বন্য প্রণয় 44,45

বন্য প্রণয়
( প্রাপ্তবয়স্ক ও মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
” সহন দেখ সরি দেখো সাকিন হাসছে! “
পাশাপাশি শুয়ে ছিলো তিনজন। রাতের খাওয়াদাওয়া শেষে শুয়েছে। হঠাৎ তাহমির কথায় সহন চমকাল, থমকাল। আগেও সাকিন হেসেছে তবে এখন তো বড়ো হয়েছে একটু তাই হাসিটা আরও প্রসস্থ হয়েছে। সাকিনের চার মাস শেষের পথে। দেখতে দেখতে চারটা মাস কেটেও গেছে।
” কই দেখি আমার বাবাটা হাসছে কেমন করে। “
সহন ও তাহমির মাঝখানে শোয়া সাকিন। হাত-পা অনবরত নেড়ে যাচ্ছে এতটুকু ছেলে। সাথে হাসছে। সহন সাকিনের কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো। সাকিনের হাসি গেলো তাতে থেমে। তাহমি কটমট করে তাকিয়ে আছে এখন সহনের দিকে। বেচারা সহন অপরাধীর মতো সাকিনের দিকে তাকাচ্ছে একবার আবার তাহমির দিকে তাকাচ্ছে একবার।
” দিলে তো হাসির বারোটা বাজিয়ে! ছেলেটা কতো সুন্দর হাসছিল।”
” আমি তো একটু আদরই করলাম শুধু। বুঝি না তোমাদের মা ছেলের মতিগতি। ভালোবাসতে গেলেও দোষ হয়।”
তাহমি মুচকি হাসলো সহনের কথায়। আসলে সিলিং ফ্যানের অনবরত ঘূর্ণন দেখেই এতক্ষণ হাসছিল সাকিন৷ সহন সাকিনের কপালে চুমু খাওয়ার ফলে ফ্যানের ঘূর্ণন স্পষ্ট দেখা যাচ্ছিল না বলেই ছেলেটা হাসা বন্ধ করে দিয়েছিল।
” হয়েছে, আমরা তো সুবিধার না। তাই আমাদের মতিগতি বোঝো না। ঘুমাও এখন।”
সহন বালিশে মাথা রেখে দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললো,
” সাকিনকে একপাশে শোয়ানো যায় না তাহমি? কতদিন তোমাকে জড়িয়ে ধরে ঘুমাই না!”
আসলেই সাকিন পৃথিবীতে আসার আগে থেকেই কেমন একটা দূরত্ব সৃষ্টি হয়েছে তাহমি ও সহনের মধ্যে। তাহমিও মাঝে মধ্যে বিষয়টা ফিল করে। তাহমির মা-ও সেদিন ফোনে এ বিষয় বলছিল,বাচ্চা হওয়ার পর অনেক মেয়ে বাচ্চা সামলাতে গিয়ে স্বামীর থেকে দূরে সরে যায়। তাই এ সময় উচিত স্বামীকে বুঝিয়ে বলা বিষয়টা এবং যথাসম্ভব নিজেদের মধ্যে স্বাভাবিক সম্পর্ক বজায় রাখা।
” ঠিক আছে। দাঁড়াও আমি বড়ো কোলবালিশ দু’টো পাশে দিয়ে দিচ্ছি। তোমার ছেলে যে নড়াচড়া করতে শিখেছে, কখন আবার ধপাস করে ফ্লোরে পড়ে! “
সহন সাকিনকে কোলে তুলে নিলো। সাকিন হাত দু’টো দিয়ে সহনের সামনের চুলগুলো ধরে খেলছে। তাহমি পরপর দুটো কোলবালিশ খাটের যে পাশে সাকিন ঘুমাবে সেই পাশে দিয়ে দিলো।
” হ্যাঁ ভালো করে দাও বালিশ। “
” হুম হয়েছে এবার। সাকিনকে দাও খাইয়ে ঘুম পাড়িয়ে দেই।”
সহন তাহমির কোলে তুলে দিলো সাকিনকে। গরমে সাদা সেন্ডো গেঞ্জি আর প্যামপাস পরেছে পিচ্চি সাকিন। আধঘন্টা পরে ঘুমাল সে। সহন এতক্ষণ শুয়ে শুয়ে ছটফট করছিল, কখন ছেলেটা ঘুমোবে! সাকিনের নড়াচড়া থামতেই সহন ফিসফিস করে তাহমিকে ডাকতে লাগলো, ” তাহমি! এই তাহমি! সাকিন ঘুমিয়েছে? “
” হ্যাঁ ঘুমিয়েছে। এবার তুমিও আমাকে ধরে ভদ্রলোকের মতো ঘুমাও।”
সহন সময় দিলো না তাহমিকে। আস্তে আস্তে সাকিনের থেকে দূরে সরিয়ে আনলো তাকে। তারপর নিজের শরীরের উপর উঠিয়ে শোয়াল তাহমিকে। তাহমির কেমন অস্বস্তি হচ্ছে। সিজার হওয়ায় সব সময় কেমন ভয় ভয় কাজ করে তাহমির মনে। মনে হয় যদি সেলাইয়ের কোনো সমস্যা হয়!
” পৃথিবীর সকল ভদ্রলোকগণ তাদের স্ত্রী’র কাছে যে অভদ্র সেটা কি তুমি জানো সাকিনের মা?”
তাহমির ঠোঁট টিপে হাসছে। ‘সাকিনের মা’ ডাকটা বড়ো ভালো লাগে শুনতে। তাহমি আস্তে করে সহনের উপর থেকে সরে পাশে বালিশে শুয়েছে।
” হ্যাঁ জানি তো।”
” তাহলে?”
Passive Income
Passive Income
” কী?”
” কতগুলো মাস ঠিকমতো কাছাকাছি আসো না বলো তো?”
” মাস ছয়েক হবে। তবে ইচ্ছে করে তো করছি না বলো? আমার কেমন একটা ভয় লাগে এখন যদি… “
” ধুর পাগলি! তুমি শিক্ষিত, একজন শিক্ষিকা। কতশত সিজারিয়ান বেবি হচ্ছে চারদিকে। কারো শুনেছ, সেলাই নষ্ট হয়ে গেছে? বোকা বোকা কথা বলো মাঝে মধ্যে। “
সহন কিছুটা বিরক্তি নিয়েই বললো কথাটা। হাজার হলেও সহন পুরুষ মানুষ। এতদিন দূরে দূরে থেকে যথেষ্ট অধৈর্য হয়ে গেছে লোকটা। তাহমি নিজেও জানে তার এই ভয় সম্পূর্ণ অমূলক। নিজেকে বোঝাতে মিনিট পাঁচেক সময় নিলো তাহমি। এভাবে চলতে থাকলে সম্পর্কে দূরত্ব বাড়বে ব-ই কমবে না। সহন কিছুটা রেগে গিয়ে তাহমিকে আর জড়িয়ে ধরছে না। চুপচাপ শুয়ে আছে। ডিম লাইটের মৃদু আলোতে সাকিনের দিকে তাকাচ্ছে সহন। তারপর আলতো করে সাকিনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। তাহমি সহনের বুকে মাথা রেখেছে। সহন তবুও চুপ করে রইলো।
” প্লিজ রাগ করো না। কখনো তো রাগ করোনি তাই তুমি রাগলে ভীষণ অন্য রকম লাগে গো।”
তাহমির কথাগুলোর ভেতর কিছু একটা ছিলো। হয়তো আকুতি কিংবা অসহায়ত্ব। সহন আর রেগে থাকতে পারলোনা। দু-হাতে আঁকড়ে ধরলো তাহমিকে। মাথায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিয়ে বললো,
” রাগ করিনি আসলে। মেজাজটা চটে গিয়েছিল হঠাৎ। আমিও দুঃখিত। ঘুমাও রাত হলো ভালোই। সাকিন উঠে গেলে তোমাকে আবার বসে থাকতে হবে। “
সাকিন রাতে তিন থেকে চার ঘন্টা ঘুমায় মাত্র। তাছাড়া সে হাত-পা নেড়ে একা একা খেলাধূলা করে। মাঝে মধ্যে আবার অহেতুক কান্নাকাটিও করে। এতটুকু বয়সেই তার মনমতো হাত-পা না নাড়াতে পারলে চিৎকার করে কান্নাকাটি করে।
” উঠতে অনেক দেরি। এখন বলো আদর কি তুমি শুরু করবা? না-কি আমাকে আগের রূপে ফিরতে হবে? “
সহনের মানসপটে ভেসে উঠলো সেই বাসর রাতের স্মৃতি। এই দস্যি মেয়েটা কীভাবে জোরাজোরি করে তাকে আদর করতে চাইত! ভাবতেই হেসে উঠলো সহন। তাহমির পিঠে হাত রেখে আলতো করে চাপ দিয়ে বললো,
” থাক বন্য রাণী, এখন তো আমি ফুল লোডে আছি তাই আমিই করছি। যখন আমার এনার্জি কম পড়বে তখন তুমি করবে না হয়। তবে তাহমি আমার মনে হচ্ছে আমার রাগ করার জন্য নিজের মনের বিরুদ্ধে গিয়ে এসব বলছো তুমি। “
” উঁহু! আমি নিজেও চাচ্ছিলাম কিন্তু নিজের ভয়টাকে কাটাতে পারছিলাম না। “
” কিচ্ছু হবে না। “
তাহমি মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। সহনের বুকের উপর তাহমির তপ্ত নিঃশ্বাস যেনো সহনকে আরও জংলী করে তুলতে লাগলো। সহন ক্রমে ক্রমে তাহমির শরীরের উত্তাপ বাড়াতে লাগলো নিজ স্পর্শে। এতগুলো দিনের জমিয়ে রাখা অনুভূতি প্রকাশ করলো দু’জন। ভালোবাসাময় হয়ে উঠলো কিছু মুহুর্ত।
সবকিছুর মধ্যে অনিমার এইচএসসি পরীক্ষা শেষ হয়েছে ভালোমতো। সামনের সপ্তাহেই বিয়ের তারিখ ঠিক করেছে দুই পরিবারের লোকজন। সত্তার শেখের শরীরটা দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সেই নিয়ে অনিমার ভীষণ চিন্তা। বাবাকে রেখে কীভাবে শ্বশুর বাড়ি চলে আসবে সেসব ভেবে মন খারাপ হয়। আবার আয়ানকে ছেড়ে দূরে থাকতেও আর ইচ্ছে করে না। মেয়ের চিন্তাভাবনা সত্তার শেখ ভালো করেই বুঝতে পারেন। তাই দুপুরের খাওয়াদাওয়ার পাট চুকিয়ে নিজের ঘরে ডেকে পাঠালেন অনিমাকে। অনিমা শান্তভাবে এসে বাবার পাশে বিছানায় বসলো।
” কী রে মা? এভাবে চিন্তা করতে করতে তো মুখখানা তোর শুকিয়ে গেছে। সামনে বিয়ে এখন চেহারা এমন হলে চলো?”
মেয়ের মাথায় হাত রেখে শুধলেন সত্তার শেখ। অনিমা হুহু করে কেঁদে উঠলো হঠাৎ করে। মেয়ের এমন কাণ্ডে চমকালেন, থমকালেন তিনি। ছোটো মেয়েটা কখন এতো বড়ো হয়ে গেলো তার? বাবাকে রেখে যাওয়ার জন্য মনটা যে তার কতটা খারাপ সেটা বুঝতে বাকি নেই সত্তার শেখের।
” বাবা তুমি একটু ভালো করে ডাক্তার দেখাও। তোমার এই অবস্থায় কীভাবে তোমাকে ছেড়ে যাবো আমি? “
” প্লিজ মা কাঁদিস না। আমি ঠিক হয়ে যাবো। বয়স হয়েছে। এ সময় বিভিন্ন অসুখ-বিসুখে ধরে। সেই নিয়ে এতো চিন্তা করতে হয়? আয়ান তো কবে থেকে তোর জন্য অপেক্ষা করছে বল? ছেলেটা যোগ্য বলেই তো সবকিছু মেনে নিলাম। দেখছিস তো আয়ান কোম্পানির হাল ধরার পরে বেশ উন্নতি হয়েছে ব্যবসায়। “
অনিমার চোখের পানি মুছিয়ে দিলেন সত্তার শেখ। অনিমা বাবাকে জড়িয়ে ধরেছে। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন সত্তার।
” আমি জানি বাবা,তোমার জহুরির চোখ। কাচ ও হিরার পার্থক্য তুমি বুঝতে পারো।”
” হ্যাঁ ঠিক বলেছিস। আয়ানের পরিবারের সবাইও খুব ভালো। দেখিস তোর কোনো সমস্যা হবে না। “
” সেটা আমি জানি বাবা। তুমি সুস্থ থাকলে আমার আর কোনো চিন্তা নেই। “
মেয়ের কথায় দীর্ঘশ্বাস ফেললেন তিনি।
” ঠিক আছে। যা ঘরে গিয়ে বিশ্রাম নে। বিকেলে আয়ান আসবে বললো,বাসায় ভালোমন্দ রান্না হবে ওদের। তোর হবু শ্বাশুড়ি যেতে বলেছেন। “
” ঠিক আছে বাবা। তুমিও রেস্ট নাও।”
অনিমা বাবাকে রেখে নিজের ঘরের দিকে এগোলো। দেখতে দেখতে কতগুলো দিন কেটে গেলো! এই তো মনে হয় আয়ানের সাথে পরিচয় হলো সেদিন। কিন্তু মাঝখানে পেরিয়ে গেছে প্রায় তিনটে বছর!
চলবে,
#বন্য_প্রণয়
#পর্ব_৪৫
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
সাকিনকে গোসল করিয়ে বিছানায় এসে শোয়াল তাহমি। চার হাতপা নাড়াচাড়া করতে ব্যস্ত সে। শরীরে বিন্দু বিন্দু পানির ফোঁটা। নিজের গায়ের ওড়না দিয়ে ছেলের শরীর মুছে দিল তাহমি। ছেলেটার পানি ভীষণ পছন্দ। পানির ছিটেফোঁটা লাগলেও হেসে উঠে নিঃশব্দে। ছেলেকে জামাকাপড় পরিয়ে কোলে নিয়ে শ্বাশুড়ির ঘরের দিকে এগোলো তাহমি। ঘরে একা রেখে গোসল করতে তো যেতে পারে না। তাই ফরিদা খানের কাছে সাকিনকে রেখে তারপর গোসল করবে তাহমি। সহন অফিসে। ফিরবে একেবারে রাতে। দুপুরে একটা জরুরি মিটিং থাকায় আজকে আর বাসায় ফেরা হলোনা। ও বাড়িতে কাজকর্মের ব্যস্ততায় দিন কাটছে তৃষা,অনিক,আয়ানের। আত্মীয়স্বজন এসেছে কয়েকজন। বিয়ের এখনও বাকি তিন দিন। তাহমি আগামীকাল যাবে বাবার বাড়ি। সাকিনকে নজর ছাড়া করতে চান না ফরিদা। নইলে আরও দু’দিন আগেই বাবার বাড়ি চলে যেতো তাহমি।
তপ্ত দুপুর। বৈশাখের উত্তাপে অতিষ্ঠ শহরের মানুষজন থেকে শুরু করে পশুপতি ও গাছপালা। বৃষ্টি নেই বললেই চলে। তাই গরম অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া না করেই বান্ধবী ইকরার সাথে শপিং করতে এসেছিল অনিমা। আয়ানকে বলেনি অবশ্য। বললে আয়ান নিজেও আসতে চাইত সাথে। সামনেই আয়ানের জন্মদিন। বিয়ের ঠিক দু’দিন পর। তখন তো বাড়ি থেকে চুপিচুপি বের হওয়া সম্ভব হবে না, তাই এখনই কিছু উপহার কিনে রাখলো অনিমা।
” আচ্ছা অনিমা গেলাম আমি। সাবধানে যাস।”
ইকরাকে বাসার সামনে নামিয়ে দিলো অনিমা। আজকে অনিমা নিজেই গাড়ি নিয়ে বেরিয়েছে। ড্রাইভ করতে আগে থেকেই পারে সে।
” ওকে দোস্ত। টাটা!”
” টাটা।”
ইকরাকে বিদায় জানিয়ে বাড়ির দিকে গাড়ি ঘোরাল অনিমা। ইশ ভাবতেই ভীষণ এক্সাইটেড লাগছে অনিমার। সামনে বিয়ে তারপর আবার আয়ানের জন্মদিন! কীভাবে আয়ানকে সারপ্রাইজ দিবে সবকিছুই ভেবে রেখেছে সে। প্রায় পনেরো দিন ধরে ইউটিউবে কেক বানানোর ভিডিও দেখে তিনবার চেষ্টা করে অবশেষে ঠিকঠাক মতো কেক বানাতে শিখেছে মেয়েটা। নিজের হাতে কেক বানিয়ে দিলে আয়ান একটু বেশি খুশি হবে বলেই এই সামান্য কষ্ট করা অনিমার। হঠাৎ ট্রাকের কর্কশ হর্ণ দেওয়ার আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো অনিমা। ভাবনার জগত পেরিয়ে বাস্তবে ফিরতেই আঁতকে উঠলো সে। প্রাণপণে চেষ্টা করলো গাড়িটা পাশ কাটিয়ে নিয়ে যেতে। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না। ট্রাকের সাথে মুখোমুখি ধাক্কা খেয়ে গাড়ির অবস্থা শোচনীয় হয়ে গেছে। মাথায় তীব্র আঘাত পেয়ে পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করছে অনিমা। শেষ বারের মতো আয়ান ও বাবার চেহারা ভেসে উঠেছে অনিমার চোখের সামনে। কষ্ট হচ্ছে ভীষণ! কী মারাত্মক কষ্ট তা বলে বোঝানো যাবে না। আয়ানের বলা কত-শত কথা কানে বাজছে। ইশ! বউ হয়ে আয়ানের সাথে সংসার করা আর হলোনা তার। আয়ানকে নিজের করে কাছে পাওয়াও হলো না। দম বন্ধ হয়ে আসছে অনিমার। পানির তৃষ্ণা পাচ্ছে। রক্তে ভেসে গেছে গাড়ির ভেতর। আশেপাশের লোকজন ছুটে এসেছে স্পটে। অনিমার সময় ফুরিয়ে যাচ্ছে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে হৃৎস্পন্দনের আওয়াজ থমকে গেলো মেয়েটার। চিরদিনের জন্য!
” কী হয়েছে রে আয়ান? এরকম অস্থির হয়ে আছিস কেনো? ঠিকমতো খাবার খেলি না। “
মায়ের প্রশ্নের জবাবে কিছু বললো না আয়ান। ড্রইং রুমে চুপচাপ বসে আছে সে। সেই দুপুর একটা থেকে এখন পর্যন্ত অনিমার কোনো মেসেজ আসেনি তার ফোনে। মেয়েটা নিয়ম করে তিন বেলা খাবার খেয়ে নিতে বলে আয়ানকে। আজকে অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ একেবারে বিয়ের জন্য ছুটি নিয়ে বাসায় এসেছে আয়ান। অনিমা শুনলে বিকেলে ঘুরতে যেতে চাইবে ভেবে তখন থেকে কল করে যাচ্ছে্িল আয়ান। কিন্তু না কল রিসিভ তো দূর নম্বর বন্ধ বলছে অনবরত। মনটা তাই ভীষণ আনচান করছে আয়ানের। আয়ানের নীরবতায় তৃষা ভেংচি কেটে বললো,
” বুঝলে মা, ভাবীর চিন্তা করছে। “
” আহ তৃষা চুপ করো। দেখছ না আয়ানের চোখমুখ কেমন শুকিয়ে গেছে?”
পাশ থেকে অনিক বললো। আয়ানের কানে কারো কথা যেনো কথা ঢুকছে না। বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো সে।
” আসলেই ভীষণ চিন্তা হচ্ছে। তোমরা থাকো আমি বারং অনিমার বাসা থেকে একটু ঘুরে আসি। আড়াই ঘন্টা হলো এখনও নাই কল আসলো না ওর নম্বর থেকে, বিষয়টা অস্বাভাবিক। “
” হয়তো সত্তার ভাইয়ের শরীরটা খারাপ করেছে। উনার তো শরীরটা খারাপ যাচ্ছিল। “
আমেনা ইসলাম ছেলেকে কিছুটা স্বান্তনার বাণী শেনালেন৷ কিন্তু আয়ান দাঁড়াল না। নিজেই ড্রাইভ করতে লাগলো। আয়ানের চিন্তিত ভাবভঙ্গি দেখে বাসার সবাইও চিন্তায় পড়ে গেলো। এমনিতেই সকাল থেকে ভীষণ অশান্তি অশান্তি লাগছিল আমেনার।
কিছু কিছু মানুষের জীবনে প্রিয় মানুষকে পাওয়া খুব সহজ বিষয় আবার কিছু কিছু মানুষের জীবনে চাওয়া-পাওয়ার হিসাব মেলা দুষ্প্রাপ্য! আয়ানের জীবনেও তাই হলো। ভালোবাসার মানুষকে হারিয়ে ফেললো সে। হন্তদন্ত হয়ে প্রেয়সীর বাড়িতে ছুটে গিয়ে জানতে পারল,অনিমা এক্সিডেন্ট করেছে। এক্সিডেন্ট স্পটেই মৃত্যু হয়েছে অনিমার। মেয়েটাকে নিয়ে যখন সত্তার শেখ হসপিটালে যখন পৌঁছেছিলেন তখন অলরেডি মৃত। মাথা কাজ করছিল না উনার। আয়ানকে কল করে খবর দেওয়ার কথা তখন মাথায় ছিলো না। আয়ান চুপচাপ অনিমার নিথর দেহের পাশে বসে আছে বসার ঘরে। আশেপাশে আরও লোকজন। সত্তার শেখ অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। কথা বলতেও পারছেন না। সাদা কাপড়ে আবৃত শরীরটা আর নড়াচড়া করবে না কখনো। হুটহাট লাফিয়ে কেউ আর কোলে চড়ে আদর করার বায়না ধরবে না। রাতবিরেতে কেউ আর দেখবো বলে জ্বালাবে না। ছেলেমানুষী, পাগলামিও কেউ আর করবে না আয়ানের সাথে। বাসা থেকে বেরিয়ে যাওয়ার পর কোনো খোঁজখবর না পাওয়ায় অনিক শেষমেশ অনিমাদের বাসায় এসেছে আয়ানের খোঁজ নিতে। আর এসেই এই দুঃসংবাদ শুনে থমকে গেছে অনিকও।
” ছেলেটাকে কেউ ধরে বসাও ফ্যানের নিচে। এই রুমের এসিটা নষ্ট হয়ে গেছে। “
আশেপাশ থেকে কেউ একজন আয়নকে সরানোর কথা বললো। একটানা প্রায় দেড় ঘন্টা বসে আছে একজায়গায়। ঘেমে-নেয়ে একাকার হয়ে গেছে। অনিক এরমধ্যে বাসায় কল দিয়ে সবকিছু জানিয়েছে। তৃষা আমেনা ইসলামকে নিয়ে রওনা হয়েছে। অনিক আয়ানের পাশে গিয়ে বসলো। আয়ান নিষ্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে অনিমার লাশের দিকে। আসরের নামাজের পরে জানাজার নামাজ আদায় করা হবে এবং তারপর পারিবারিক গোরস্থানে কবর দেওয়া হবে তাকে।
BIONARRATIVE
BIONARRATIVE
” আয়ান! আয়ান, ভাই আমার। একটু এদিকে এসে বসবে? “
অনিক নম্র স্বরে আয়ানকে ডাকল বেশ কয়েকবার। কিন্তু আয়ান যেনো বোবা হয়ে গেছে। কিঞ্চিৎ পরিমাণ নড়াচড়াও করছে না, কথা বলা তো দূর। অনিক মনে মনে ভয় পাচ্ছে। এরকম চুপ করে থাকা মোটেও ভালো বিষয় নয়।
” আয়ান? উঠো। অনিমার বাবা ভীষণ অসুস্থ। তুমি যদি এখন শক্ত না থাকো তাহলে উনাকে কে স্বান্তনা দিবে বলো?”
না! আয়ান কোনো কথার উত্তর দিচ্ছে না। ফলশ্রুতিতে অনিক আয়ানের কাঁধে হাত দিয়ে ধাক্কা দিলো। সবাইকে অবাক করে দিয়ে মাটিতে লুটিয়ে পড়লো আয়ান। চমকাল অনিক। উপস্থিত সবাইও চমকাল। কেউ কেউ তো বলাবলি করতে শুরু করলো,
“ ছেলেটা অনিমাকে কতটা ভালোবাসত! মেয়েটার মৃত্যুতে আয়ান শেষ হয়ে যাচ্ছে। যেখানে বিয়ে করে সংসার করার স্বপ্ন বুনছিল দু’জন, সেখানে সাদা কাফনে আবৃত হয়ে চির নিদ্রায় শায়িত হলো মেয়েটা।”
অনিক আশেপাশে থাকা দু’জন লোকের সাহায্যে আয়ানকে উঠিয়ে নিয়ে সোফায় শুইয়ে একটা টেবিল ফ্যান ছেড়ে দিলো। এরমধ্যে আমেনা ও তৃষাও উপস্থিত হলো অনিমাদের বাসায়। ঘরে প্রবেশ করেই হবু পুত্র বধূর এমন অবস্থা দেখে বুকটা কেঁপে উঠল আমেনা ইসলামের। পরক্ষণেই মেয়ে জামাইয়ের পাশে নিজের ছেলেকে অচেতন অবস্থায় আবিষ্কার করে হতভম্ব হয়ে গেলেন। ছুটে গেলেন সেখানে। তৃষাও ভাইয়ের কাছে এসে দাঁড়িয়েছে।
” অনিক কী হয়েছে আমার আয়ানের? ও এরকম পড়ে আছে কেনো বাবা?”
আমেনা ইসলাম হুহু করে কেঁদে উঠলেন। অনিক তৃষাকে ইশারা করে সামলাতে বলছে মা’কে।
” জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে মা। এতবড় শক সহ্য করতে পারেনি। এসে থেকে একটা কথাও বলেনি আর না তো কেঁদেছে। এভাবে চুপচাপ থাকলে ভয়ের বিষয়। “

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *