মেরি জান
(মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
রাতের গাঢ় নীল আকাশে তারার ঝলকানি ঝলমল করছে। তুষারপাতের সূক্ষ্ম সাদা বরফের কণাগুলো শহরের উপরে বেশ শান্তভাবে পড়ছে। পোল্যান্ডের রাজধানী ওয়ারশার রাস্তাগুলি এখন বরফে ঢেকে গেছে। মৃদু শীতল বাতাসে ভেসে আসছে পথচারীদের পদধ্বনির শব্দ। শহরের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্যাসেজ বারে আজ জমকাল ককটেল পার্টি চলছে। বারে উপস্থিত সবাই তাদের নিজেদের মতো সময় উপভোগ করায় ব্যস্ত। শুধুমাত্র আন্দ্রেজ পার্টির একপাশে নীরবে বসে আছে। ধূসর রঙের স্যুট, প্যান্ট পরনে তার। ধবধবে ফর্সা চেহারার হলেও কিছুটা চাপা ওর গায়ের রঙ। পুরোপুরি পোলিশদের মতো নয়। এর কারণ অবশ্য পরে বলবো। আন্দ্রেজের চুলগুলো বাদামী বর্ণের, নীলাভ চোখের মনি জোড়া জ্বলজ্বল করছে যেনো। কিছুক্ষণ পরপর হাতে রাখা বিয়ারের বোতল থেকে কিছু পানীয় পান করছে সে। দৃষ্টি তার অষ্টাদশী ইলোনার প্রতি নিবদ্ধ। ইলোনা আন্দ্রেজকে দেখতে পায়নি। বন্ধুদের সাথে কোমর দুলিয়ে হালকা-পাতলা নাচে বিভোর সে। কালো রঙের গাউনের সাথে একটি শীতের জ্যাকেট পরে আছে ইলোনা। সোনালী রঙের চুলগুলো পোনিটেল করা ওর। ওয়ারিশে এখন শীতকাল। এ সময় গরম জামাকাপড় না পরে বের হওয়া সম্ভব না।
” হেই! গিভ মি অ্যানাদার বটল অব বিয়ার।”
আন্দ্রেজ একজন বারটেন্ডারকে ডেকে বললো। এখানকার ভিআইপি কাস্টমার সে। সেজন্য খাতিরযত্নও অন্যরকম। ওয়ারিশ শহরে আন্দ্রেজ ওয়ারসকিকে চেনে না এমন মানুষ খুব কম আছে।
“প্লিজ ওয়েট আ মোমেন্ট, স্যার। আইল গেট ইট ফর ইউ।”
” ওকে। “
আন্দ্রেজ শেষ হয়ে যাওয়া বিয়ারের বোতলের দিকে তাকিয়ে ক্রুর হাসলো। নিজেকে সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণে রাখার চেষ্টা করছে সে। ইলোনার এমন বেখেয়ালি মনোভাব আন্দ্রেজকে চূর্ণবিচূর্ণ করে দিচ্ছে। মেয়েটার এতো বড়ো সাহস ছেলে বন্ধুদের সাথে পার্টিতে নাচছে! এরমধ্যে বারটেন্ডার আদাম আরেকটা বিয়ারের বোতল এনে রাখলো আন্দ্রেজের সামনে।
” সার, ইউ হ্যাভ অলরেডি ইটেন টু মাচ। প্লিজ ডোন্ট ইট এনি মোর! “
আদাম একটু ভয়ে ভয়ে বললো কথাটা। আন্দ্রেজ অদ্ভুতভাবে হাসলো। বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে নিজের কপালে পরে থাকা চুলগুলো হাতের সাহায্যে পেছনে ঠেলে বললো,
” দ্যাট’স নট ফর ইউ টু ওয়রি আবাউট। জাস্ট ডু ইয়োর ওউন ওয়ার্ক। “
আন্দ্রেজকে খুব ভালো করে চেনে এখানকার সব বারটেন্ডাররা। মুখে হাসি ফুটিয়ে কথা বললেও মুহুর্তের মধ্যে যে কী বিশ্রী রূপ ধারণ করতে পারে লোকটা সেটা সবারই জানা। সেজন্য বারটেন্ডার আদাম আর কথা না বাড়িয়ে চলে গেলো। আন্দ্রেজ হাতে বিয়ারের বোতলটা নিয়ে টলমল পায়ে ইলোনার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। আচমকা ইলোনার বান্ধবী এনা আন্দ্রেজকে দেখে তৎক্ষণাৎ ইলোনাকে ডেকে বললো,
” ইলোনা, লুক অ্যাট অ্যান্দ্রেজ! “
” আন্দ্রেজ! হোয়ার ইজ আন্দ্রেজ ? “
এনা হাতের ইশারায় ওদের পেছনে এসে দাঁড়িয়ে থাকা আন্দ্রেজকে দেখাল। কিছুটা চমকাল ইলোনা। সব সময় কি লোকটা ওকে ফলো করে? বিরক্তিকর! ইলোনা কণ্ঠে কিছুটা দৃঢ়তা এনে আন্দ্রেজকে উদ্দেশ্য করে বলে,
” দেখো আন্দ্রেজ তোমাকে অনেকবার বলেছি আমাদের মধ্যে যা কিছু ছিলো সব শেষ। ডু ইউ আন্ডারস্ট্যান্ড? দ্য এন্ড মিন্স দ্য এন্ড।”
আন্দ্রেজের বদৌলতে ইলোনাও বাংলা বলতে পারে। তাই সব সময় নিজেদের মধ্যে বাংলায় কথা বলে।
” ওহ রিয়েলি ইলোনা?”
” ইয়েস। প্লিজ আমাকে বিরক্ত করা বন্ধ করো। “
আন্দ্রেজের বাঁকা হাসিতে ইলোনা ভড়কে গেলো। লোকটা কি এখানে তার সাইকো মনোভাব প্রদর্শন করবে না-কি ? ইলোনার ভাবনা শেষ হওয়ার আগেই আন্দ্রেজ ওকে হেঁচকা টানে নিজের সাথে মিশিয়ে ফেললো। ইলোনার বন্ধু মাইকেলের দিকে এক নজর তাকিয়ে কিছু একটা ইশারা করলো আন্দ্রেজ। ইলোনা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে গেছে। কিছু বলার আগেই আন্দ্রেজের ঠোঁটজোড়া ওর ঠোঁটকে দখল করে নিলো। বারের মধ্যে দাঁড়িয়ে এভাবে লিপ কিস করায় রেগে গেলো ইলোনা। মাইকেলসহ অন্য বন্ধুরা চুপ করে আছে অবশ্য। এই লোককে ভালো করে জানে ওঁরা।
” আন্দ্রেজ! হাউ ডেয়ার ইউ?”
নিজেকে জোর করে ছাড়িয়ে একপা পিছিয়ে গিয়ে বললো ইলোনা। আন্দ্রেজের ঠোঁটের কোণে হাসির ঝিলিক।
” সবাইকে বুঝতে হবে তুমি শুধু আমার। বুঝেছো মেরি জান? “
” সাইকো একটা! এখান থেকে চলে যাও তুমি। “
ইলোনার কথায় বিশেষ পাত্তা দিলো না আন্দ্রেজ। কোনো কথাবার্তা না বলে ইলোনাকে কাঁধে তুলে নিলো ও। ঘটনার আকস্মিকতায় অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে ইলোনার বন্ধুরা। আন্দ্রেজের এই অদ্ভুত আচরণের জন্যই ইলোনা ওকে ত্যাগ করেছিল। অথচ দেখো এখনো লোকটা শুধরল না!
” আন্দ্রেজ ছাড়ো আমাকে। বাড়াবাড়ি করছো তুমি। আন্দ্রেজ!”
ইলোনার চেঁচামেচি শুনে আশেপাশের কয়েকজন লোকজন তাকালেও কেউ এলোনা সাহায্য করতে। যার যার মতো ব্যস্ত সে। আন্দ্রেজ ইলোনাকে কাঁধে করে নিয়েই বার থেকে বেরিয়ে সোজা গাড়িতে উঠে বসলো। ইলোনা চাইলেও এই শক্তসমর্থ চেহারার লোকটার সাথে বলে পেরে উঠছে না। আন্দ্রেজ নিজের সিট বেল্ট বেঁধে ইলোনার সেট বেল্টও বেঁধে দিলো। ইলোনার কপালে এলোমেলো হয়ে থাকা চুলগুলো যত্ন সহকারে কানের ওপাশে গুঁজে কপালে ঠোঁট ছুঁইয়ে দিলো আন্দ্রেজ। বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো মেয়েটা।
” আমি কিন্তু ভাইয়ার কাছে কল দিবো। “
” লাভ নেই। তোমার ভাই ওয়ারেক এখন ব্যস্ত মিটিং এ। কল দিলেও রিসিভ করবে না। চেষ্টা করতে পারো। “
ইলোনা আর চেষ্টা করলোনা। কারণ আন্দ্রেজের বলা কথা কখনো ভুল হয় না। কিন্তু এই সাইকোর সাথে কোথায় যাবে ও? আন্দ্রেজ এরমধ্যেই গাড়ি চালাতে শুরু করেছে।
” তুমি কি গাড়ি থামাবে না? না থামালে আমি গাড়ি থেকে লাফিয়ে নেমে যাবো। “
” চেষ্টা করে দেখতে পারো। “
ইলোনা গাড়ির দরজা খুলতে গেলে আন্দ্রেজ এক হাত দিয়ে ইলোনাকে বাঁধা দিলো। মেয়েটা যে কী পরিমাণ ঘাড়ত্যাড়া আন্দ্রেজ খুব ভালো করেই জানে। সেজন্য রাস্তার একপাশে গাড়ি থামিয়ে ইলোনার হাত দু’টো শক্ত করে বেঁধে ফেললো আন্দ্রেজ। তার স্কচটেপ লাগিয়ে দিলো মুখে। মেয়েটা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে শুধু। এই বিষাক্ত লোকটার থেকে কীভাবে মুক্তি পাবে ও? আন্দ্রেজ ইলোনার অসহায় মুখখানার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলো। তারপর আবারো গাড়িতে স্টার্ট দিলো। আন্দ্রেজকে দেখার থেকে বাইরে তাকিয়ে থাকা ঢেরবেশি ভালো। সেজন্য ইলোনা গাড়ির জানালা দিয়ে বাইরের দৃশ্য দেখতে লাগলো। রেড ম্যাপল গাছগুলো তার সৌন্দর্য হারিয়েছে এখন৷ শীতকালে পাতা ঝড়ে একেবারে নগ্ন হয়ে যায় গাছগুলো।
” লিসেন তোমার ছেলে আমার কল পর্যন্ত রিসিভ করে না ওয়াসিম। একটা ছেলে এতো বেয়াদব কী করে হয়! “
বাংলাদেশ। ঘড়িতে এখন সময় রাত বারোটা বেজে দশ মিনিট । চৌধুরী বাড়ির ড্রইং রুমে বসে আছেন ওয়াসিম চৌধুরী ও এ্যানি চৌধুরী। সম্পর্কে স্বামী স্ত্রী উনারা।
মেরি জান
” আহ এ্যানি! আন্দ্রেজ হয়তো ব্যস্ত আছে। “
” সব সময় ব্যস্ত থাকে তোমার ছেলে? আসল কথা হচ্ছে সে পোল্যান্ডে থেকে থেকে বিগড়ে গেছে। মামার সাথে না থেকে দেশে থাকলে কী হতো তার? “
” এসব কথা ছাড়া অন্য কোনো কথা থাকলে বলো। “
” শিয়ার জন্মদিন পরশু। আশা করি ভুলে যাওনি। আগামীকাল সময় বের করে আমার সাথে শপিং যেতে হবে। “
” ঠিক আছে। “
ওয়াসিম চৌধুরী ঠান্ডা মাথার মানুষ। কথাও কম বলেন। স্বামীর সংক্ষিপ্ত উত্তরে বিরক্ত হলেন এ্যানি। ওয়াসিমের কি শিয়ার জন্মদিনের বিষয় আরেকটু আগ্রহ প্রকাশ করা উচিত ছিলো না? একমাত্র মেয়ের বিষয় এতটা উদাসীনতা খারাপ লাগলো এ্যানির। ফলশ্রুতিতে ভদ্রমহিলা রেগেমেগে হনহনিয়ে ড্রইং রুম থেকে বেরিয়ে গেলেন।
এ্যানি চৌধুরী আন্দ্রেজকে খুব একটা পছন্দ করেন না। যার জন্য সব সময় ওয়াসিম চৌধুরীর চোখে খারাপ প্রমাণ করেত চান। আন্দ্রেজের মা ওয়াসিম চৌধুরীর প্রথম স্ত্রী ছিলেন। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশত আন্দ্রেজকে জন্ম দিতে গিয়ে মারা গেছেন তিনি। দশ বছর বয়স পর্যন্ত বাবার সাথেই ছিলো আন্দ্রেজ। কিন্তু পরবর্তীতে ওর মামা নিকোলাস আন্দ্রেজকে নিজের সাথে করে নিয়ে যান। একটা সময় মামার সাথেই পাকাপোক্তভাবে ওয়ারশায় থেকে যায় ও। কিন্তু সৎ ছেলের এমন সুখী জীবনযাপন ঠিক সহ্য হয় না এ্যানি চৌধুরীর। সেজন্য তিনি সব সময় চেষ্টা করেন কীভাবে ওকে ওয়াসিম চৌধুরীর চোখে হেয় করা যায়। এতে অবশ্য কিছু যায় আসে না আন্দ্রেজের। বাবার প্রতি সুপ্ত রাগ আছে ওর। অভিমান তো প্রবল। অবশ্য এর পেছনে কারণ আছে। ওয়াসিম চৌধুরীর কারণেই আন্দ্রেজের মা অতিরিক্ত মানসিক অশান্তিতে ভুগতেন। সব সময় কাজ নিয়ে পড়ে থাকার জন্য স্ত্রী’কে সময় দিতেন না ওয়াসিম। অথচ আন্দ্রেজের মা কেবল উনাকে ভালোবেসেই নিজ দেশ, পরিবার ছেড়ে বাংলাদেশে এসে সংসার পেতেছিলেন।
চলবে,
প্রথমবার একটু অন্য রকম গল্প লেখার চেষ্টা করলাম। বিভিন্ন তথ্য খুঁজতে অনেক সময় লেগেছে। তবুও যেহেতু গল্পটা কাল্পনিক তাই কিছু কিছু ক্ষেত্রে কাল্পনিক তথ্য থাকতে পারে। আর হ্যাঁ ভালো নায়ক চাইলে এই গল্প আপনার জন্য নয়। সামনে আন্দ্রেজের আরো সাইকোগিরি আসবে তাই ভালো না লাগলে এখুনি স্কিপ করুন।
carnation e book