( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
শিয়া আন্দ্রেজের কথাগুলো যেনো হজম করতে পারলোনা। শোয়া থেকে উঠে নিজের হাতে নিজেই জোরেশোরে একটা চিমটি কাটলো। নাহ ব্যথা লাগছে মানে সবকিছু সত্যি! শিয়া আনন্দে প্রায় চেঁচিয়ে উঠলো।
” সত্যি! ভাইয়া সত্যি বললে তুমি? “
” শিয়া! বোন আমার আস্তে বলো। এভাবে চিৎকার করে বললে তো পাশের বাড়ির লোকজন পর্যন্ত শুনে ফেলবে। “
” সরি ভাইয়া। অতিরিক্ত এক্সাইটেড হয়ে গেছি তো। ঠিক আছে তুমি এসো। “
” ওকে বাই।”
শিয়া কিছু বলার আগেই কল কেটে দিলো আন্দ্রেজ। তবে সে বিষয় নিয়ে আজ শিয়ার একটুও মন খারাপ লাগছে না। কারণ ভাইয়ের দেশে ফেরার আনন্দে সবকিছু মাফ এখন।
এ্যানি চৌধুরী মেয়ের ঘরের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। পুরোপুরি কথোপকথন না শুনলেও শিয়া যে আন্দ্রেজের সাথেই কথা বলেছে সেটা ঠিকই বুঝতে পেরেছে। ছেলেটাকে একটুও সহ্য হয় না এ্যানির। শিয়া বিছানা ছেড়ে উঠে নিজেকে একটু পরিপাটি করছিল এমন সময় মা’কে ঘরে ঢুকতে দেখে মুচকি হাসলো শিয়া।
” মা তুমি! কিছু বলবে? “
এ্যানি চৌধুরী গম্ভীর হাবভাব নিয়ে বিছানার একপাশে বসলেন। শিয়া চুল বাঁধছে।
” দেখো শিয়া তোমার বাবা সবই বলেছেন আমাকে। তবুও বলবো আগে বিয়েটা করে নাও। লেখাপড়া পড়েও করা যাবে। “
মায়ের কথায় অবাক হলো শিয়া। তারমানে ওয়াসিম চৌধুরী এ্যানি চৌধুরীকে শুধু লেখাপড়ার কারণে বিয়ে করতে চায় না বলেছে? শিয়াও মনে মনে একই কথা ভাবলো। যাক তাতে অবশ্য ভালোই হয়েছে।
” আমার সিন্ধান্ত পরিবর্তন হবে না মা। “
দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বললেন এ্যানি,
” বেশ। তবে আন্দ্রেজ হঠাৎ কল দিয়েছিল কেনো? “
” ভাইয়া? “
” হ্যাঁ। “
” না মানে কিছু টাকা পাঠাবে বললো। “
মায়ের থেকে বিষয়টা লুকানোর জন্য ভুলভাল একটা কথা বলে ফেললো মেয়েটা। এ্যানি চৌধুরী ভ্রু কুঁচকে ফেলে শুধলেন,
” কেনো? তোমার বাবা-মায়ের কি টাকার ঘাটতি হয়েছে? না-কি বাংলাদেশ ব্যাংক খালি হয়ে গেছে! “
” ওমা! তুমি জানো না? জনগণ তো বলাবলি করছে আপা দেশ থেকে পালানোর আগে ব্যাংক খালি করে গেছে। “
এ্যানি চৌধুরীর প্রিয় নেত্রীকে নিয়ে কটুক্তি করায় বেজায় ক্ষেপে গেলেন। এটাই ছিলো শিয়ার উদ্দেশ্য। ওদিকে আহিয়ান অপেক্ষা করে আছে, বাইরে দেখা করবে বলে। তাই আপাতত মা’কে এখান থেকে সরানো খুব দরকার।
” বেয়াদব হয়ে যাচ্ছো তুমি। “
এ্যানি আরকিছুই বললেন না। বসা থেকে উঠে হনহনিয়ে ঘর থেকে চলে গেলেন শুধু। এদিকে শিয়া হাসতে হাসতে শেষ। মাঝে মধ্যে শিয়ার মনে হয় আপা তো ভারতে যাওয়ার আগে তার মাকেও সাথে করে নিয়ে যেতে পারতো? কিন্তু নিলো না কেন?
আন্দ্রেজের যাওয়ার বিষয় সবকিছু ম্যাক নিজেই দেখেছে। এয়ারপোর্টে ইয়ানসহ, ম্যাকও এসেছিল। দু’জন আন্দ্রেজকে বিদায় দিয়ে ভারাক্রান্ত হৃদয়ে নিজেদের বাসায় চলে গেছে।
রবিবার, সকাল সাড়ে ন’টা, বাংলাদেশ, ঢাকা।
এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে সেই পুরনো শহরে নিজেকে আবিষ্কার করে অভিভূত হয়েছে সে। যতই বিদেশে গিয়ে থাকুক জন্ম তো এই বাংলার মাটিতেই। তাই দেশের প্রতি অন্য রকম একটা অনুভূতি হৃদয়ে জেগে উঠেছে। যেহেতু সারপ্রাইজ দিবে তাই এয়ারপোর্ট থেকে বাসা পর্যন্ত একা একাই গেলো আন্দ্রেজ। ঠিক দুপুর একটার দিকে চৌধুরী ম্যানসনে পৌঁছল ছেলেটা। শিয়া তে সকাল থেকে শুধু একবার দরজার দিকে দৃষ্টিপাত করছিল আরেকবার দেয়ালঘড়ির দিকে দেখছিল। অবশেষে তার ভাই বাসায় ফিরেছে। তবে আন্দ্রেজকে দেখে স্বাভাবিকভাবেই এ্যানি চৌধুরী বেশ অখুশি হয়েছেন।
” ভাইয়া! “
আন্দ্রেজ বাসায় ঢুকতেই শিয়া গিয়ে ওকে জড়িয়ে ধরেছে। এ্যানি চৌধুরী একটু দূরে দাঁড়িয়ে মেকি হাসছেন।
” কেমন আছো শিয়া? “
” তুমি এসে গেছো ভাইয়া এখন আমি খুব ভালো আছি। “
আন্দ্রেজ মুচকি হেসে বোনের মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো। শিয়াও আন্দ্রেজকে ছেড়ে ওর হাত থেকে ল্যাগেজ নিজের হাতে নিলো। মিসেস এ্যানি চৌধুরী একটু এগিয়ে এসে জিজ্ঞেস করলেন,
” কেমন আছো আন্দ্রেজ? “
” বেশ ভালো মিসেস এ্যানি, আপনি কেমন আছেন? “
” খুব ভালো। তা তোমার বাবা কি তোমার আসার খবরটা জানতেন? “
কিছুটা অন্য রকম করেই কথাটা বললেন তিনি। আন্দ্রেজ মুচকি হাসলো।
” না উনি জানতেন না। জানলে নিশ্চয়ই আপনাকে বলতেন। যাইহোক আমি রুমে যাচ্ছি। “
আন্দ্রেজ আর কোনো কথা না বাড়িয়ে শিয়াকে সাথে নিয়ে নিজের রুমের দিকে এগোলো।
ইভানা চলে যাওয়ার পর থেকে রেবেকা ভীষণ একা হয়ে গেছে। হুট করে একটা চঞ্চল মেয়ে এভাবে তাকে নীরব করে দিয়ে চলে গেলো? ম্যাকের সাথে আজকে দেখা করার কথা রেবেকার। ওদের দু’জনের মধ্যে বেশ বন্ধুত্বপূর্ণ একটা সম্পর্ক সৃষ্টি হয়েছে এখন। তবে দেখা হলে দু’জনে মধ্যে কথার আসল টপিক থাকে ইভানা আর আন্দ্রেজের লাভ স্টোরি! ওদের এই অন্য রকম ভালোবাসার গল্পে পরিণতি ঠিক কেমন হবে সেটাই ভাবার বিষয়!
পড়ন্ত বিকেল। টিএসসি এসে দাঁড়িয়ে আছে আহিয়ান। শিয়ার আসার কথা আরো বিশ মিনিট আগেই। কিন্তু মেয়েটা এখনো আসেনি। এমনিতেই কাজে ফাঁকি দিয়ে আসতে হয়েছে আহিয়ানকে। তারমধ্যে যদি দেরি করে আসে কেমন লাগে? হ্যাঁ ভীষণ রাগ লাগছে ওর। পাঁচ বার কল করার পরও কল রিসিভ করেনি শিয়া। তবে ষষ্ঠ বার কল দেওয়ার আগেই আহিয়ানের চোখের সামনে উপস্থিত হলো এক সুন্দরী রমণী, পরনে তার লাল রঙের শাড়ি। ঠোঁটে কড়া লাল লিপস্টিক, হাতে চুড়ি, কানে স্টোনের দুল, চুলগুলো উন্মুক্ত!
” সরি! সরি! “
আহিয়ান যেনো শিয়ার কোনো কথাই শুনতে পাচ্ছে না এখন৷ কেমন বিভোর হয়ে তাকিয়ে আছে শিয়ার দিকে। বিষয়টা শিয়া বুঝতে পেরে আহিয়ানের হাতে একটা চিমটি কাটলো। আর তাতেই ভাবনার তেরোটা বেজে গেল ওর।
” আহ! লাগে তো। “
” লাগার জন্যই দিলাম জনাব। এভাবে তাকিয়ে থাকলে মানুষ কী ভাববে? “
আহিয়ান হেসে শিয়ার ডান হাত নিজের হাতে আবদ্ধ করে রাস্তার পাশ ধরে হাঁটতে লাগলো।
” এতক্ষণ যখন দাঁড়িয়ে থাকার সময় কেউ কিছু বলেনি তখন এখন তাকিয়ে থাকাতেও কিছু বলবে না ম্যাম।”
শিয়া হাসলো। সাথে আহিয়ানও। পড়ন্ত বিকেল একজোড়া ভালোবাসার পাখি নিজেদের মধ্যে কথা বলতে বলতে এগোতে লাগলো।
দেশে ফেরার এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে প্রায়। এরমধ্যেও ইভানার কোনো খোঁজ খবর পায়নি আন্দ্রেজ। অবশ্য ঢাকা শহর তো এতটুকু জায়গা নয় যে, কেবল নাম দিয়ে একটা মেয়েকে খুঁজে বের করে ফেলা সম্ভব হবে! কিন্তু ইভানাকে তে পেতেই হবে। এই মেয়েটা গত পনেরো দিনে একটু শান্তিতে ঘুমাতে দেয়নি আন্দ্রেজকে। তার অনুপস্থিতি উপস্থিতির থেকেও ঢেরবেশি জ্বালাময়। রাস্তায় আনমনে হাঁটছে আন্দ্রেজ। আশেপাশের লোকজনের দৃষ্টি যে ওর দিকেই নিবদ্ধ সে বিষয় ওর কোনো সন্দেহ নেই। দেশের মধ্যে এরকম একজন বিদেশি চেহারার লোক স্পষ্ট বাংলা বলাতেই তাদের আশ্চর্যের কারণ। হাতে থাকা ফেনটা ভাইব্রেট করে উঠতেই স্থির হয়ে দাঁড়াল আন্দ্রেজ। ফোনের স্ক্রিনে তাকিয়ে দেখে ওয়াসিম চৌধুরী কল করেছে। রয়েসয়ে কল রিসিভ করে আন্দ্রেজ।
” হ্যালো বাবা! “
” হ্যাঁ বাবা বলছি, তুমি কোথায়? গাড়ি নিয়ে যাওনি কেন? “
বাবার প্রশ্নের উত্তর কী দিবে বুঝতে পারছে না আন্দ্রেজ। উনাকে কীভাবে বলবে পইপই করে খুঁজবে একজনকে সে। যার জন্য হেঁটে খোঁজাই বেস্ট।
” একটু দরকার ছিল তাই। “
” ওকে। শোনো, এক ঘন্টা পর অফিসে একটা মিটিং এ উপস্থিত হতে হবে তোমাকে। একটা সফটওয়্যার প্রোগ্রামের বিষয় জরুরি আলোচনা আছে । “
বাবার কথায় চেখ মুখ বিরক্তিতে কুঁচকে ফেললো আন্দ্রেজ। দেশে আসার পর থেকে বারবার বলা স্বত্বেও অফিসে যায়নি ও। আজকে শেষমেশ যেতেই হবে!
” ওকে বাবা। আসছি আমি। “
” গুড। রাখছি তাহলে। “
বাবা কল কাটতেই একটা ক্যাব বুক করে নিলো আন্দ্রেজ। লোকাল বাসে করে চলাফেরা করা ওর পক্ষে সম্ভব না।
চলবে,