারও তাহলে শিক্ষার অভাব ছিলো আরকি।”
ভদ্রলোকের কথায় হকচকিয়ে গেল সবাই। কেবল সহন মিটমিট করে হাসছে। আয়ানের কানের কাছে গিয়ে ফিসফিস করে বললো,
” শালাবাবু ভয় পেও না। ঘটনা ঘটে যাবে।”
আয়ান সন্দিহান সে বিষয়। ভদ্রলোকের মতিগতি বোঝা দ্বায়। গতকাল রাত থেকে একেবারে গুরু গম্ভীর হয়ে ছিলেন। একটা কথাও বলেননি। অনিমাকে শুধু নিজের ঘরে থাকতে বলেছিলেন আর আয়ান ছিলো গেস্ট রুমে।
” আসলে আপনার কথার মানে বুঝতে পারছি না মিস্টার শেখ।”
” আমার মেয়ে বয়সে ছোটো। প্রেম করার বয়স হলেও বিয়ে করে সংসার সামলানোর দায়িত্ব সে নিতে পারবে না হয়তো। সেজন্য আপাতত বিয়েটা স্থগিত রাখলাম। অনিমা এইচএসসি পরীক্ষাটা দিক তারপর না হয় আমরা ওদের বিয়েটা দিয়ে দিবো। আয়ানকে অনেক আগে থেকেই দেখছি তো, ছেলেটা আমার পছন্দের। “
ড্রইং রুমে উপস্থিত সবাই চমকাল অনিমার বাবার কথায়। আয়ান অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার বাবার দিকে। তিনি মুচকি হাসছেন আয়ানের দিকে তাকিয়েই। সবাই একসাথে হেসে উঠলো এবার। এতক্ষণে যেনো সবাই প্রাণ ফিরে পেয়েছে। আয়ানের বাবা অনিমার বাবার সামনে এসে হাত ধরে বলেন,
” আপনার মতো মানুষ খুব কম দেখেছি ভাই। এতো প্রতিপত্তি থাকা স্বত্বেও আমাদের মতো মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেকে মেনে নিলেন অনায়াসে! “
” মানুষটা কেমন সেটা মূখ্য বিষয় ভাই। স্টাটাস দেখে আমি মানুষ বিচার করি না। আজ যা-ই থাকুক আমার, একটা সময় আমিও বেকার ছিলাম। মানুষ চেষ্টা ও কঠোর পরিশ্রম করলে অবশ্যই উন্নতি লাভ করবে। তাছাড়া আমার মেয়ে যাকে ভালোবাসে আমিও তাকে ভালোবাসব। আমার মেয়ে আমার পৃথিবী। আমি শুধু চাইবো অনিমা সুখী হোক। আপনাদের কাছে শুধু এটুকুই চাওয়া। “
অনিমা ও আয়ানের বাবা দু’জন একে অন্যকে জড়িয়ে ধরলেন খুশিতে। এদিকে সহনও জড়িয়ে ধরলো আয়ানকে।
” শালাবাবু হেহে ঘটনা ঘটে গেলো কিন্তু! “
আয়ান হাসছে সহনের কথায়। অন্য দিকে অনিমা বেচারি ঘরে বসে আছে ভয় ভয়। বাইরে বেরোতে সাহস পাচ্ছে না। আয়ানের পরিবারের লোকজনের সামনে কীভাবে যাবে? অনিমার ভাবনার ছেদ ঘটে দরজা খোলার ক্যাচ ক্যাচ আওয়াজে। দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করতে দেখল পঁচিশ কিংবা ছাব্বিশ বছর বয়সী এক সুন্দরী নারী দাঁড়িয়ে আছে তার দিকে তাকিয়ে। অপরিচিতা কাউকে নিজের ঘরে দেখে স্বাভাবিকভাবেই কৌতূহলী হয়ে গেলো অনিমা। ততক্ষণে তাহমি ঘরের মধ্যে ঢুকে বিছানায় অনিমার পাশেই বসলো।
” আপনি কে? মানে আমার ঘরে কীভাবে এলেন?”
অনিমার প্রশ্নে তাহমি মৃদু হেসে বললো,
” আমি তোমার বড়ো ননদী। আয়ান আমার ভাই। “
চমকাল অনিমা। নড়েচড়ে উঠলো একটু। বোকা বোকা হেসে বললো,
” আপু বাবা যদি আপনাদের কিছু বলে থাকেন তার জন্য আমি দুঃখিত। আপনার ভাইয়ের কোনো দোষ নেই। “
” চাপ নিও না। সবকিছু ঠিক হয়ে গেছে। ভালো করে এইচএসসি পরীক্ষাটা দাও তারপর আমাদের বাড়ি বউ করে নিয়ে যাবো। কিন্তু হ্যাঁ এই রাতে ঘরে বসে প্রেম করা বন্ধ করবে ঠিক আছে? এখন তো লুকোচুরির কিছু নেই। দিনের বেলাতেই না হয় বাইরে বেরিয়ে প্রেম করবে। “
তাহমি হেসে হেসে বললো। অনিমা একটু লজ্জা পেলো বটে। ইশ রাতে ঘরে আসাটাকে সবাই কীভাবে নিলো! আয়ান ঠিক বলতো। কেনো যে জোরাজোরি করে মানুষটাকে আসতে বলতো। তবে আয়ানের বোন কী বললো? সত্যি ওদের বিয়ে হবে? বাবা সব মেনে নিয়েছে?
” আপু বাবা কী এসব বলেছেন? “
” হ্যাঁ। উনার কোনো আপত্তি নেই তোমাদের বিয়েতে।”
অনিমা এতক্ষণে যেনো নিঃশ্বাস ফেললো। রাত থেকে মনে হচ্ছিল দম আঁটকে যাবে। তাহমি অনিমার মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে বিদায় সম্ভাষণ জানিয়ে বেরিয়ে গেলো ঘর থেকে। তাহমি বের হতেই বিছানার উপর উঠে উড়া ধুরা নাচতে লাগলো মেয়েটা৷ গান ছাড়াই সেই ভয়ংকর নাচ দেখার মতোই হচ্ছিল!
ভাইয়ের বিষয় সবকিছুই ফোনে বড়ো বোনের কাছ থেকে শুনেছে তৃষা। বেশ শান্তি লাগছে। সবকিছু ভালো ভালো হলেই শান্তি। অনিমা কলেজে ভর্তি হয়েছে। লেখাপড়ার দিকেও মনোযোগী হয়েছে মেয়েটা। আয়ানের কড়া নির্দেশ, পরীক্ষায় ভালো রেজাল্ট করা চাই। সবাই যাতে এটা না বলতে পারে, প্রেম করতে গিয়ে রেজাল্ট খারাপ হয়েছে। সেই মতো লেখাপড়া করছে অনিমা।
ভরসন্ধ্যা বেলা। রান্নাঘরে চা তৈরি করছে তাহমি। চুলোয় পানি বসিয়েছে চায়ের। পানি ফুটছে। হাতে চাপাতি নিয়ে অপেক্ষা করছে তাহমি। সহন ডাইনিং টেবিলে বসে একটু পর পর নজর রাখছে স্ত্রী’র দিকে। রান্নাঘরে ঢুকলেই সহনের মনে কেমন একটা ভয় কাজ করে। তাই যখন নিজে বাড়িতে না থাকে মা’কে বলে যায় খেয়াল রাখতে। ফোনের দিকে তাকিয়ে একটা নিউজ দেখছে সহন। তার ফাঁকে ফাঁকেই তাহমির দিকে দৃষ্টিপাত করছে। তাহমি বলেছে রাতে একটা নিউজ দিবে। কী নিউজ সেটা জানতে চাইলে বললো গুড নিউজ। সহন এসব ভেবে একটু বেখেয়ালি হয়ে গেল। হঠাৎ রান্নাঘর থেকে ধুপধাপ শব্দ ভেসে আসতেই সহন চমকে উঠে। রান্নাঘরের দিকে দৃষ্টিপাত করতে দেখে তাহমি ফ্লোরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। চাপাতি সব জায়গায় ছড়িয়ে গেছে। দৌড়ে রান্নাঘরে গেলো সহন। তাহমি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে।
” মা! মা! এদিকে এসো। তাহমি সেন্সলেস হয়ে গেছে।”
সহনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে জায়নামাজ থেকে উঠে দাঁড়ালেন ফরিদা। মাগরিবের নামাজ শেষে জিকির করছিলেন তিনি। তসবিহ ও জায়নামাজ জায়গামতো রেখে একপ্রকার ছুটে রান্নাঘরের দিকে এগোতে লাগলেন তিনি। সহন তাহমিকে কোলে তুলে নিয়েছে ততক্ষণে। ফরিদা খান গ্যাসের চুলো বন্ধ করে দিলেন।
” কী হয়েছে? তাহমির কী হয়েছে সহন? হঠাৎ জ্ঞান হারালো কেনো?”
” মনে হয় আগুন থেকে এমন হয়েছে। ডাক্তার বলেছিল না ওর মনে আগুনের প্রতি চাপা একটা ভয় কাজ করছে। “
সহন কোলে নিয়ে বেডরুমে নিয়ে গেলো তাহমিকে। ফরিদাও ছেলের পেছন পেছন এসেছেন। সহন বিছানায় শুইয়ে দিলো তাহমিকে। টেবিলের উপর থেকে গ্লাস নিয়ে হাতে পানি ঢেলে তাহমির চোখমুখে ছিটিয়ে দিচ্ছেন সহনের মা। সহন মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। চোখমুখ কেমন শুকনো শুকনো লাগছে মেয়েটার।
” সহন ওর তো জ্ঞান ফিরছে না। তুই বরং ডাক্তার ডাক। “
” আমি ডাক্তার আঙ্কেলকে ইমার্জেন্সি বলে টেক্সট করেছি আসতে। পানি দিলে তো একটু অপেক্ষা করো জ্ঞান ফিরবে।”
” আমারই ভুল! আমার উচিত তাহমিকে রান্নাঘরের কোনো কাজই না করতে দেওয়া। “
ফরিদা খান নিজেকে অপরাধী ভাবছেন। সহন মাকে স্বান্তনা দিতে বলে,
” মা তাহমি তো কারো কথা শোনে না৷ তোমার কোনো দোষ নেই। ডাক্তার আসছে তো, সব ঠিক হয়ে যাবে। “
পর্ব ৩৭
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
বেশ কিছুক্ষণ হলো তাহমির জ্ঞান ফিরেছে। এরমধ্যে ডাক্তারও এসে গেছে। ডাক্তার ফারুক আহমেদ সহনদের পূর্ব পরিচিত। মধ্যবয়স্ক ফারুক আহমেদ দেখতে লম্বাচওড়া, চুলগুলো হালকা সোনালী রঙের। সহনকে ছোটো থেকে উনি দেখেছেন। তাহমি দূর্বল কন্ঠে বারবার সহনকে বলছিল ডাক্তার লাগবে না। কিন্তু শাশুড়ী এবং স্বামী কেউ তাহমির কথায় পাত্তা দিলো না। অগত্যা চুপ করে রইলো তাহমি। ডাক্তার তাহমির প্রেশার মেপে দেখলেন। সাথে চোখ ও জিহ্বা দেখলেন একবার। সহন দাঁড়িয়ে আছে ঘরের একপাশে। ফরিদা তাহমির পাশে বসে আছেন।
” আপাতত যতটুকু বুঝতে পারছি উনার প্রেশার ভীষণ লো। আর খাওয়াদাওয়া ঠিকমতো হচ্ছে না ইদানীং। সেজন্য শরীর দূর্বল হয়ে গেছে। বাদবাকি যা বোঝার কিছু টেস্ট করতে দিলাম। সেগুলো করালে শিওর হয়ে বলতে পারবো। “
ডাক্তারের কথায় চোখমুখ ম্লান হয়ে গেছে সহনের। মেয়েটা কেনো যে এরকম অনিয়ম করে!
” আঙ্কেল সিরিয়াস কিছু আশংকা করছেন? “
সহন কিছুটা ভীতি প্রদর্শন করে বললো কথাটা। তাহমি ততক্ষণে কটমট করে সহনের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। কতক্ষণ ধরে চোখ টিপ্পনী দিচ্ছে কিন্তু সেদিকে হাঁদাটার খেয়ালই নেই!
” না। চিন্তার কিছু নেই। আমি আসছি সহন। আগামীকাল তুমি বরং হসপিটালে যেও তাহমিকে নিয়ে। “
” ঠিক আছে আঙ্কেল। চলুন এগিয়ে দিয়ে আসি। মা তুমি বসো ওর কাছে। “
” ঠিক আছে যা তুই। আমি আছি।”
সহন ডাক্তার ফারুক আহমেদকে নিয়ে রুমের বাইরে বেরিয়ে গেলো। রাতে ফরিদা খান নিজে বসে খাইয়ে দিলো তাহমিকে। ফলশ্রুতিতে আজকে পেট বেশি ভরে গেছে মনে হচ্ছে তাহমির। মায়েরা কখনো সন্তানদের কম খাওয়াতে পারেন না। তাহমিকে আজকে আর বিছানা ঠিক করতেও দেয়নি সহন। নিজে থেকে সবকিছু গুছিয়েছে। মশারী টানানো শেষ করে তাহমির পাশে এসে মাত্র শরীর এলিয়ে দিলো সহন। তাহমি সিলিং ফ্যানের দিকে তাকিয়ে আছে। গরম ভালোই ঝাঁকিয়ে বসেছে। সহন তাহমির মাথায় আলতো করে হাত বুলিয়ে দিতে লাগলো। তাহমি সহনের দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল। সহন ভড়কে গেছে কিছুটা। সে তো কিছু করলোনা, তাহলে এভাবে তাকিয়ে আছে কেনো তার বউ?
” তাহমি কিছু হয়েছে? আমি কী কিছু করেছি? কই না তো আজকে তো কিছু করিনি আমি।”
” চুপ কর। মাঝে মধ্যে এমন আহম্মকের মতো করিস কেন? তখন কতবার ইশারা করলাম! “
” আহাম্মক তো আগে ছিলাম না, বিয়ের পর হয়েছি। আর আমি তখন চিন্তিত ছিলাম তাই খেয়াল করিনি। “
” হুম বুঝলাম। একটা কথা শোন।”
তাহমি দৃষ্টি অন্য দিকে সরাল। সহন আগ্রহী হয়ে শুধালো, ” কী?”
” তোকে কেউ ডাকছে। “
” কে ডাকছে! “
অবাক হলো সহন। কারো আওয়াজ তো তার কানে আসছে না। তাহমি সহনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে ডান হাতের আঙুল উঁচিয়ে নিজের পেটের দিকে ইশারা করলো। সহন ঠিকমতো বিষয়টা বুঝতে না পারলেও শোয়া থেকে উঠে তাহমির পেটের কাছে গিয়ে বসলো।
” সে আসছে! আমাদের ঘরের নতুন অতিথি। “
সহনের কাছে এক মুহুর্তের জন্য সবকিছু থমকে গেলো। তাহমি অন্য দিকে তাকিয়ে হাসছে। সহন দ্রুত নিজের কান তাহমির তলপেটে ঠেকিয়ে উৎসাহী হয়ে প্রশ্ন করলো, ” এটা কি সত্যি তাহমি?”
তাহমি বললো, ” হ্যাঁ। “
সহন আলতো করে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো পেটের উপর। আবেগ নিয়ন্ত্রণ করতে না পেরে কোলে তুলে নিলো তাহমিকে। বিছানা থেকে নেমে তাহমিকে কোলে নিয়ে ঘরের এ মাথা থেকে ও মাথা হাঁটতে হাঁটতে বলতে লাগলো,
” কী খবর শোনালি তাহমি! আমি তো খুশিতে পাগল হয়ে যাবো। আমি বাবা হবো? সিরিয়াসলি! তুই আমার সন্তানের মা হবি? “
” যা পাগল হয়ে ছাগল হয়ে মাঠে ঘাস খা তুই। আর হ্যাঁ মজা করেছি। মিছিমিছি বাবা হবি তুই। “
তাহমি মুখ ভেংচি কেটে বললো। সহন হাসছে শুধু। আজকে আর কোনো কথাতেই ঝগড়া করবে না সে। এতো খুশি এক জীবনে সে হয়নি আর। বিছানায় খুব আস্তে করে বসাল তাহমিকে৷ তারপর নিজেও বসলো স্ত্রী’র পাশে। দু’হাতে দুহাত রাখল।
” তাহমি তুই নিজেও জানিস না তুই কী সুখ দিলি আমাকে। আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ উপহার আমার সন্তান। ইচ্ছে করছে তোকে মাথায় তুলে নাচি।”
” আসলেই সহন আমাদের বেবি হবে! মামুনি আর আব্বু শুনলে কতো খুশি হবে বল তো?”
” ভীষণ ভীষণ ভীষণ খুশি হবে। ইশ আমার তো আর তর সইছে না। কবে আসবে আমার ছোট্ট পাখিটা!”
তাহমিকে বুকে জড়িয়ে নিলো সহন। তাহমিও সহনকে আঁকড়ে ধরে আছে দু’হাতে।
” অপেক্ষা কর। দেখবি মাসগুলো দেখতে দেখতে যাবে। “
” ইশ অপেক্ষা এতো তিক্ত কেনো? তবে এই মধুর অপেক্ষা করতেও শান্তি। কারণ অপেক্ষার ফল যে সুমিষ্ট হবে। “
” ইয়েস মাই ডিয়ার বর। বেবি আসবে ঘরে এখন থেকে আরও বেশি সহনশীল হতে হবে তোকে।”
” তাহমি! খবরদার আর বলবি না সহনশীল হুহ্। আমাদের বেবি যেনো না জানতে পারে তার মা তার বাবাকে কীরকম বেইজ্জতি করে। “
তাহমি হাসতে হাসতে শেষ। বেচারা সহনশীল চৌধুরী!
সকাল থেকে রান্নাঘরে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন আমেনা ইসলাম। আজকে মেয়ে, জামাই আসার কথা। গতকাল গিয়েছিল বড়ো মেয়ের বাসায়। এতো বড়ো খুশির সংবাদ পেয়ে দুই বাড়ির সবার মহাখুশি। আর সেই সংবাদ শুনেই আসছে তৃষা ও অনিক। যদিও এমনিতেই আসার কথা ছিলো ওদের। কিন্তু এই খবরটা শুনে দু’দিন আগেই আসছে ওরা। আয়ান বেরিয়েছে অনিমাকে আনতে। দুপুরে আয়ানদের বাসায় খাওয়াদাওয়া করবে অনিমা। শেখ সাহেবের থেকে আগেই অনুমতি নিয়েছেন আয়ানের বাবা। ভদ্রলোক আপত্তি করেননি। আয়ানের মাঝে মধ্যে ভীষণ ভাগ্যবান মনে হয় নিজেকে। মনের মানুষটাকে এতো সহজে সবাই পায় না। যদিও বিয়েটা হতে দেরি,কিন্তু সবাই তো রাজি। আমেনা ইসলাম কড়াইয়ে পানি ঢেলে ঢাকনা দিয়ে বসার ঘরে এগিয়ে গেলো। দেয়ালঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময় দেখে নিলো। সকাল দশটা বিশ বেজেছে। এগারোটার মধ্যে তো ওদের আসার কথা। ওরা আসলে যেনো ভালো করে কথাবার্তা বলতে পারে সেজন্য আগেভাগে দুপুরের রান্না সেড়ে রাখছেন উনি। অনিক ও তৃষা এলে সবাইকে নিয়ে তাহমিকে দেখতে যাবে। তারপর সেখান থেকে তাহমি ও সহনকেও দুপুরে লাঞ্চের জন্য নিয়ে আসবে। সহন যদিও অফিসে তাই তাহমি একাই আসবে। পরে সহন অফিস থেকে চলে আসবে শ্বশুর বাড়ি। তাহমিকে সহন সকালবেলা দিয়ে আসতে চেয়েছিল বাবার বাড়ি কিন্তু অনিক আর তৃষা চাচ্ছিল বোনের শ্বশুর বাড়িতে গিয়েই দেখবে তাকে।
ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে বারবার নিজেকে দেখে নিচ্ছে অনিমা। এরমধ্যে দু’টো পোশাক চেঞ্জ করে দেখা হয়ে গেছে। প্রথমে বেবি পিংক কালারের থ্রিপিস পরেছিল পরে সেটা বদলে আবার সাদা রঙের গাউন পরেছে। কোন পোশাকে যে সুন্দর লাগবে সেই নিয়ে সন্দিহান সে। আয়ানের চলে আসার সময়ও আগত। উঁহু এরমধ্যেই কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে এলো অনিমার কর্ণকুহরে। অনিমা রুদ্ধশ্বাসে ছুটলো দরজা খুলে দিতে এবং খুলেও দিলো। আয়ান একবার আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে নিলো অনিমার দিকে।
” এসো এসো। “
” সাজগোছ কমপ্লিট? “
” দেখো তো ঠিকঠাক লাগছে আমাকে?”
” হ্যাঁ। খুব সুন্দর। এরচেয়ে বেশি ঠিকঠাক দেখালে বাইরের লোকজনের নজর পড়বে আমার পিচ্চি বউয়ের উপর। “
” আমি মোটেও পিচ্চি নই হুহ্। “
” থাক এসব। এখন চলো বের হই। “
” তুমি দাঁড়াও একটু আমি হ্যান্ডব্যাগ ও ফোন নিয়ে আসছি। “
অনিমা আয়ানের জবাবের অপেক্ষা না করেই আবারও নিজের ঘরের দিকে ছুট লাগালো। মিনিট দুয়েকের মধ্যে আবার ফিরেও এলো। আয়ান হাসলো ঠোঁট কামড়ে। মেয়েটা এখনো ছেলেমানুষী ছাড়তে পারেনি।
চলবে,