মেরি জান 12

মেরি জান
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
বাবা কল কাটতেই একটা ক্যাব বুক করে নিলো আন্দ্রেজ। লোকাল বাসে করে চলাফেরা করা ওর পক্ষে সম্ভব না। ছোটো থেকে বড়লোক জীবনযাপন করেই তো অভ্যস্ত সে!
মেঘমুক্ত আকাশে সূর্যের আলো স্পষ্ট ঠিকরে পড়ছে শহরের বুকে। গরমে হাসফাস করছে ব্যস্ত মানুষগুলো থেকে শুরু করে গাছপালা, পশুপাখিও। ক্যাব থেকে নেমে দাঁড়াল আন্দ্রেজ। পরনে ওর সাদা শার্ট আর জিন্স। অফিসে আসার কোনো পরিকল্পনা ছিলো না বলে ফরমাল ড্রেসআপ করা হয়নি। জীবনে প্রথম কোনো কাজ অনিচ্ছা সত্ত্বেও করতে হচ্ছে আন্দ্রেজকে। অফিসের সামনে এসে দাঁড়িয়েও ভেতরে ঢুকতে ইচ্ছে করছে না ওর। বাবার প্রতি সুপ্ত অভিমানই হয়তো এর কারণ। ওয়াসিম চৌধুরীর কথামতো আন্দ্রেজ অফিসে প্রবেশ করতেই সবাই ফুলেরতোড়া দিয়ে অভ্যর্থনা জানালো। তবে পুরোটা সময় আন্দ্রেজ একেবারে ভাবলেশহীন ছিলো।
নিজের রুমে বসে আনমনা হয়ে গেছে ইভানা। পোল্যান্ড ত্যাগ করলেও তার স্মৃতিগুলো ত্যাগ করতে পারেনি। আসলে কোনো জিনিস কিংবা মানুষ ছাড়া বেঁচে থাকা কোনো ব্যাপার না। কিন্তু সেই জিনিস বা মানুষের সাথে কাটানো সময়গুলোর স্মৃতি আসল সমস্যা। এই স্মৃতির কারণেই আমরা ভালো থাকতে পারি না।
” ইভানা ম্যাম! “
হঠাৎ সহকর্মী রিফাতের কণ্ঠে ভাবনার ছেদ ঘটল ইভানার। সাদা- কালো মিশেলের থ্রিপিস পরনে ওর,চুলগুলো ফ্রেঞ্চ বিনুনি করা। চেহারায় সাজগোজের বালাই নেই একটুও।
” রিফাত! হ্যাঁ এসো। তা হঠাৎ ম্যাম বলে ডাকলে? “
রিফাত মুচকি হাসলো। ধীর পায়ে রুমে ঢুকে একটা চেয়ার টেনে বসলো। এই অফিসে ইভানা জয়েন করেছে বেশিদিন হয়নি তবে রিফাত ইভানার পূর্বপরিচিত হওয়ায় ওদের মধ্যে সম্পর্কটা অন্য রকম৷ হাই স্কুলে একসাথে পড়ালেখা করেছিল সেই কবে! অথচ ওরা আজও সেসব মনে রেখেছে।
” এমনি। স্যারের ছেলে এসেছে অফিসে। “
” হ্যাঁ। বাইরে যেতে হবে এখন। আমার একটা কাজ ছিলো বলে একটু লেট হলো। “
ইভানা বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। সাথে রিফাতও। ছেলেটা একটু বসতেও পারলোনা ইভানার জন্য হুহ্।
” হ্যাঁ চলো। “
অফিসে প্রবেশ করার পর সবাই একে একে করে আন্দ্রেজের সাথে পরিচয় পর্ব সেড়ে নিচ্ছে। ওয়াসিম চৌধুরী নিজে দায়িত্ব নিয়েই অবশ্য সবার সাথে কথাবার্তা বলাচ্ছে আন্দ্রেজকে। ওয়াসিম চৌধুরী মনে মনে চাচ্ছেন, একমাত্র ছেলেটা এবার অন্ততঃ সবকিছুর দায়দায়িত্ব নিয়ে উনাকে মুক্তি দিক।
” আন্দ্রেজ উনি আমাদের ম্যানেজার, রুহুল কবির। “
বাবার কথায় মৃদু হাসলো আন্দ্রেজ। রুহুল কবির সাহেব নিজের হাত বাড়িয়ে দিলো ওর দিকে।
” নাইস টু মিট ইউ স্যার। “
” সেইম টু ইউ মি. রুহুল। “
কথা বলতে বলতে হঠাৎ কিছুটা দূরে দাঁড়িয়ে থাকা একজনের উপর দৃষ্টি আঁটকে গেলো আন্দ্রেজের। যার উপর ওর দৃষ্টি নিবদ্ধ সেই মেয়েটি ওকে খেয়ালই করেনি। আন্দ্রেজের সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। নিজের ভ্রম কাটাতে সবকিছু ভুলে জোরে ডাক দিলো,
” ইভানা! “
আচমকা আন্দ্রেজের কণ্ঠস্বর শুনে বিস্মিত হলো ইভানা। ভালো করে এদিক-সেদিক তাকাতেই আন্দ্রেজকে দেখতে পেলো। সহসাই বুকের ভেতরটা কেমন একটা করে উঠলো ইভানার। কিন্তু পরক্ষণেই আন্দ্রেজের পৈশাচিক আচরণের কথা মনে পড়তেই এলেমেলো হয়ে গেলো ইভানা। ইভানাকে ওভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে আন্দ্রেজ আর একমুহূর্ত দেরি করলোনা। দ্রুত হেঁটে গিয়ে ওর সামনে দাঁড়াল। উপস্থিত সবাই অবাক ওদের দিকেই তাকিয়ে আছে। ওয়াসিম চৌধুরী কী বলবেন বুঝতে পারছেন না।
” তুুমি এখানে এসে বসে আছো! আমি তোমাকে কোথায় কোথায় খুঁজেছি জানো? “
ইভানার কোনো উত্তরের অপেক্ষা না করেই সবার সামনে ওকে বুকে জড়িয়ে নিলো আন্দ্রেজ। সবাই যেনো দ্বিতীয় বারের মতো অবাক হলো। ওয়াসিম চৌধুরী তো লজ্জায় মাথা নিচু করে ফেলেছেন। অফিসে বসে এসব কী? ইভানা নিজেকে ছাড়াতে চাইলেও আন্দ্রেজ নিজের সবটুকু দিয়ে বুকে আগলে রাখছে ইভানাকে।
” দেখুন সবাই কেমন করে তাকিয়ে আছে! প্লিজ এখন ছাড়ুন! আমরা বসে কথা বলবো পরে। “
ইভানার আকুতিভরা কণ্ঠে আন্দ্রেজের কিছু যায় আসছে না যেনো। মনে হচ্ছে ইভানাকে ছাড়লেই আবারও মেয়েটা হারিয়ে যাবে এমনকিছু।
” না! তুমি আগে বলো আমাকে ছেড়ে আর কোথাও যাবে না? কথা দাও। “.
ছেলের আচরণে রীতিমতো অবাক ওয়াসিম চৌধুরী। আন্দ্রেজ! আন্দ্রেজ কোনো মেয়েকে এসব বলছে?
” আপনারা সবাই যার যার কেবিনে চলে যান। আর আন্দ্রেজ! কী হচ্ছে এসব? “
ওয়াসিম চৌধুরীর কথায় সবাই যার যার রুমের দিকে অনিচ্ছা সত্ত্বেও এগোতে লাগলো। সবাই জানতে উৎসুক হয়ে আছে, ঠিক কী হচ্ছে এখানে! বাবার কথায়ও ইভানাকে একেবারে বাহুডোর থেকে মুক্তি দিলো না আন্দ্রেজ। তবে জড়িয়ে ধরে না থেকে শুধু একটা হাত ধরে দাঁড়াল এবার।
” সবাই দাঁড়ান! বাবা ইভানা আমার গার্লফ্রেন্ড। পোল্যান্ডে থাকতেই আমাদের রিলেশনশিপ শুরু হয়। আমি ওকে নিয়ে একটু বের হচ্ছি এখন। “
ওয়াসিম চৌধুরীর অনুমতির অপেক্ষা না করেই ইভানাকে একপ্রকার জোরাজোরি করে অফিস থেকে নিয়ে বের হলো আন্দ্রেজ। ইভানার মিশ্র প্রতিক্রিয়া ফিল হচ্ছে আজ। একবার মনে হচ্ছে এই লোকটা ভীষণ খারাপ আবার পরক্ষণেই মনে হচ্ছে মানুষটা বদলে গেছে!
অফিস থেকে বেরিয়ে একটা রেস্টুরেন্টে গিয়ে বসলো ইভানা ও আন্দ্রেজ। রেস্টুরেন্টের ভেতরটা বেশ স্নিগ্ধ ও আরামদায়ক পরিবেশে সাজানো। পেছনের দেয়ালে নরম আলো জ্বলে উঠছে, যা পুরো স্থানটিকে একটি রোমান্টিক আভায় মুড়ে রেখেছে। টেবিলগুলো সুন্দরভাবে সাজানো, প্রত্যেকটি টেবিলের মাঝখানে একটি ছোট সজ্জিত ফুলদানি। সব টেবিলে কাপল বসা না থাকলেও মোটামুটি লোকজনে পরিপূর্ণ রেস্টুরেন্টটি। ইভানা এখন পর্যন্ত একটা কথা পর্যন্ত বলেনি। আন্দ্রেজ দু’জনের জন্য কিছু খাবার অর্ডার করে ইভানার হাতদুটো নিজের হাতের মধ্যে ঢুকিয়ে বলে,
” আমার ভুলের কি কোনো ক্ষমা নেই ইভা? “
❝ ইভা!❞ আন্দ্রেজের মুখে নিজের ডাকনাম শুনে চমকাল, থমকাল ইভানা।
” ক্ষমা করার মতো আমাদের মধ্যে কিছু অবশিষ্ট নেই স্যার। তাছাড়া কী ছিলো আমাদের মধ্যে? ওটাকে কিছু বলে না। আমি সেসব ভুলেই গেছি, আপনিও বাদ দিন। “
কথাগুলো বলার সময় ঠোঁটজোড়া কেমন কেঁপে উঠল ইভানার। আন্দ্রেজ ইভানার দুহাত ধরে চোখের দিকে ইশারা করলো। ইভানাও কেনো জানি সেই ইশারা উপেক্ষা করতে পারলো না। দৃষ্টি মিলন হতেই কেমন অস্থিরতা অনুভব করতে লাগলো মেয়েটা। মন বলছে সামনে থাকা মানুষটা তাকে ভালোবেসে ফেলেছে কিন্তু মস্তিষ্ক ভিন্ন কথা বলে।
” ইভা আমি জানি আমি ভালো নই। তাই নিজেকে ভালো প্রমাণ করতেও চাইবো না। কিন্তু আজকে আমাকে এই দেশে, এই জায়গায় শুধুমাত্র তোমার অনুপস্থিতি টেনে এনেছে। ইয়েস! আমি শুধু তোমার জন্য, তোমাকে খুঁজে পাওয়ার জন্য এতগুলো বছর পর ফিরেছি ইভা! “
ইভানার দু-চোখ ছলছল করছে। ইচ্ছে করছে আন্দ্রেজকে জড়িয়ে ধরে একটু হালকা হতে। কিন্তু সেই রাতের সম্মানহানি হওয়ার সম্ভাবনাময় সময়টাকে কিছুতেই মাথা থেকে বের করে দিতে পারছে না। এ কেমন দোটানা? কেমন অশান্তি? ইভানাকে চুপ করে থাকতে দেখে আন্দ্রেজ ফের বলতে লাগলো,
” ইভা আমি বলবো না যে তোমাকে ভালোবেসে একেবারে ধোয়া তুলসীপাতা হয়ে যাবো কিংবা গেছি কিন্তু তোমাকে ভালোবাসার পর আমার সবটা জুড়ে কেবল তুমি, তুমি এবং তুমি। প্লিজ একবার সবকিছু ভুলে হাত হাত রাখো মেরি জান!”
ইভানা আর আন্দ্রেজ যখন নিজেদের মধ্যে কথাবার্তা বলছে তখুনি একই রেস্টুরেন্টে আহিয়ান ও শিয়াও এসে ঢুকলো। বেছে বেছে আন্দ্রেজদের পেছনের সিটেই ওরা বসেছে। যদিও কেউ কিছুই জানে না।
” কী খাবে বলো শিয়া! “
আহিয়ান মুচকি হেসে শুধালো শিয়াকে। শিয়া চুপচাপ মেনু কার্ড দেখে কয়েকটা খাবার অর্ডার করতে বললো। আন্দ্রেজ ইভানার সাথে কথাই বলছিল কিন্তু হঠাৎ শিয়ার গলার আওয়াজ শুনপ চুপ করে গেলো ও। ইভানা তো আগে থেকেই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *