মেরি জান 3

(মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
“ ওয়াট! কী বলছো ম্যাক! ইলোনা….”
আন্দ্রেজ কথা শেষ করতে পারে না। কেমন দম বন্ধ হয়ে আসছে ওর। বিছানায় শুয়ে ছিলো এতক্ষণ। খবরটা পেয়ে বসে আছে। মেয়েটাকে যদি গতকাল রাতে একা যেতে না দিতো তাহলে আজ হয়তো সে জীবিত থাকতো। রাগে-দুঃখে নিজের হাতের ফোনটা সজোরে ফ্লোরে ছুড়ে ফেললো আন্দ্রেজ। হাতে সময় নেই, ওয়ারিককে সামলাতে হবে। একমাত্র বোন ছাড়া পৃথিবীতে আর কেউ নেই ওর। তাছাড়াও এই মুহুর্তে একটু-আধটু শোক তো দেখাতেই হবে।
সময়টা দুপুরবেলা। ওয়ারিশের আকাশে আজ ঝলমলে রোদ্দুর। শীতের কনকনে ঠান্ডায় একটুকরো রোদ এখানকার লোকজনকে একটু হলেও উষ্ণতা প্রদান করে। পুলিশ স্টেশনে বসে আছে ওয়ারিক। প্রশাসন সাধারণ প্রশ্ন করার জন্য ডেকে পাঠিয়েছিল উনাকে। যদিও সবকিছু শুনে আন্দ্রেজের উপরই সব সন্দেহ গেছে। কিন্তু গাড়ির ওরকম অবস্থা কোনো মানুষের পক্ষে করা সম্ভব না এটা সবাই বুঝতে পেরেছে। পুলিশ বিষয়টা তদন্ত করার জন্য রাস্তায় অবস্থানরত টহলকারী ট্রাফিক পুলিশকেও জিজ্ঞাসাবাদ করেছে। এমনকি সিসিটিভি ফুটেজও চেক করেছে। কিন্তু আশ্চর্যের বিষয় হলো কেউ কিছু দেখেনি আর না তো ক্যামেরায় কাউকে দেখা গেছে। একা একা কীভাবে গাড়িটা মুহুর্তের মধ্যে চুরমার হয়ে গেছে এটাই একটা ওয়ারিশ শহরের সবচেয়ে বড়ো রহস্য। যেহেতু মৃত্যুটা অস্বাভাবিক এবং আন্দ্রেজের বিপক্ষে কোনো প্রমাণ নেই, তাই পুলিশ আন্দ্রেজকে সন্দেহ করলেও গ্রেফতার করতে পারবে না।
” ওয়ারিক! আই এম সরি। রিয়েলি সরি ফর এভরিথিং। আমার ভুল সব। আমি যদি ইলোনাকে একা না ছাড়তাম তাহলে আজ এসব কিছু হতোনা। “
ওয়ারিকের হাত ধরে ফ্লোরে হাঁটু গেড়ে বসে অনুনয় করে বললো আন্দ্রেজ। ওয়ারিক এমনিতেই ভেঙে পড়েছে। তার উপর আন্দ্রেজের সহানুভূতি পেয়ে আরো গলে গেলো।
“দার্জ নো মিস্টেক অন ইয়োর পার্ট, আন্দ্রেজ। এভ্রিথিং ইজ ডেস্টিনি। আই’ভ সীন হাউ দ্য কার…”
( “তোমার কোনো ভুল নেই, আন্দ্রেজ। সবকিছু ডেস্টিনি। আমি দেখেছি কীভাবে গাড়িটা…”)
ওয়ারিক কথা শেষ করতে পারলো না। আন্দ্রেজকে জড়িয়ে ধরে কান্না করতে শুরু করেছে লোকটা। বোনের আকস্মিক মৃত্যুতে খুব দূর্বল হয়ে গেছে। আন্দ্রেজ বিকেল পর্যন্ত ওয়ারিকের সাথে থাকে। সকল প্রশাসনিক ঝামেলা মিটিয়ে ইলোনার লাশ ওয়ারিককে বুঝিয়ে দিয়ে তারপর নিজের মামার কাছে চলে যায় আন্দ্রেজ ।
শীতল হাওয়া বইছে বাইরে। জানালার পর্দা একটু-আধটু নড়ছে। হয়তো তুষারপাত বাড়বে বলে সন্দেহ হচ্ছে আন্দ্রেজের। সোফায় বসে আরামসে বিয়ারের বোতলে চুমুক দিচ্ছে সে। আন্দ্রেজের সামনে ফায়ারপ্লেসের আগুন জ্বলছে। যা ঘরটিকে আরামদায়ক উষ্ণতায় ভরিয়ে দিয়েছে। আগুনের নরম আলো এবং গরম তাপ আন্দ্রেজের মনকে একটু হলেও প্রশান্তি এনে দিচ্ছে। অভিনয় করতে একদম ভালো লাগে না ওর। তবুও আজ ওয়ারিকের সাথে অভিনয় করতে হলো। আসলে কোনো আইনি ঝামেলায় পড়তে চায়নি আন্দ্রেজ। ইলোনার মৃত্যুতে যে খারাপ লাগেনি সেটাও নয়। কিন্তু যতটা ওয়ারিকের সামনে প্রকাশ করেছিল ততটা উদগ্রীবও নয় আন্দ্রেজ।
” আন্দ্রেজ! “
মাঝবয়েসী ইয়ান এসে আন্দ্রেজের মুখোমুখি সোফায় বসলেন। উনার হাতেও নেশাদ্রব্য। নেশা যেনো এদের রক্তে মিশে গেছে।
” ইয়েস মামা। “
” আমি তোমাকে বলেছিলাম, আর কারো সাথে সম্পর্কে যেওনা তুমি। তোমার সাথে সাধারণ কোনো মেয়ে থাকতে পারবে না আন্দ্রেজ। “
আন্দ্রেজ পরপর কয়েকবার বিয়ারের বোতলে চুমুক দিয়ে সবটুকু বিয়ার শেষ করে ফেললো। ইয়ানের কথায় কোনো ভুল নেই। কিন্তু শারীরিক চাহিদা মেটাতে অবশ্যই সম্পর্কে জড়াতে হয় ওকে। তবে চাইলে সবকিছু থেকে দূরে সরে এসে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে আন্দ্রেজ। কিন্তু কেনো অহেতুক নিজের সাধ-আহ্লাদ পুরণে কার্পণ্য করবে সে? আন্দ্রেজ হাতের বোতলটা টি-টেবিলের ওপর রাখলো। পকেট থেকে সিগারেট বের করে ঠোঁটে গুঁজে আঙুলের সাহায্যে তুড়ি মেরে কীভাবে যেনো আগুন ধরাল তাতে।
” কিন্তু মামা বুঝতেই তো পারছো! “
” তুমিও বোঝার চেষ্টা করো। “
” ঠিক আছে। আমি আর কোনো সম্পর্কে জড়াবো না তবে….”
” সে তুমি যা ইচ্ছে করো। শুধু আর কোনো মেয়েকে নিজের সাথে জড়িয়ে মরে যেতে বাধ্য করো না। আমাদের সোসাইটি তোমাকে কোনো সাধারণ মানবীর সাথে সম্পর্কে থাকতে দিবে না। কারণ তুমি নিজেই পুরোপুরি আমাদের সোসাইটির নও। এমনিতেই তোমাকে নিয়ে অনেক ঝামেলা হয়েছিল। এখন অবশ্য তুমি তোমার যোগ্যতার সাথে নিজের স্থান পাকাপোক্ত করে নিয়েছো। “
ইয়ানের কথায় ভীষণ মনোযোগী আন্দ্রেজ। মাঝে মধ্যে অবশ্য সিগারেটের ধোঁয়া ছাড়ছে।
” বুঝতে পেরেছি। থাকো একটু ঘুমাবো। সারাদিন ঝামেলা গেছে অনেক। “
ইয়ান দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। এই বুঝলো আন্দ্রেজ? কথা শেষ হওয়ার আগেই পালাইপালাই ভাব।
” ওকে। গুড নাইট। “
” গুড নাইট মামা। “
” কল মি আঙ্কেল আন্দ্রেজ! “
ইয়ান কিছুটা হতাশাগ্রস্ত হয়েই বললেন। আন্দ্রেজ ফিক করে হেসে উঠলো। দোতলার সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে বাঁকা হেসে বললো,
” মামাকে মামাই ডাকবো আঙ্কেল নয়। ওকে মামা? যাচ্ছি মামা!”
ইয়ান বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললেন। ছেলেটা ছোটো থেকেই সহজে কথা শোনে না। বোনকে খুব ভালোবাসতেন ইয়ান। সেজন্যই তো তার একমাত্র ছেলেকে নিজের কাছে এনে রেখেছেন।
ঢাকা শহরে রোদের দেখা মেলেনি গতকাল। আজকে মেঘলা আকাশ। উত্তরাঞ্চলের অবস্থা তো আরো খারাপ। এরমধ্যেই ওদিকে শৈত্য প্রবাহের কবলে সাধারণ মানুষের জীবন বিপর্যস্ত হয়ে গেছে। আজকে শিয়ার জন্মদিন। শিয়া চৌধুরী বাড়ির একমাত্র মেয়ে। একমাত্র মেয়ের জন্মদিন নিয়ে ভীষণ এক্সাইটেড এ্যানি চৌধুরী। দুপুরের আগ পর্যন্ত স্বামীকে সাথে নিয়ে বেশকিছু কেনাকাটা করেছেন। সন্ধ্যা বেলায় বিরাট পার্টির আয়োজন করেছেন তিনি। বাড়িতে অবশ্য পার্টি হচ্ছে না। মেয়েকে এবার সারপ্রাইজ দিতে চান তিনি।
তবে এসবকিছু না জানার দরুন বেচারি শিয়া সকাল থেকে নিজের ঘরেই শুয়ে আছে। মাঝখানে শুধু নাস্তা করতে নিচে নেমেছিল। মনটা তার আজ বেজায় খারাপ। খারাপ থাকবেই না কেনো? তার বাবা-মা কেউ তাকে এখনো পর্যন্ত উইশ করেনি। বাবা-মা না হয় ভুলে গেলো কিন্তু আন্দ্রেজ ভাইয়া? সে-ও বা কীভাবে ভুললো! দুঃখে শিয়ার ঠোঁট উল্টে কান্না পাচ্ছে। শিয়ার আজ তেইশতম জন্মদিন। বাইশটি বসন্ত পেরিয়ে আজ তেইশের ঘরে পা রাখলো সে।
” শিয়া! লাঞ্চের টাইম হয়ে গেছে। খেতে এসো মামুনি। “
মায়ের ডাক কর্ণকুহরে পৌঁছালেও শিয়া কোনো প্রত্যুত্তর করলোনা। এ্যানি চৌধুরীও কম যান না। তিনিও আরো কয়েকবার ডাকলেন মেয়েকে। শেষমেশ বাধ্য হয়ে মায়ের ডাকে সাড়া দিলো শিয়া।
” আসছি। “
শোয়া থেকে উঠে প্রথমেই আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে নিজের চুলগুলো পরিপাটি করে আঁচড়ে নিলো। তারপর দুই হাতের সাহায্যে মেসি বান করে ঘর থেকে বেরিয়ে গেলো। মেয়েটা ভীষণ স্বাস্থ্য সচেতন। হবে না-ই বা কেনো? এ্যানি চৌধুরী তো কম নন। এই বয়সে এসেও নিজের সৌন্দর্যের দিকে পূর্ণ নজর রাখেন তিনি।
সারাদিন অপেক্ষা করতে করতে যখন একেবারে ক্লান্ত শিয়া ঠিক তখুনি আন্দ্রেজ কল দিলো। ভাইয়ের সাথে শিয়ার সম্পর্ক বেশ অন্য রকম। এ্যানি চৌধুরীকে অপছন্দ করলেও শিয়াকে নিজের বোনের মতোই ভালোবাসে আন্দ্রেজ।
” হ্যাপি বার্থডে টু ইউ শিয়া! “
শিয়া মুখ গোমড়া করেই বললো,
” হয়েছে। আর লাগবে না উইশ। আমার কেউ নাই, কিচ্ছু নাই। “
” লিসেন শিয়া, তুমি এখন তোমার আলমারি খুলবে। তারপর লাল রঙের সুন্দর একটা পোশাক পাবে। সেটা পরে খুব সুন্দর করে সেজেগুজে নিচে চলে যাবে। ড্রাইভার চাচা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। উনার সাথে গাড়িতে চেপে বসে আমাকে কল দিও, ওকে? “
শিয়া চমকাল আন্দ্রেজের কথায়। এসবের মানে কী? তবে তার ভাই যখন বলেছে সবকিছুই করবে সে।
” ওকে ভাইয়া।”
শিয়ার কথা শেষ হতেই কল কেটে দিলো আন্দ্রেজ । ভাইয়ের কথামতো সবকিছু করে গাড়িতে উঠে আবারো কল দিলো। কিন্তু কল রিসিভ করলোনা না আন্দ্রেজ। বরং তার বদলে একটা টেক্সট করে দিলো-
❝ সাবধানে যাও। তোমার জন্য ভালো কিছু অপেক্ষা করছে। ❞
শিয়া মুচকি হাসলো আন্দ্রেজের টেক্সট দেখে। নিশ্চিত সবাই মিলে সারপ্রাইজ দিবে বলেই এতো ভনিতা!
ওয়ারিশ শহরের অন্যতম উদ্ভাবনী প্রযুক্তি কোম্পানি হলো নেক্সটটেক ইনোভেশনস। এতো বড়ো কোম্পানিতে ইভানার সিনিয়র সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে চাকরির প্রথম দিন আজ। বাংলাদেশের একটি মধ্যবিত্ত পরিবারের মেয়ে হয়ে পোল্যান্ডের এতবড় কোম্পানিতে আসার পথটা বেশ কঠিন ছিলো ইভানার জন্য। তবে আজ তার সমস্ত কষ্ট সার্থক হয়েছে। ইভানা নিজেকে আরেকটি বার ভালো করে পর্যবেক্ষণ করে কোম্পানির গেটের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। ফর্মাল পোশাক পরে বেশ দারুণ লাগছে তাকে। তবে মজার ব্যাপার হলো এতগুলো পোলিশদের মধ্যে নিজেকে বেশ অদ্ভুত লাগে ওর। যেখানেই চলাফেরা করুক না কেনো সবাই কেমন অদ্ভুত দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে থাকে। দেখে মনে হয় এরকম শ্যামবর্ণের মেয়ে তারা আর জীবনেও দেখেনি। যদিও ইভানা বেশ সুন্দরী তবে পোল্যান্ডের সাদা চামড়ার মানুষের কাছে শ্যামবর্ণ বলাই ঠিক আছে। হাস্যজ্বল মুখে কোম্পানিতে প্রবেশ করেছে ইভানা। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ডেস্কের দিকে।
চলবে,

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *