আমেনা ইসলাম হুহু করে কেঁদে উঠলেন। অনিক তৃষাকে ইশারা করে সামলাতে বলছে মা’কে।
” জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে মা। এতবড় শক সহ্য করতে পারেনি। এসে থেকে একটা কথাও বলেনি আর না তো কেঁদেছে। এভাবে চুপচাপ থাকলে ভয়ের বিষয়। “
” তাহলে কী করবে? ভাইয়াকে কীভাবে কথা বলাবেন? “
” তৃষা তুমি মা’কে নিয়ে বসো আমি দেখছি।”
তৃষা আমেনা ইসলামকে নিয়ে অনিমার লাশের পাশে গিয়ে বসলো। আমেনা ইসলাম শেষ বারের মতো চঞ্চল মেয়েটাকে দেখতে চাইছেন। কিন্তু এক্সিডেন্টের কারণে চেহারা দেখতে বিশ্রী লাগায় সবাইকে দেখতে বারণ করছে অনেকেই। কিন্তু আমেনা শুনলেন না। তৃষাকে জোরাজোরি করলেন। শেষে তৃষা মুখের উপর থেকে কাফনের কাপড় সরিয়ে দিলো। ছ্যাঁত করে উঠলো আমেনার বুকটা। এই তো সেদিনও বাসায় এসেছিল মেয়েটা! কতো কতো প্ল্যান ছিলো তার। বাড়িতে এসে কোন কোন কাজ সে করবে সবকিছু বলে রেখেছিল আয়ানের মা’কে। আমেনা ইসলামও অনিমার চঞ্চলতার মধ্যে তাহমিকে খুঁজে পেতো। নিজের আরেকটা মেয়ের মতোই ভালোবাসতেন অনিমাকেও। এভাবে মেয়েটা একদিনের মধ্যে নাই হয়ে গেলো? ছেলেটাকে কীভাবে সামলাবেন সে নিয়েও মনটা খচখচ করছে আমেনার। আয়ানের বাবা এরমধ্যে এসে অনিমার বাবার সাথে দেখা করতে গেলেন।
” আয়ান? শক্ত হও জেন্টলম্যান। মা এসেছেন। “
আয়ানের জ্ঞান ফিরতেই উঠে বসেছে। আশেপাশে তাকিয়ে কিছু একটা খুঁজছে সে। অনিকের বুঝতে বাকি নেই আয়ানের চোখজোড়া ভুলবশত এখনও অনিমাকেই খুঁজছে। মেয়েটা খুব ভাগ্যবতী ছিলো। পুরুষ মানুষের চোখের জল যে নারীর জন্য ঝড়ে নিসন্দেহে সে ভাগ্যবতী। আয়ান আমেনা ইসলামকে দেখে উনার পাশে গিয়ে ফ্লোরে বসেছে। অনিমার মুখ ঢেকে দিয়েছে তৃষা।
” বাবা আয়ান, কথা বলছিস না কেনো? কথা বল! অনিমাকে শেষবারের মতো কিছু বলবি না ওকে? “
মায়ের কথায় শব্দ করে কেঁদে উঠল আয়ান। অনিমার লাশের দিকে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠে কান্নার বেগ আরও বাড়ালো। উপস্থিতি সবাই তাকিয়ে আছে আয়ানের দিকে। আয়ান সবকিছু ভুলে অনিমাকে জড়িয়ে ধরে গলা ছেড়ে কাঁদতে লাগলো। আয়ানের কান্না দেখে অনিকেরও দু-চোখ ছলছল করছে। আমেনা ইসলাম তো আগে থেকেই কাঁদছেন। তৃষা ওড়নায় মুখ গুঁজে ভাইয়ের আহাজারি দেখছে। কলিজা পুড়ে যাচ্ছে ছেলেটার।
” অনিমা? এই অনিমা? এভাবে পারলে স্বার্থপরের মতো আমাকে ছেড়ে যেতে? তুমি না বলতে আমাকে কখনো একা রেখে কোথাও যাবে না? মরলেও পেত্নী হয়ে ঘাড়ে চাপবে? কই! তোমাকে তো দেখতে পাচ্ছি না আমি। অশরীরী হয়ে আসতে তো পারো? আমি কীভাবে বাঁচব তোমাকে ছাড়া? বাড়িতে বিয়ের জন্য সবকিছু কত সুন্দর করে সাজানো হয়েছে। আমাদের বিয়েটা হলো না অনিমা! আমাদের এক হওয়া হলোনা, একটা সংসার হলো না। আচ্ছা কে আমাকে জ্বালাতন করবে এখন? কে হুটহাট বিব্রত করবে বলো তো? এই অনিমা আমি আর কখনো তোমাকে বকবো না। এখুনি লাফিয়ে আমার কোলে উঠতে পারো না? “
তৃষা মা’কে জড়িয়ে ধরে ঠুকরে কেঁদে উঠে। আমেনা ইসলামের নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে। চোখের সামনে বসে সন্তানকে এভাবে কষ্ট পেতে দেখেও মা হয়ে কিছু করতে না পারার যন্ত্রণা মারাত্মক। সবাই আয়ানের কষ্ট দেখে চুপ হয়ে গেছে। পুরুষ মানুষের কান্না কী বিশ্রী রকমের ভয়ংকর তা না দেখলে কেউ বুঝবে না। আয়ানের চিৎকারে শেষমেশ সত্তার শেখও বসার ঘরে এসে উপস্থিত হয়েছেন। অনিমার জন্য আয়ানের এতো ভালোবাসা দেখে বড্ড আফসোস হচ্ছে উনার। পোড়া কপাল না হলে এই ভালোবাসা উপেক্ষা করে কেউ পৃথিবী ছাড়ে? কপালে ছিলো না মেয়েটার এতো সুখ। এরমধ্যে সহন ও তাহমিও এসে গেছে। তাহমি সাকিনকে নিয়ে একপাশে দাঁড়িয়ে আছে। কী বলে যে ভাইকে স্বান্তনা দিবে সে ভাষা তাহমির জানা নেই। ভেবেছিল ভাইয়ের বিয়েতে কতো আনন্দ করবে,খাবে। আর কী হলো? নববধূ সাজে যাকে দেখার কথা ছিলো আজ সে লাশ হয়ে শুয়ে আছে ভাইয়ের কোলে! সহন ও অনিক মিলে আয়ানকে ধরে লাশের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে আসে। বাকিরা অনিমার লাশকে জায়গায় শুইয়ে দেয় আবারও। সত্তার শেখ বেশিক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকতে পারলেন না। তাই নিজের ঘরে গিয়ে বসলেন। সৃষ্টিকর্তা যখন তার স্ত্রীকে নিয়ে গেলেন তখনও এতটা কষ্ট হয়নি। পৃথিবীতে হয়তো সন্তানের প্রতি ভালোবাসার চেয়ে আর কারো প্রতি বেশি ভালোবাসা থাকে না।
জীবন কারো জন্য থমকে থাকে না। শুধু জীবনের প্রতিটি দিন সেই মানুষটার অভাবে দূর্বিষহ লাগে। আয়ানেরও হচ্ছে তাই। অনিমা ছাড়া বেঁচে থাকলেও তা জীবন্ত লাশের মতোই বেঁচে থাকা মনে হয় তার কাছে। মেয়ের চলে যাওয়ার ঠিক সপ্তাহ খানেকের মধ্যে সত্তার শেখও ইন্তেকাল করেন। ভদ্রলোকের আগেই জটিল রোগ ছিলো শরীরে। কিন্তু সে কথা কখনো প্রকাশ করেননি তিনি। লিউকেমিয়া হয়েছিল উনার। একেবারে লাস্ট স্টেজে ছিলো বলে ডাক্তার আগেই বলেছিল বেশি দিন নেই তার হাতে। তাই তো মেয়েকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিতে চেয়েছিলেন। মৃত্যুর আগে নিজের যাবতীয় সম্পত্তির সত্তর ভাগ আয়ানের নামে করে দিয়ে গেছেন সত্তার শেখ। বাকি ত্রিশ ভাগ বিভিন্ন মসজিদ, মাদ্রাসা ও এতিমখানার জন্য বরাদ্দ করা হয়েছে। আয়ান কিছু নিতে চায়নি প্রথমে। কিন্তু পরে অনিমার বাবার চিঠি পড়ে সবকিছু নিজের করে নিয়েছে। অনিমার ভীষণ ইচ্ছে ছিল, একদিন দেশের নামকরা বিজনেসম্যান হবে আয়ান। কিন্তু আয়ানের অত বড়ো হওয়ার ইচ্ছে কখনো ছিল না। কিন্তু এখন আছে সেই ইচ্ছে। প্রেয়সীর সব ইচ্ছে পূর্ণ করার চেষ্টা করছে আয়ান। অনিমার ইচ্ছে মতো একটা কোচিং সেন্টার খুলে সেখানে মধ্যবিত্ত পরিবারের শিক্ষিত ছেলেমেয়েদের কাজের ব্যবস্থা করে দিয়েছে। বারো জন টিউটর সেখানে কাজ করে। মূলত যখন আয়ান অনিমাকে পড়াতো তখুনি এই ইচ্ছার কথা বলেছিল অনিমা। টাকাপয়সার তাই কোনো অভাব নেই এখন আয়ানের। কিন্তু মনের শান্তি? সে হয়তো চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে। আগের মতো আর কথা বলে না আয়ান। সব সময় মেপে মেপে কথা বলে। সারাক্ষণ কাজকর্ম দিয়ে নিজেকে ব্যস্ত রাখাই যেনো তার একমাত্র করণীয় বিষয়।
বিছানার চাদরটা একপাশ থেকে অন্য পাশে টেনে নিয়ে, বালিশ দুটো নিয়ে টানাটানি করছে সাকিন। কিন্তু বালিশের ওজন বেশি হওয়ায় টেনে কুলচ্ছে না। তাহমি গেছে গোসল করতে তাকে রেখে। ফরিদা খান যোহরের নামাজে ব্যস্ত। সহনের আসার সময় হয়ে গেছে ভেবেই দ্রুত গোসল করতে গেলো তাহমি। কিন্তু ওয়াশরুমে বসে ঘরের মধ্যে জিনিসপত্র ফেলার শব্দ শুনে গলা উঁচিয়ে সাকিনের উদ্দেশ্য বললো,
” সাকিন! কী ফেললে বাবা? কিছু ফেলো না। আমি এখুনি আসছি।”
মায়ের গলার আওয়াজে দুষ্ট হাসি দিলো সাকিন। বয়স তার তিন বছর। এলোমেলো পায়ে হাঁটে সে,কথা বলে আধো আধো। বয়সের তুলনায় সবকিছু স্লো একটু।
” আম্মা থুমি এচো না। আমাল কুব ভালো লাগে চবকিচু পেলতে হিহি।”
এই বলে সাকিন ড্রেসিং টেবিলের উপর থাকা সবকিছু আবারও ফেলতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো। তাহমি যা বোঝার বুঝে গেছে। আজকে নিশ্চিত ঘরের দফারফা হয়ে যাবে। উফ ছেলেটাকে নিয়ে আর পারে না। তাহমি তড়িঘড়ি করে গোসল সেড়ে বেরিয়ে এসে দেখে ফ্লোরে দুপাশে লিপস্টিক, চিরুনি, কাজল, বডিস্প্রে ছড়িয়ে বসে আছে সাকিন। চেহারার একপাশে লাল অন্য পাশে কালো। মানে একপাশে লিপস্টিক মেখেছে আর অন্য পাশে হলো কাজল।
” সাকিন! এসব কী? তোমাকে সুন্দর করে গোসল করিয়ে রেখে গেলাম না? এরমধ্যে চেহারার অবস্থা কী করেছো?”
” আমি সাজু কলেচি আম্মা।”
হাতে লিপস্টিক নিয়ে হেসে হেসে বললো সাকিন। তাহমি কোমরে শাড়ির আঁচল গুঁজে সবকিছু উঠিয়ে ড্রেসিং টেবিলের উপর রাখলো আবারও। এরমধ্যেই কলিংবেলের আওয়াজ ভেসে এলো। তাহমি এক দৌড়ে গিয়ে দরজা খুলে দিলো।
” কী ব্যাপার? এমন হাঁপাচ্ছ কেনো তুমি? “
সহনের প্রশ্নের উত্তর দিলো না তাহমি। শুধু ইশারায় বোঝাল পরে বলবে। মেয়েটা এক দৌড়ে আবারও নিজের ঘরে গেলো সাকিনের কাছে। ঘরে এসে দেখে আবারও সবকিছু ফ্লোরে নামানোর ব্যবস্থা করতেন ব্যস্ত সাকিন সাহেব। তাহমির মেজাজ বিগড়ে গেলো তাতে। সবকিছু জায়গায় রেখে চোখ রাঙিয়ে বললো ছেলেকে,
” এই সাকিন! আর যদি দেখি এসব করতে তাহলে কিন্তু বেঁধে রাখবো তোমাকে। “
মায়ের শাষণে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো সাকিন। এরমধ্যে ঘরে সহন এসে ঢুকল। বাবাকে দেখে ফ্লোরে বসে পড়লো সাকিন। ঠোঁট বেঁকিয়ে কান্না জুড়ে দিলো অনায়াসে। সহন হাতের ব্যাগ রেখে এগিয়ে গেলো ছেলের কাছে। কোলে তুলে নিয়ে শুধালো,
” কী হয়েছে? কাঁদছ কেনো বাবা?”
” আম্মু শুধু চবসময় লিজে সাজুগুচু কলে বাবাই। আমকে সাচায় লা। তাই আমিও একতু সাচতে গেচিলাম ব্লে বকচে ডেকো আ্যা…..”
সাকিনের কথায় ফিক করে হেসে উঠলো সহন। তাহমি রেগে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। সারাদিন জ্বালিয়ে মারে এখন আবার বাবার কাছে নালিশ হচ্ছে!
( প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য উন্মুক্ত!)
সাকিনের কথায় ফিক করে হেসে উঠলো সহন। তাহমি রেগে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। সারাদিন জ্বালিয়ে মারে এখন আবার বাবার কাছে নালিশ হচ্ছে!
” দেখছো ছেলে কত বিচ্ছু হয়েছে এখনই? “
তাহমি অভিযোগের সুরে বললো সহনকে। সহন সাকিনকে বিছানার একপাশে বসিয়ে নিজের শার্ট, টাই সব খুলতে লাগলো। বাইরে যা গরম প্রাণ যায় যায় অবস্থা।
” ছেলে তো ভুল কিছু বলেনি তাহমি। ও বেচারা দেখে তুমি একা সাজুগুজু করো সব সময়। আমাকেও করাও না আর না তো ছেলেটাকে। সেজন্যই তো আজকে নিজে নিজে সাজার চেষ্টা করলো।”
সহনের কথায় গায়ে জ্বালা ধরে গেছে তাহমির। মেজাজ তুঙ্গে এখন। সবকিছু ঠিকঠাক মতো রেখে সাকিনকে কোলে তুলে নিলো সে।
” ঠিক আছে। ছেলে না হয় বোঝে না সে ছেলে বলে সাজুগুজু করতে পারে না। কিন্তু ছেলের বাবা বলদ হয়েও যে এমন কথা বললো এরজন্য রাতে তাকে মাশুল দিতে হবে। “
” কী মাশুল? কামড়ে দাগ বানাবে না-কি? “
সহন আলমারি থেকে তোয়ালে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে হেসে বললো। তাহমি মুখ ভেংচি কেটে ঘর থেকে বেরোতে বেরোতে বলে,
” সেটা দেখবে রাতে। “
আজ বৃহস্পতিবার। দুপুরে একসাথেই অনিক ও তৃষা বাসায় ফিরেছে। তবে সকালবেলা রান্না করে রেখেই বের হয় তৃষা। ব্যাংকে চাকরি করছে তৃষা। আর অনিক তো আগে থেকেই ডাক্তারি পেশায় নিযুক্ত। অনিক অবশ্য বলেছে বাচ্চাকাচ্চা হলে তখন তৃষা কেবল বাচ্চাকে সময় দিবে। চাকরি করতে হলে বাচ্চা বড়ো হলে করবে।
” তৃষা! এই তৃষা আর কতক্ষণ লাগবে তোমার? “
ডাইনিং টেবিলে বসে আছে অনিক। তৃষা খাবার গরম করতে গেলো রান্নাঘরে। ততক্ষণে অনিক ঘরদোর ঝাড় দিয়ে রেখেছে। তৃষা দু’হাতে তরকারির বাটি নিয়ে রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে ডাইনিং টেবিলের দিকে আসছে।
” এই তো হয়ে গেছে। ভাত বেড়ে রেখেছেন? ভালোই হয়েছে। আমি তরকারি দিয়ে দিচ্ছি, খাওয়া শুরু করুন।”
” হ্যাঁ তুমিও বসো তাড়াতাড়ি। “
তৃষা প্রথমে অনিকের প্লেটে তরকারি দিয়ে পরে নিজেও বসলো খেতে। খাওয়ার সময় অনিক কথা বলে না। তাই চুপচাপ খেয়ে নিলো দু’জন।
সময়ের আবর্তনে অনিক ও তৃষার সম্পর্কে কোনো চিড় ধরেনি। বরং দিন যতই এগিয়েছে ততই দুজনের মধ্যে ভালোবাসা বৃদ্ধি পেয়েছে। ভালোবাসা কখনো মরে না। কেবল মরিচা ধরে তাতে। সঠিক মানুষের স্পর্শে সে ভালোবাসা পুনরায় জেগে উঠে। অনিকের হৃদয়েও তেমনি তৃষার আগমনে ভালোবাসা পুনরুজ্জীবিত হয়েছে।
ঘড়ির কাঁটায় রাত বারোটা বেজে দশ মিনিট। অন্ধকার ঘরে মোমবাতি জ্বলছে কতগুলো। মোমের আলোতে দেয়ালে হাস্যোজ্জ্বল মানুষের ছবি দেখা যাচ্ছে। অষ্টাদশী অনিমার ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে আছে ছবিতে। আয়ান সেই ছবির সামনে কেক নিয়ে বসে আছে নীরবে। আজকে অনিমার জন্মদিন। মানুষটা বেঁচে থাকলে কতটা রঙিন হতো আয়ানের জীবন! অথচ সে থাকবে বলেও আজ কোথাও নেই! ফোনের রিংটোনের আওয়াজে নড়েচড়ে উঠলো আয়ান। মা কল করেছেন। আয়ান কল রিসিভ করে কানে ধরলো।
” হ্যাঁ মা বলো।”
” সকালে সাবধানে গাড়ি চালিয়ে ফিরিস বাবা।”
” জি।”
” রাখছি।”
” হুম।”
কল কেটে দিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লেন আমেনা ইসলাম। ছেলেটা প্রতি বছর এই তারিখের রাতে অনিমাদের বাসায় গিয়ে থাকে। আগের মতো কথা বলে না আয়ান। শুধু যতটুকু দরকার ততটুকু বলে। নিজের ছেলেকে নিজেই চিনতে পারেন না। অকারণে রেগে যায়। একেবারে লোহার মতো শক্ত হয়ে গেছে। তবে আমেনা জানেন ভেতর ভেতর আয়ানের মনটা কতটা নরম। মেয়েটা তো চলে গেলো কিন্তু সেই সাথে তার ছেলের জীবনের সমস্ত রঙ নিয়ে গেলো।
” আয়ানের মা! প্লিজ কেঁদো না এভাবে। দেখো আমরা তো চেষ্টা করছি আয়ানকে স্বাভাবিক করার।”
আয়ানের বাবা নিজের স্ত্রীকে বুকে জড়িয়ে নিলেন।
” কিন্তু কাজ তো হচ্ছে না আয়ানের বাবা! আল্লাহ আমাদের ছেলেটার অন্তরে একটু শান্তি দিক। ছেলেটা ভেতর ভেতর শেষ হয়ে গেছে। আল্লাহ আমি কী করবো! মা হয়ে কিছু করতে পারছি না।”
আয়ানের বাবা কী বলে আমেনাকে স্বান্তনা দিবে বুঝতে পারছে না। মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছেন তিনি। আর মনে মনে নিজের ছেলের জন্য প্রার্থনা করছেন।
” সাকিনের মা? এই তাহমি? শুনছো? সাকিন ঘুমিয়েছে? “
সহন পেছন দিক থেকে তাহমির ঘাড়ে থুতনি রেখে ফিসফিস করে শুধালো। তাহমি সাকিনকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে সাথে নিজেও ঘুমিয়ে গেছে। তাই সহনের ডাক টাক তার কানে যাচ্ছে না। বউয়ের কোনো সাড়াশব্দ না পেয়ে সহন উঠে বসলো। তারপর ফোনের ফন্ট ফ্ল্যাশলাইট জ্বেলে সাকিন ঘুমিয়েছে কি-না চেক করতে লাগলো। যাহ বাবা! ছেলের সাথে তো ছেলের মা-ও ঘুমিয়ে গেছে। সহন ফোনটা বালিশের পাশে রেখে আলতো করে তাহমির উদরে হাত বুলিয়ে দিলো বারকয়েক। ফলে তাহমির ঘুম ভেঙে গেলো। চোখ পিটপিট করে তাকাল তাহমি।
” কী করছো? ঘুমাচ্ছ না কেনো?”
” আমার চোখের ঘুম উড়িয়ে নিজে ছেলের সাথে দিব্যি ঘুমিয়ে পড়লে। বাহ তাহমি বেগম বাহ!”
তাহমি সহনের মজা বুঝতে না পেরে সিরিয়াস কিছু ভেবে উঠে বসলো। চোখ ভালো করে হাত দিয়ে মুছে আগ্রহী হয়ে শুধালো,
” কী হয়েছে? “
” কিছু হয়নি বলেই তো এতো বিরহ।”
” কীসের বিরহ বলবে তো?”
” গরমে গরম বাড়াতে পারছি না বলে বিরহ, এই গরমের রাতে একবার গোসল করতে পারছি না বলে বিরহ।”
তাহমির আর বুঝতে বাকি রইলো না কিছু। আস্তে করে দু’টো থাপ্পড় মারল সহনের পিঠে।
” শয়তান একটা! এমন করে বললে ভাবলাম কী হলো মাঝরাতে আবার। “
” এটা কিছু হয়নি? “
” ব এ আকারে বা* হয়েছে। “
” বউটা আমার আর ভদ্র হলো না। “
” ভদ্র দেখে বিয়ে করলে ভদ্র বউ থাকতো। এখন এসব কথা রেখে তাড়াতাড়ি আদর করো। আমি ঘুামবো তারপর। “
” এভাবে বলছো? থাক লাগবে না। উপোস দিলাম আমি। “
সহনের ঢং দেখে তাহমির মেজাজ খারাপ লাগে। এমনিতেই রাতে ছেলে ঘুমাতে দেয় না। এখন আবার বাপের ঢং এর জন্য জেগে থাকতে হচ্ছে।
” সহন! “
” কী সোনা?”
” কিছু না।”
” কেনো কিছু না বউ?”
” তোর কল্লা!”
” ওয়াও! কতদিন পরে সেই ডাক। আবার বল তো একবার। “
” তুই কিছু করবি? না-কি আমি করবো?”
” বউ আদর করলে বেশি আনন্দ। সুতরাং তুই আদর কর। আজকে বাসর রাত বাসর রাত ফিল হচ্ছে বুঝলি। এই যে আবারও তুইতোকারি করছিস,আমিও করছি মনে হচ্ছে অতীতের দিনগুলোতে ফিরে গেছি।”
তাহমি সহনকে শুইয়ে দিয়ে নিজে সহনের ললাটে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো।
” ছেলে ঘুমিয়েছে বলে এসব বললাম। সে তো এখন টেপরেকর্ডার হয়েছে। যা বলি তাই ঘ্যানঘ্যান করে। “
সহন ফিক করে হেসে উঠলো তাহমির কথায়। বেচারি বাচ্চা সামলাতে গিয়ে হিমশিম খাচ্ছে আজকাল। অবশ্য সাকিনও কম দুষ্টমি করে না।
” আচ্ছা আচ্ছা। এখন আর রাগ করিস না। আয় বুকে আয়,এসে আমার বুকটা শান্ত কর।”
তাহমি মুচকি হাসলো। সময় পেরোলেও ভালোবাসা কমেনি লোকটার। সহন তাহমিকে বুকে জড়িয়ে নিলো। তাহমিও সহনকে আবদ্ধ করলো নিজের মায়াজালে। শরীরের প্রতিটি জায়গায় ঠোঁট ছুঁইয়ে দিতে ব্যস্ত হয়ে উঠলো সহন। তাহমি থেকে থেকে কেঁপে উঠল কয়েকবার। আবেশে চোখ বন্ধ করে ফেলেছে ইতিমধ্যে। সহনের উষ্ণতায় উষ্ণ হয়ে উঠছে তাহমির শিরা-উপশিরা। ক্রমান্বয়ে ভারী হয়ে উঠছে দু’জন নরনারীর শ্বাস-প্রশ্বাস।
” আম্মু! আম্মু! আ্য আ্য…. টুমি কুটায়? আমাল ভয় লাকচে কিন্টু উউউ…..”
হঠাৎ সাকিনের কান্নার আওয়াজে চমকে উঠলো দু’জন। তড়িৎ গতিতে সহনকে সরিয়ে সাকিনের পাশে গিয়ে শুয়ে পড়লো তাহমি। ছেলেকে নিজের কাছে টেনে শুইয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললো,
” এই তো আমি বাবা। ভয় পেও কীসের? ঘুমাও।”
মায়ের স্পর্শ পেয়ে ঘুম জড়ানো চোখে একবার আশেপাশে নজর বুলিয়ে ফের ঘুমানোর চেষ্টা করছে সাকিন। বেচারা সহন এক জায়গায় শুয়ে দীর্ঘশ্বাস ফেললো। জীবনটা আর জীবন রইলো না। ধুরর! ভাল্লাগে না আআআআআআ……..
সমাপ্ত