আন্দ্রেজের যেনো আজকে শুধু অবাক হওয়ার পালা।
” কী বললেন কিং? “
” ধৈর্য ধরে শোনো সবটা। “
আন্দ্রেজ চুপ করে রইলো। কিং জিয়ান সবকিছুই বলতে লাগলেন। কীভাবে ইয়ান ওয়ারসকি আন্দ্রেজের মা’কে দুনিয়া থেকে সরিয়েছিল, কীভাবে বাবার থেকে ওকে আলাদা করে এই পোল্যান্ডে নিয়ে এসেছিল এবং কীভাবে আন্দ্রেজের জীবনে কোনো নারীকে আসতে দেয়নি সবকিছুই। বলাবাহুল্য, ইয়ানের উপর সন্দেহ হওয়ার পর কিং জিয়ান নিজের মায়াবলে সবকিছু জেনেছেন। সবকিছু শুনে আন্দ্রেজ একেবারে স্তম্ভিত হয়ে গেছে।
” আমি ভাবতেও পারিনি! মামা? মামা আমার সাথে এসব করেছেন! “
” মাঝে মধ্যে না চাইতেও অনেক কিছু বিশ্বাস করতে হয়। কারণ সত্যকে অবিশ্বাস করার কোনো সুযোগ নেই আন্দ্রেজ। “
দীর্ঘশ্বাস ফেললো আন্দ্রেজ। ইভানা চন্দ্রগ্রহণের সময় জন্মানো এক বিশেষ মেয়ে। একমাত্র ইভানার সাথে বিয়ে হলেই আন্দ্রেজের ভবিষ্যত প্রজন্ম ভ্যাম্পায়ার হবে বলেই জানিয়েছেন ভ্যাম্পায়ার প্রজন্মের আদি পিতা। আর ইয়ান এসব জানতো বলেই কোনো মেয়ের সাথে সম্পর্কে টিকতে দিতো না আন্দ্রেজকে।
” ঠিক বলেছেন কিং। “
” সময় সীমিত! কাছে এসো আন্দ্রেজ। “
কিং জিয়ান আধোআধো চোখে তাকিয়ে আছে আন্দ্রেজের দিকে। আন্দ্রেজ উনার দিকে এগিয়ে বসতেই মাথায় হাত রাখলেন কিং। কয়েক মুহুর্তের মধ্যে কেমন একটা উজ্জ্বল হয়ে উঠলো ঘর। আন্দ্রেজের শরীর থরথর করে কাঁপছে। সম্পূর্ণ শক্তি গ্রহণ করা শেষ হলেই ওর শরীর স্বাভাবিক হবে। খুবই অল্প সময়ের মধ্যে সবকিছু ঘটল।
” আমার কাজ শেষ কিং আন্দ্রেজ! এখন থেকে আপনিই এই ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করবেন। আশা করি আমাকে আশাহত করবেন না! আমার সময় হয়ে গেছে। “
নতুন কিং এর প্রতি সম্মান প্রদর্শন করে বললেন কিং জিয়ান। তিনি ঠোঁটের কোণে মৃদু হাসির রেখা বজায় রেখে ফের বলেন,
” বুঝতে পেরেছো আন্দ্রেজ? “
আন্দ্রেজ অসহায় দৃষ্টিতে উনার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু করার নেই ওর আর। এরমধ্যে বাইরে থেকে কারো হাঁটার শব্দ শুনতে পেলো আন্দ্রেজ। খুব সম্ভবত ঘরের ঔজ্জ্বল্যের জন্য সিলভা কিছু একটা বুঝে গেছে।
” আমি চাইলেও আপনাকে আর রাখতে পারবোনা কিং। তবে আমি কথা দিচ্ছি, দোষীদের উচিত শিক্ষা দিবো এবং আপনার রাজ্যকে প্রাণ দিয়ে আগলে রাখবো। “
আন্দ্রেজের কথায় স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন কিং জিয়ান। সেই সাথে অসাড় হয়ে গেলো উনার শরীর। অশান্তিতে ছেয়ে গেছে আন্দ্রেজের মন। এরমধ্যেই কক্ষে প্রবেশ করলো সিলভা, সাথে বেশ কয়েকজন প্রহরী।
” আন্দ্রেজ! তুমি এখন এখানে? কিং এর সাথে কী করেছো তুমি? “
সিলভা এ কথা বলে মেকি কান্না জুড়ে দিয়ে জিয়ানের কাছে এগোয়। প্রহরীরা যে যার জায়গায় দাঁড়িয়ে সবকিছু বোঝার চেষ্টা করছে। আন্দ্রেজ ইচ্ছে করে চুপ করে আছে। এই সিলভা কী করে আর বলে সেটারই অপেক্ষায় আন্দ্রেজ! সিলভা জিয়ানকে পরীক্ষা করে সবার আড়ালে মুচকি হাসলো। তারপর সবাইকে দেখানোর জন্য চিৎকার করে উঠলো।
” কিং! কিং আর আমাদের মধ্যে নেই….. এই আন্দ্রেজই কিছু একটা করেছে। প্রহরী একে বন্দী করো। “
আন্দ্রেজ যেনো এসবের জন্যই এতক্ষণ অপেক্ষা করছিল। প্রহরীরা ওর দিকে এগিয়ে আসতেই মুহুর্তেই নিজের আসল রূপে ফিরে আসে। সিলভাসহ বাকি সব প্রহরীরা আন্দ্রেজের নতুন রূপে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে। কালো আলখাল্লার ভেতরে এক জলন্ত মূর্তি দাঁড়িয়ে আছে ওদের সামনে। যার চোখে আগুনের লাভা জ্বলছে, ঠোঁটের কোণে তীক্ষ্ণ সূচাল দু’টি দাঁত, সমস্ত চেহারায় কেমন ভয়ংকর একটা ভাব! এই মুহুর্তে যেকোনো মানুষই আন্দ্রেজকে দেখলে জ্ঞান হারাবে। সিলভা কিছু বলার আগেই আন্দ্রেজ বিদ্যুৎ গতিতে ওর বাম দিকে হাত রাখে। সাথে সাথে আন্দ্রেজের ধারালো নখগুলো সিলভার বুকের ভেতর ঢুকে যায়। ব্যথায় চিৎকার করে উঠে সে। প্রহরীরা ভয়ার্ত চোখে তাকিয়ে আছে। নতুন রাজার এমন ভয়ংকর রূপে সবাই স্তম্ভিত।
” কিং জিয়ান যাওয়ার আগে সবকিছুই বলে গেছে মন্ত্রী সিলভা! তাছাড়া একটু আগে তো তুমি নিজেই সবকিছু বলে ফেললে। মামার রূপে আমিই ছিলাম তোমার সাথে। কিং জিয়ানকে কথা দিয়েছি আমি, এই রাজ্যকে বুকে আগলে রাখবো এবং তোমাদের শাস্তি দিবো।”
” দয়া করুন কিং! ছেড়ে দিন আমাকে। আমার অনেক বড়ো ভুল হয়েছে। “
অসহায় ভঙ্গিতে কাকুতিমিনতি করে বললো সিলভা। আন্দ্রেজ ক্রুর হেসে বললো,
” দয়া, মায়া এবং ক্ষমা হলো মানবিক গুণ। ভ্যাম্পায়ার কিং এর মাঝে তার কিচ্ছু নেই সিলভা। প্রতারণার একমাত্র শাস্তি হচ্ছে মৃত্যু!”
সিলভা আরকিছু বলার সুযোগ পেলো না। আন্দ্রেজ তার হৃদপিণ্ড উগড়ে ফেলেছে। যদিও ভ্যাম্পায়ারূের হৃদপিণ্ড সচল থাকে না তবে বুকের বামপাশে তাদের দূর্বলতা। আন্দ্রেজ মুচকি হেসে প্রহরীদের দিকে সিলভার হৃদপিণ্ড এগিয়ে দিয়ে বললো,
” এটাকে আগুনে পুড়িয়ে দিও। কাল সকাল থেকেল ভ্যাম্পায়ার রাজ্যে নতুন সূর্য উদিত হবে। সব দোষীরা শাস্তি পাবে। “
প্রহরীরা কোনো বাক্যব্যয় করে না। শুধু মাথা নত করে কুর্নিশ করে সিলভার হৃদপিণ্ড নিয়ে কক্ষ থেকে বেরিয়ে যায়।
ভোরের আলো ফুটেছে অনেকক্ষণ। চারদিকে পাখপাখালির কিচিরমিচির শব্দ । স্বামীর জন্য অপেক্ষা করতে করতে কখন যে চোখ লেগে এসেছিল টের পায়নি ইভানা। ঘুম ভাঙতেই পুরো রুমে নজর বুলিয়ে নিলো সে। নাহ! আন্দ্রেজ এখনো ফেরেনি। কী এমন কাজ তার, যে বিয়ের প্রথম রাতে নতুন বউকে ঘরে রেখে বাইরে যেতে হলো? মনে মনে নিজেকে শুধালো ইভানা। কিন্তু কোনো উত্তর পেলো না। বিছানা ছেড়ে উঠে দ্রুত ফ্রেশ হয়ে শাড়ি পাল্টে নিলো। লাল রঙের একটা শাড়ি পরলো সাথে হালকাপাতলা গহনা, চুলগুলো খোঁপা করে তাতে একটা লাল গোলাপও গুঁজে নিলো। যদিও আন্দ্রেজকে কাছাকাছি আসতে দেওয়াতে বেশ আপত্তি ছিলো ওর কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ভুল হয়ে গেছে। হয়তো এজন্য আন্দ্রেজ অভিমান করে দূরে সরে যাচ্ছে!
” ভাবি! ঘুম ভাঙলো তোমাদের? চলো নাস্তা করে নিবে৷ “
শিয়ার ডাকে ভাবনার ছেদ ঘটল ইভানার। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে সময় দেখে চমকাল সে। সকাল সাড়ে ন’টা কখন বাজলো? সময়ের খেয়াল হতেই দ্রুত দরজা খুলে দিলো ইভানা।
” সরি গো! এতো লেট হয়েছে বুঝতে পারিনি। “
” আরে সমস্যা নেই। ভাইয়া কোথায়? এখনো ঘুমোচ্ছে নাকি! “
শিয়ার প্রশ্নে চোখমুখ শুকিয়ে গেছে ইভানার। আন্দ্রেজের বাড়ির বাইরে থাকার বিষয়টা নিয়ে সবাই কী না কী ভাববে!
” আসলে উনি বাড়িতে নেই। “
” মানে? “
” রাতেই বেরিয়ে গেছেন। কোনো একটা জরুরি কাজ আছে বললেন তাই মানে…”
শিয়া বিষয়টা এড়াতে বললো,
” আচ্ছা। চলো নাস্তা করে নিবো। আমিও তোমাদের জন্য অপেক্ষা করছিলাম। “
” হুম চলো। “
শিয়ার সাথে ডাইনিং টেবিলের উদ্দেশ্য চলে যায় ইভানা। মনে মনে ভীষণ অস্বস্তি হচ্ছে ওর। এক তো নতুন বউ এতো বেলা করে উঠলো তার উপর স্বামী বাড়িতে নেই!
কিন্তু না! ডাইনিং টেবিলে যেতেই ওর সমস্ত অস্বস্তি কেটে যায়। ওয়াসিম চৌধুরী ইভানাকে খুব স্নেহ করেন। যদিও এ্যানি চৌধুরী ঠেস দিয়ে কিছু কথা বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু ওয়াসিম চৌধুরীর জন্য তা আর পারেননি। আর উনিও এটাও বলেন, আন্দ্রেজ জরুরি কাজে একদিন পর ফিরবে। শ্বশুরের মুখে স্বামীর খবর শুনে একটু হলেও স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছে ইভানা। কিন্তু মনে মনে দারুণ অভিমান জমিয়ে রেখেছে।
সন্ধ্যা বেলা, শুক্রবার। ছাদে দাঁড়িয়ে আছে ইভানা। মাঝে মধ্যে দক্ষিণা বাতাস এসে ওর খোলা চুলগুলো একটুআধটু এলোমেলো করে দিচ্ছে। একটু আগেই বাসায় ফিরেছে আন্দ্রেজ। একদিনের জায়গায় ঠিক দু’দিন পর বাড়িতে ফিরলো সে। সেজন্য আসা থেকে প্রয়োজন ছাড়া একটা কথাও বলেনি ইভানা। বিয়ের আগ পর্যন্ত ইভানার প্রতি আন্দ্রেজের যতটা টান ছিলো বিয়ে হতেই যেনো সবটা ফিকে হয়ে গেছে বলে মনে হচ্ছে ইভনার।
” রাগ কি বেশি করেছো ইভা? “
আচমকা পেছন থেকে জড়িয়ে ধরায় একটু চমকে উঠেছে ইভানা। আন্দ্রেজ ওর কাঁধে থুতনি রেখে একহাতে ওর শরীরে স্লাইড করছে। ফলস্বরূপ সুড়সুড়ি লাগছে ইভানার।
” আগে হাত সরান! আমার সুড়সুড়ি লাগছে উঁহু… “
ইভানার অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে ফেললো আন্দ্রেজ। নিজের হাত দু’টিকে শান্ত করে বললো,
” দিলাম ফিলিংস জাগানোর জন্য আর আমার বউয়ের লাগছে সুড়সুড়ি! সবই কপাল আমার। “
” চুপ করুন! ঢং করতে হবে না হুহ্। “
আন্দ্রেজ খেয়াল করলো ইভানা আবারও আগের মতো চঞ্চল হয়ে উঠেছে। তারমানে মনে মনে ক্ষমা করে দিয়েছে ওকে? হ্যাঁ! বেশ খুশি খুশি লাগলো আন্দ্রেজের। খুশিতে আর অপেক্ষা করতে না পেরে বউকে কোলে তুলে নিলো। ইভানা ফের বললো,
” কী করছেন? “
” চোখ বন্ধ করো। “
” নাহ! “
” করো বলছি!”
” ঠিক আছে। “
” তোমাকে কিছু দেখাবো তবে হ্যাঁ ভয় পাবে না। আমি তোমাকে ভালোবাসি এবং আগলে রাখবো। “
ইভানা আন্দ্রেজের কথার আগামাথা না বুঝলেও চোখ বন্ধ করে মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো। প্রায় পাঁচ মিনিট পর আন্দ্রেজ ইভানাকে চোখ খুলতে বললো। বলা মাত্রই চঞ্চল হরিণী তার চোখ মেলে তাকালো। কিন্তু পরক্ষণেই ভয়ে চোখ বন্ধ করে শক্ত করে আন্দ্রেজের গলা জড়িয়ে মৃদু চিৎকার করে উঠলো সে।
” এসব কী! আল্লাহ আমি তো মরে যাবো! আমার কি হয়েছে? এসব কি ভুলভাল দেখছি! “
” শান্ত হও ইভা। ধীরে ধীরে চোখ মেলে তাকাও। তুমি যা কিছু দেখছো সবকিছুই সত্যি। আগে শান্ত হও তারপর সব বলি? “
আন্দ্রেজের কথায় দ্বিতীয় বার চোখ মেলে তাকালো ইভানা। এবার ভয়টা একটু কম। চারদিকে নজর দিতেই বুকটা কেমন করে উঠলো। খোলা আকাশে ওকে কোলে নিয়ে ভাসছে আন্দ্রেজ! তার উপর আন্দ্রেজের পিঠে দু’টো পাখা! এসবকিছু কীভাবে সম্ভব হচ্ছে সেটাই বোধগম্য হচ্ছে না ইভানার।
” তোমার সব প্রশ্নের উত্তর আমি দিচ্ছি ইভা।”
” আপনি কি মন পড়তে পারেন? “
ইভা বললো। আন্দ্রেজ পাখা ঝাপটিয়ে আরেকটু উঁচুতে পৌঁছে বললো,
” আগে পারতাম না কিন্তু এখন পারি। “
” ও আচ্ছা। কিন্তু কীভাবে? “
” বলছি..”
ইভানার প্রশ্নের উত্তরে আন্দ্রেজ শুরু থেকে সবকিছুই খুলে বললো। ওর ড্যাম্পায়ার হওয়ার কথা, ওর মায়ের কথা, কিং হওয়ার কথা সবকিছু। প্রথমে ইভার এসব বিশ্বাস করতে কষ্ট হচ্ছিল ঠিক কিন্তু চোখের সামনে সবকিছু দেখে অবিশ্বাস করারও কোনো ব্যাপার নেই। সব শুনেও ইভানা আগের মতোই আন্দ্রেজকে ভালোবাসবে বলে জানায়। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললো আন্দ্রেজ। আজ থেকে আন্দ্রেজ ও ইভানার নতুন জীবনের শুরু। এরপর শীঘ্রই পোল্যান্ডে ফিরে যাবে ওরা। ভালো থাকুক ভালোবাসা।
সমাপ্ত