(মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
হাস্যজ্বল মুখে কোম্পানিতে প্রবেশ করেছে ইভানা। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যাচ্ছে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ডেস্কের দিকে।
” হাই ইভানা, আই’ম ম্যাক। আই’ম দ্য সিইও’জ পারসোনাল অ্যাসিস্ট্যান্ট।”
হাসিমুখে ইভানার দিকে এগিয়ে এসে বললো ম্যাক। ছেলেটা ভীষণ হাসিখুশি থাকে সব সময়। ব্যক্তিগত সহকারী হিসেবে আন্দ্রেজের সাথে আছে গত পাঁচ বছর ধরে। নেহাৎ ম্যাক বলেই এতদিন চাকরিতে টিকতে পেরেছে। আন্দ্রেজের অদ্ভুত মেজাজ সবাই সহ্য করতে পারে না।
” হাই ম্যাক। তুমি তো আমার পরিচয় অলরেডি জানো! “
” হ্যাঁ। এই হচ্ছে তোমার জন্য বরাদ্দকৃত ডেস্ক। আশা করি তোমার কর্মজীবন সুখের হবে। “
ম্যাক কথা শেষ করতেই ওর ফোনটা ভাইব্রেট করে উঠলো। আন্দ্রেজের রুমের দিকে তাকিয়ে দেখলো ওর দিকেই তাকিয়ে আছে ।
” পরে কথা হবে ইভানা। বস ডাকছেন আমাকে। “
ইভানার প্রত্যুত্তরের অপেক্ষা না করেই ম্যাক ছুটলো আন্দ্রেজের রুমের দিকে।
ইয়ান ওয়ারসকি হলেন নেক্সটটেক ইনভেনশনস কোম্পানির মালিক। উনার একমাত্র ভাগিনা আন্দ্রেজই তাই এই কোম্পানির সর্বেসর্বা এখন। বলাবাহুল্য, ইয়ান বিয়ে করেননি। সেজন্য আন্দ্রেজ ছাড়া উনারর অর্থসম্পদ ভোগ করার মতো আর কেউ নেই।
ম্যাক রুমে ঢুকেছে। আন্দ্রেজের রুমে ফ্রস্টেড গ্লাস সিস্টেম। মানে দরজার অংশটুকু বাদে বাকি অংশ কাঁচের। আন্দ্রেজ ইচ্ছে করলে দেখতে পারে বাইরে কে কী করছে আবার বাইরে থেকেও দেখা যায় বস কী করছেন। তবে সুবিধামতো আন্দ্রেজ কাঁচটি অস্বচ্ছ করে দিতে পারে। ফলে এটি সাধারণ দেয়ালের মতো কাজ করে এবং ভেতর কিংবা বাইরে থেকে কিছু দেখা যায় না।
” কাজে ফাঁকি দিচ্ছেলে তুমি ম্যাক? “
আন্দ্রেজের শান্তস্বরে জিজ্ঞেস করা প্রশ্নটাও খুব ভয়ংকর শোনাল ম্যাকের কাছে। এখন কি বলা ঠিক হবে অফিসে নতুন কর্মচারী এসেছে, তার সাথে একটু কথা বলছিল? নাকি সরাসরি এড়িয়ে যাবে! এড়িয়ে যাওয়া তো যাবে না। কারণ বস তো সবকিছুই দেখে ফেলেছে।
” আসলে স্যার অফিসে নতুন এমপ্লয়ি এসেছে, সিনিয়র সফটওয়্যার ইন্জিনিয়ার ইভানা আহমেদ। উনার সাথে একটু…”
” আহমেদ! বাংলাদেশি? “
আন্দ্রেজ কিছুটা কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলো। ম্যাক যেন সুযোগ পেয়ে বসলো । কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই হাসিমুখে ইভানার সমস্ত তথ্য উপস্থাপন করতে শুরু করলো সে।
” জি স্যার। ইভানা বাংলাদেশ থেকে এসেছে। মেয়েটির সাথে কথা বলে খুবই ভালো লাগলো। মনে হচ্ছিল খুব মিশুক এবং… “
” হয়েছে। চুপ করো তুমি। আমি জাস্ট জিজ্ঞেস করেছি, বাংলাদেশি কি-না। আর তুমি শুরু করলে কী? “
নিজের বকবকানি যে কোন লেভেলে পৌঁছে গেলে আন্দ্রেজ স্যারের সামনে এরকম কথা বলতে থাকা যায় তা ভালো করে বুঝতে পারছে ম্যাক। এখুনি হয়তো রিজাইন লেটার হাতে ধরিয়ে দিবে লোকটা!
” আহহ আমি দুঃখিত স্যার। আপনার কি কিছু লাগবে? “
আন্দ্রেজ টেবিলের উপর রাখা সিগারেটের প্যাকেট থেকে একটা সিগারেট ঠোঁটে গুঁজে ম্যাকের দিকে ইশারা করলো। ম্যাক জানে ওকে কী করতে হবে। তাই কালক্ষেপণ না করে দ্রুত সিগারেটে আগুন ধরাল। আন্দ্রেজ চোখ বন্ধ করে সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে দিয়ে ম্যাকের দিকে তাকাল।
” আজকে আর কয়টা মিটিং আছে? “
ম্যাক ফোন থেকে মিটিংয়ের সময়সূচি দেখে বলতে লাগলো,
” দুপুর আড়াইটার সময় মিটিং আছে স্যার। আমরা ওয়ান কোম্পানির সাথে এআই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করার প্রস্তাব দেবো।”
” হুম। ঠিক আছে। তুমি এখন যেতে পারো। “
” ওকে স্যার। “
ম্যাক কথা শেষ হতেই রুম থেকে বেরিয়ে এলো। ইভানা নিজেকে ডেস্কে বসে কাজ করছে। ম্যাক আবারো ওর পাশে এসে দাঁড়িয়ে নিজে থেকেই কথা বলতে শুরু করলো।
” শোনো ইভানা, আমাদের বস কিন্তু খুব রাগী আর অদ্ভুত ধরনের মানুষ। তাই বুঝেশুনে কাজ করবে। “
ইভানা মুচকি হাসলো। ল্যাপটপের দিকে দৃষ্টিপাত করেই ম্যাকের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বললো,
” শুনেছি স্যার সব সময় অফিসে আসেন না? “
” ইয়ান স্যার তো অফিসে কম আসেন। বিশেষ করে যেদিন মেঘলা আকাশ থাকে সেদিন আসেন। সেজন্য গত চার বছর ধরে আন্দ্রেজ স্যারই কোম্পানির প্রধান। ইয়ান স্যার এখন কখনোসখনো গুরুত্বপূর্ণ কোনো দরকার হলেই আসেন কেবল। “
ইভানা যেমন সহজসরল, হাসিখুশি প্রকৃতির মেয়ে তেমনই খুব কৌতুহলীও বটে। ইয়ানের সাথে মেঘলা আকাশের কী যোগসূত্র সেই বিষয়টা নিয়ে বেশ কৌতুহল হচ্ছে ওর।
” আচ্ছা ম্যাক, ইয়ান স্যার রৌদ্রজ্বল দিনে কখনো অফিসে আসেননি? “
ম্যাক ভাবতে লাগলো। কিন্তু গত পাঁচ বছরের স্মৃতিপট হাতড়ে এমন কোনো দিনের কথা মনে পড়লোনা ওর।
” না। উনার সম্ভবত কোনো শারীরিক সমস্যা আছে। উনি রোদ সহ্য করতে পারেন না। “
” ওও আচ্ছা। ম্যাক! “
হঠাৎ ইভানা ম্যাকের নামটা বেশ জোরেসোরে বলাতে চমকাল ও। ইভানার দৃষ্টি ম্যাকের পেছনে। ম্যাক ভয়ে ভয়ে পেছনে তাকিয়ে দেখল আন্দ্রেজ দাঁড়িয়ে আছে। এরমধ্যে ইভানা আন্দ্রেজের আপাদমস্তক নজর বুলিয়ে নিয়েছে। সাদা রঙের শার্টের সাথে ধূসর রঙের ব্লেজার, প্যান্ট পরনে তার। নীলচে চোখের মনি জোড়া কেমন অদ্ভুত! ঘাড় অবধি বাদামী রঙের চুলগুলো খুব সুন্দর লাগছে।
” স্যা..স্যার আপনি! “
” কেনো কথা বলাতে খুব সমস্যা হলো? “
” না মানে আসলে…আসলে আমার অনেক কাজ এখন ইভানা পরে কথা হবে। “
ম্যাক দ্রুত গিয়ে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত ডেস্কে বসে পড়লো। ইভানা আন্দ্রেজকে নিয়ে তার স্বপ্নের রাজ্যে হারিয়ে গেছে এতক্ষণে। এতো সুন্দর, সুদর্শন পুরুষ সারাজীবনে হয়তো দেখেনি ও। ঠিক সুদর্শন হওয়ার জন্য নয়, আন্দ্রেজের মধ্যে অন্য কিছু একটা আছে।
” হেই মিস? “
আন্দ্রেজের কথা ইভানার কর্ণকুহরে পৌঁছেনি। তার স্বপ্নলোকে আজ এক অচেনা রাজকুমারের প্রবেশ ঘটেছে ।
” মিস ইভানা? “
হঠাৎ আন্দ্রেজের মুখে উচ্চস্বরে নিজের নাম শুনতেই ঘোর কাটল ইভানার। থতমত খেয়ে গেছে বেচারি।
” ইয়েস স্যার! “
” ম্যাককে বেশি পাত্তা দিবে না তুমি। ছেলেটা অতিরিক্ত কথা বলে। আর হ্যাঁ শুনলাম তুমি বাংলাদেশ থেকে এসেছো? মন দিয়ে কাজ করো। অতদুর থেকে এসেছো যখন নিজের একটা ভালো পজিশন গড়ে নাও। “
” ইয়েস স্যার। “
” ওকে। “
আন্দ্রেজ চলে যেতেই চাপা নিঃশ্বাস ফেললো ইভানা। এতক্ষণ মনে হচ্ছিল দম বন্ধ করে ছিলো। স্যার তো বাংলা বললো স্পষ্ট! তারমানে উনিও বাঙালী? ম্যাকও বাংলা বলে! হয়তো স্যারের থেকে শিখেছে। কিন্তু ম্যাক যেরকম স্যারকে ভয় পায় ততোটা ভয় পাওয়ার মতোও তো রাগী মনে হলোনা স্যারকে? মনে মনে এসব ভাবছে ইভানা। হঠাৎ খেয়াল হলো করলো, স্যারের দিকে হয়তো একটু বেশিই খেয়াল করে ফেলছে।
নিস্তব্ধ রজনী। শহরের অধিকাংশ লোক এখন ঘুমের কোলে আচ্ছন্ন হয়ে আছে। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে আছে আন্দ্রেজ। অস্থিরতা ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে ওর। ইলোনাকে একটু-আধটু মিস করছে। তবে ভালোবাসার জন্য নয়,বরং অন্য কিছুর জন্য। শেষবারের মতো যখন ঘনিষ্ঠ হয়েছিল ইলোনা খুব জোড়াজুড়ি করছিল। হয়তো খুবই কষ্ট হচ্ছিল ওর। কিন্তু কী করবে আন্দ্রেজ? নিজেকে কিছুতেই সামলাতে পারেনা ও। বিয়ার, সিগারেট আর মেয়ের নেশা ছাড়া কী আছে ওর জীবনে? ইয়ান ছাড়া কেউ কখনো ওকে ভালোবাসেনি! নিজের বাবাও না। হঠাৎ বাবার কথা মনে হতেই মেজাজটা আরো বিগড়ে গেলো আন্দ্রেজের। বিক্ষিপ্ত মন নিয়ে জানালা দিয়ে বাইরে দৃষ্টিপাত করতেই ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ফুটে উঠলো ওর। সেকেন্ডের ব্যবধানে চোখ বন্ধ করতেই জানালা ভেদ করে বাড়ির সামনের রাস্তায় এসে দাঁড়াল আন্দ্রেজ। একটু দূরে কিছু বখাটে ছেলেদের আড্ডা দেখা যাচ্ছে। খুব সম্ভবত একটা মেয়েকে উত্যক্ত করছে ওরা। কিন্তু এতরাতে মেয়েটারও বা কী দরকার বাইরে? আন্দ্রেজ আরেকবার চোখ বন্ধ করে চোখের পলকে ওদের সামনে গিয়ে দাঁড়াল। আচমকা আন্দ্রেজকে এভাবে আসতে দেখে সবাই ভড়কে গেছে। কিন্তু আন্দ্রেজের নজর সুন্দরী মেয়েটির দিকে। পরনে তার স্কিন-ফিটেড জিনস এবং সে*ক্সি টপ, চুলগুলো পনিটেইল করা, মুখে বেশ আকর্ষণীয় মেকআপ। দেখে মনে হচ্ছে সার্ভিস গার্ল। আশেপাশে কোথাও সার্ভিস দিতেই এসেছিল।
” হু আর ইউ?”
আন্দ্রেজকে উদ্দেশ্য করে একটা ছেলে জিজ্ঞেস করলো। এই সুযোগে মেয়েটি আন্দ্রেজের পিছনে এসে দাঁড়িয়েছে।
” সেটা তোমাদের জানতে হবে না। ওকে আমার সাথে যেতে দাও। তোমরা তোমাদের মতো থাকো। “
” সেটা সম্ভব না। আমাদের ওকে লাগবে। “
” তাই নাকি? আন্দ্রেজ ওয়ারসকির সামনে দাঁড়িয়ে এতো বড়ো বড়ো কথা বলছো?”
হঠাৎ আন্দ্রেজের দিকে ভালো করে তাকাল সবাই। আসলেই তো! এই পাড়ার কেনো সারা শহরের অন্যতম বড়লোক ওয়ারসকি পরিবার! ছেলেগুলো নিজেদের মধ্যে কথা বলতে শুরু করেছে। আন্দ্রেজ মৃদু হেসে মেয়েটির হাত ধরে বললো,
” চলো। “
” কোথায়? “
” আমার সাথে রাতের বাকি সময়টা থাকো। টাকাপয়সা নিয়ে কোনো সমস্যা হবে না। তিনগুণ বেশি দিবো। রাজি?”
” শিওর! “
আন্দ্রেজ মুচকি হেসে মেয়েটিকে কোলে তুলে নিলো। বখাটে ছেলেগুলো আর কিছু বললো না। জলে থেকে তো আর কুমিরের সাথে লড়াই করা সাজে না।
চলবে,