মেরি জান 10

মেরি জান 10
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
ইভানার কী হয়েছে সেসব নিয়ে ভাবলে আরো চিন্তা বৃদ্ধি পাচ্ছে। তারচে অপেক্ষা করা ভালো। মনে মনে এসব জল্পনা-কল্পনা করতে করতে পায়চারি করছে রেবেকা। কিন্তু চিন্তা কি চাইলেই বন্ধ করা যায়? উঁহু! চিন্তা হচ্ছে নাছোড়বান্দা টাইপের, না চাইতেও চলে আসে।
রাত সাড়ে বারোটার দিকে ইভানা বিধস্ত অবস্থায় দরজায় সামনে এসে দাঁড়িয়ে কলিংবেল বাজাতেই তড়িঘড়ি করে দরজা খুলে দিলো রেবেকা।
” ইভানা! তুমি ঠিক আছো? “
ইভানার মলিন চেহারা দেখে রেবেকার চিন্তার পাল্লা আরেকটু বৃদ্ধি পেলো। ইভানা চুপচাপ ঘরের মধ্যে ঢুকে নিজেই দরজা আঁটকে দিলো। ধীরপায়ে এগোতে লাগলো রুমের দিকে। কিছু একটা তো হয়েছে! রেবেকার মনে নানান প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু দ্বিতীয় বার আর কিছু জিজ্ঞেস করছে না। আগে মেয়েটা একটু ধাতস্থ হোক।
হঠাৎ ঘুম ভেঙে যেতেই আঁতকে উঠল রেবেকা। ঘুম ঘুম চোখে কোনোরকমে আশেপাশে তাকিয়ে বোঝার চেষ্টা করলো ইভানা কোথায়? কিন্তু সমস্ত রুমে নজর বুলিয়েও ইভানাকে কোথাও দেখতে পাচ্ছে না রেবেকা। তাহলে এতক্ষণ যা কিছু দেখছিল, ঘটছিল তার সবটাই নিছক স্বপ্ন!
দেখতে দেখতে বেশ কয়েক দিন পেরিয়ে গেছে, ইভানা অফিসে আসেনি। প্রথমে ব্যাপারটা খেয়াল না করলেও আজ ইভানাকে খুব করে মিস করছে আন্দ্রেজ। ওর খোঁজ খবর নেওয়া, কেয়ার করা, সারল্য, হাসি সবকিছুই ওর কথা খুব করে মনে পড়াচ্ছে আন্দ্রেজকে। কিন্তু লোকটা অবাক হয়েছে নিজের ভাবনায়। কীভাবে একটা মেয়েকে মিস করছে সে? ভাবনার কোনো তল খুঁজে পায় না আন্দ্রেজ। ম্যাকের মনটাও খারাপ। ইভানাকে সে-ও খুবই মিস করে। কিন্তু বসের ভয়ে কিছু বলতেও পারে না।
” ম্যাক রুমে এসো তো। “
বসের কল পেতেই নিজের ডেস্ক থেকে উঠে রুমের দিকে এগোলো ম্যাক৷ মিনিট দুয়েক বাদেই আন্দ্রেজের সামনে এসে উপস্থিত হলো।
” জি স্যার! আপনার কিছু লাগবে? “
” ইভানা অফিসে কেন আসেনি খোঁজ নাও তো। “
” সত্যি স্যার? “
ম্যাক উত্তেজনায় কিছুটা উচ্চস্বরে বলে ফেলেছে কথাটা। আন্দ্রেজ ভাবলেশহীনভাবে ল্যাপটপে মুখ গুঁজে কপালে আঙুল চেপে বসে আছে। ম্যাক নিজের ভুল বুঝতে পেরে ফের বলে,
” ওকে স্যার। “
” হুম এসো এখন। “
” জি স্যার। “
ম্যাক চলে যেতেই আবারো ভাবনায় হারালো আন্দ্রেজ। ইভানার মতো সামান্য একটা মেয়ের কথা কেনো ভাবছে আন্দ্রেজ? নাহ বিরক্ত লাগছে এবার।
ইলোনাকে আজ মুক্তি দিবে আগন্তুক। ইভানা যেহেতু আন্দ্রেজের জীবনে নেই এবং ফিরে আসার সম্ভাবনাও শূন্যের কাছাকাছি তাই অহেতুক এই আত্মাকে বন্দী করে রাখার কোনো প্রয়োজনীয়তা নেই। সেইমত আগন্তুক ইলোনাকে মুক্ত করে দিলো। মুক্তির আনন্দে ইলোনা ইচ্ছে মতো ঘুরতে লাগলো তার পছন্দের জায়গাগুলোতে। আন্দ্রেজকে ভ্যাম্পায়ার সম্রাজ্যের একচ্ছত্র আধিপত্য হতে দিবে না বলেই এতো পরিকল্পনা আগন্তুকের। যে শর্তে আন্দ্রেজের ভবিষ্যত প্রজন্ম অধিক শক্তিশালী হতো সেই শর্ত আর পূর্ণ হবে না ভেবেই আনন্দে আত্মহারা হচ্ছে আগন্তুক।
রেবেকার কাছ থেকে ম্যাক যতটুকু শুনেছে তার সারমর্ম এই যে, ইভানা বাংলাদেশে চলে গেছে। এবং সে আর কখনো পোল্যান্ডে ফিরবে না। কারণ হিসেবে অবশ্য বিশেষ কিছু বলেনি সে। তবে ফিরবে না এটুকু বলেছে দৃঢ়ভাবে।
” কিন্তু রেবেকা কিছু তোমাকে বলেছে নিশ্চয়ই? কেনো এমন সিন্ধান্ত নিলো ইভানা? “
মুখোমুখি বসে আছে ম্যাক ও রেবেকা। দু’জনের হাতেই কফির কাপ। রেবেকা নিজের হাতে থাকা কাপে চুমুক দিয়ে বলে,
” সেদিন আন্দ্রেজের সাথে ডেটে সরি ডিনারে গিয়েছিল ইভানা। যাওয়ার আগে খুব হাসিখুশি ছিলো মেয়েটা। আর যখন মাঝরাতে ফিরলো! “
” তখন? “
ম্যাক আগ্রহী হয়ে উঠেছে। রেবেকা একটু থেমে ফের বলতে লাগলো,
” তখন খুব অগোছালো, বিধস্ত লাগছিলো। দেখে মনে হচ্ছিল বড়সড় একটা মেন্টাল শক খেয়েছে। আমি অনেকবার জিজ্ঞেস করেছিলাম, কী হয়েছে! কিন্তু ও কিচ্ছু বলেনি। তারপর থেকে কেমন চুপচাপ হয়ে গেছিল মেয়েটা। আমি চেষ্টা করতাম স্বাভাবিকভাবে কথাবার্তা বলার কিন্তু ও কোনো রেসপন্স করতোনা। “
ম্যাক ভাবনায় পড়ে গেল। আন্দ্রেজ স্যার কি কিছু লুকিয়েছে ওর কাছে? নিশ্চয়ই!
” হুম বুঝতে পেরেছি। আমি স্যারকে সবকিছুই বলবো রেবেকা। “
” দেখো যা ভালো মনে হয়! আমার চাকরিতে আপাতত ছুটিছাটা নেই। সেজন্য চাইলেও দেশে যেতে পারবোনা। নইলে আমি গিয়ে খোঁজ নিতাম ইভানার। “
” আচ্ছা। আসছি আজ। অন্য আরেকদিন কথা হবে। “
ম্যাক বিদায় দেওয়ার উদ্দেশ্যে বললো। বসা থেকে উঠে দাঁড়াতেই সাথে রেবেকাও উঠে দাঁড়ালো।
” অবশ্যই! “
ম্যাক রেবেকাকে বিদায় জানিয়ে আবার অফিসের উদ্দেশ্যে রওয়ানা দেয়।
নিঝুম রাত, চারদিকে শুনশান নীরবতা। মাঝে মধ্যে দূর থেকে ভেসে আসছে কিছু শেয়ালের হাঁক। আজকে অনেক দিন পর ভিসলা নদীর পাড়ের সেই বাড়িটাতে এসেছে আন্দ্রেজ। মন মানসিকতা খারাপ লাগছে। জঙ্গলের আশেপাশে থাকলে একটু হলেও ভালো লাগে ওর। সেজন্য এখানে আসা। কিন্তু এখানেও শান্তি পাচ্ছে না। একটা মানুষের অনুপস্থিতিতে এভাবে পোড়াতে পারে দুঃস্বপ্নেও ভাবেনি আন্দ্রেজ। ইয়ান গতকাল অনেক কিছু বুঝিয়েছে ওকে। কীভাবে নিজের দায়দায়িত্ব পালন করবে সেসব। কিন্তু কোনোকিছুই এখন ভালো লাগে না আন্দ্রেজের। হাঁটতে, শুতে, খেতে কাজে সব জায়গায় বসেই শুধু ইভানার সেই অসহায় মুখটা ভেসে উঠে। কেনো সেদিন ওরকম করলো আন্দ্রেজ সেজন্য ভীষণ অনুতপ্ত হয়। কী করবে ও? ম্যাক যা বললো তাতে এটা স্পষ্ট, ইভানার আত্মসম্মানে লেগেছিল সেদিন রাতে। পাশাপাশি পছন্দের পুরুষের মাঝে কামনাবাসনার লালসা! সবকিছু মিলিয়ে মেয়েটা ভীষণ আঘাত পেয়ে এ দেশ ছেড়ে গেছে।
সারারাত এরকম শতশত ভাবনা নিয়ে নির্ঘুম রাত কেটেছে আন্দ্রেজের। দোটানা বাদ দিয়ে দেশে ফিরবে বলে সিন্ধান্ত নিয়েছে লোকটা। এখন শুধু মামাকে বলা বাকি৷ তাই সকাল হতেই মামার উদ্দেশ্য বের হয়েছে আন্দ্রেজ। সকাল দশটা নাগাদ বাসায় এসে পৌঁছল ও। ইয়ান তখন বাগানে বসে সকালের চা পান করছে। হঠাৎ দূর থেকে আন্দ্রেজকে জোরেসোরে হেঁটে আসতে দেখে নড়েচড়ে বসলেন ইয়ান। কালো রঙের শার্ট আর জিন্সের প্যান্টে দারুণ লাগছে আন্দ্রেজকে।
” গুড মর্নিং আন্দ্রেজ। “
কাছাকাছি আসতেই মামা নিজে থেকেই জিজ্ঞেস করলো আন্দ্রেজকে। ও মৃদু হেসে বললো,
” মর্নিং মামা।”
” রাতে কোথায়…..”
” মামা আমি বাংলাদেশে যাবো। অনেক দিন হলে বাবাকে দেখিনা। “
আচমকা এরকম কথা মোটেও আশা করেননি। তবুও শান্ত থেকেই বললেন,
” তা হঠাৎ? “
” বললাম তো! “
” আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছ? “
আবেগি হয়ে উঠলেন ইয়ান। আন্দ্রেজ স্বাভাবিক আছে।
” না। জাস্ট কয়েকদিনের জন্য যাচ্ছি। “
” শিওর? “
” ইয়েস। “
” ওকে। তাহলে যেতে পারো। তবে মেয়েদের হতে সাবধান! “
আন্দ্রেজ দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন। আন্দ্রেজ মুচকি হাসলো।
” আর কোনো মেয়ে তোমার ভাগনের জীবনে আসবে না মামা। “
” মানে? “
আন্দ্রেজের এমন কথায় চমকালেন, থমকালেন ইয়ান ওয়ারসকি। এ যেন ভুতের মুখে রামনাম!
” মানে তেমন কিছু না মামা। আমি একটু ঘুমাবো। রাতের ফ্লাইটেই যাবে ভাবছি। “
” ঠিক আছে। তাহলে গিয়ে রেস্ট নাও৷ “
” ওকে ডিয়ার মামা। “
ইয়ান অন্য দিকে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে হাসলেন। এতো করে মামা ডাকতপ বারণ করে তবুও কেন মামা বলে ডাকতেন হবে? এভাবে বললে বুঝি খারাপ লাগে না!
দুপুরের খাওয়াদাওয়া শেষে একটু ঘুমিয়েছিল শিয়া। কিন্তু ভাইয়ের কলে ঘুমের দফারফা হয়ে গেল মাত্র। ঘুম ঘুম চোখে কল রিসিভ করে ফোনটা কানে ধরে বললে শিয়া,
” ভাইয়া আআআ! কল দেওয়ার জন্য আর কোনো সময় পেলে না? “
” কেনো? ব্যস্ত? “
” আরে না। ঘুমিয়েছিলাম একটু। “
” ওহ সরি! শোনো শিয়া, আমি রাতে ফ্লাইটে করে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিবো। বাবাকে বলতে হবে না। সারপ্রাইজ দিবো ওকে? “
শিয়া আন্দ্রেজের কথাগুলো যেনো হজম করতে পারলোনা। শোয়া থেকে উঠে নিজের হাতে নিজেই জোরেশোরে একটা চিমটি কাটলো। নাহ ব্যথা লাগছে মানে সবকিছু সত্যি! শিয়া আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো।
” সত্যি! ভাইয়া সত্যি বললে তুমি? “

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *