( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
” কী খাবে বলো শিয়া! “
আহিয়ান মুচকি হেসে শুধালো শিয়াকে। শিয়া চুপচাপ মেনু কার্ড দেখে কয়েকটা খাবার অর্ডার করতে বললো। আন্দ্রেজ ইভানার সাথে কথাই বলছিল কিন্তু হঠাৎ শিয়ার গলার আওয়াজ শুনে চুপ করে গেলো ও। ইভানা তো আগে থেকেই নিশ্চুপ হয়ে বসে আছে।
” আপনি অর্ডার দাও তো। আমার তেমন কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না। “
শিয়া কিছুটা আনমনে বললো কথাটা। আহিয়ানের সাথে বেশ কয়েক বছরের সম্পর্ক হলেও শিয়া এখনো ওকে আপনি বলেই সম্মোধন করে। আন্দ্রেজ এবার ঘাড় ঘুরিয়ে আশেপাশে তাকাল একবার। পাশে, সামনে কোথাও তো শিয়াকে যাচ্ছে না! তবে কি ভুল শুনলো? উঁহু! একজন ড্যাম্পায়ার কখনো ভুল শুনতেই পারে না। আন্দ্রেজ বসা থেকে উঠে দাঁড়ালো। পেছনের টেবিলে দৃষ্টিপাত করতেই চমকাল, থমকাল। শিয়াও বিস্ময়ের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। আহিয়ান তো খাবার অর্ডার দেওয়া শেষে নিজের মতো করে ওর সাথে কথা বলেই যাচ্ছে। কিন্তু বেচারা শিয়া ভাইয়ের দিকে কাচুমাচু ভঙ্গিতে তাকিয়ে ‘থ’ হয়ে বসে আছে। ইভানা তো কিছু বুঝতে পারছে না। আন্দ্রেজ আর শিয়ার তাকানো দেখে ও নিজেও ওদের দিকে তাকিয়ে আছে।
” শিয়া! তুমি এখানে? সাথে কে তোমার? “
আচমকা নিজের প্রেমিকার নাম অন্য কোনো পুরুষের গলায় শুনে আহিয়ানও আন্দ্রেজের দিকে দৃষ্টিপাত করলো। শিয়া ঠোঁটের কোণে জোর করে এক টুকরো হাসির রেখা ফুটাতে চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলো।
” ভাইয়া আসলে ও আমার কলেজ লাইফের বন্ধু। অনেক দিন পর দেখা হলো….”
” কলেজ লাইফের বন্ধু? বন্ধুকে কেউ আপনি করে ডাকে শিয়া? “
শিয়ার কথা শেষ হওয়ার আগেই আন্দ্রেজ কিছুটা সন্দেহ প্রকাশ করে উক্ত প্রশ্নটি করলো। আহিয়ান যা বোঝার বুঝে গেছে। আসার সময় শিয়া বলছিল পর বড়ো ভাই বহু বছর পর দেশে ফিরেছে।
” ইমম না মানে ভাইয়া.. আসলে!”
আহিয়ান আর শিয়া দু’জনেই বসা থেকে উঠে দাঁড়িয়ে আছে। মনে হচ্ছে দু’টো চোর পুলিশের কাছে ধরা পড়েছে। ইভানাও আন্দ্রেজের পাশে এসে দাঁড়িয়ে বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করছে।
” হয়েছে! এদিকে এসো একসাথে লাঞ্চ করবো। “
আন্দ্রেজ মুচকি হাসলো। শিয়া যেন হাঁপ ছেড়ে বাঁচল। আহিয়ান মিষ্টি করে হেসে আন্দ্রেজের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলো।
” হাই ভাইয়া। আমি আহিয়ান মল্লিক। “
” আমি আন্দ্রেজ ওয়ারসকি। “
” ভাইয়া? কীসব ওয়ারসকি? বলো চৌধুরী! “
শিয়া মাঝখানে কথা সাধল। ইভানা এখনো চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বোনের কথায় মাথা নাড়ল আন্দ্রেজ। ইভানার দিকে তাকিয়ে বললো,
” শিয়া এটা তোমার ভাবি। ইভানা এই হল আমার একমাত্র বোন শিয়া। “
” হেই ভাবিই!”
শিয়া খুশিতে গদগদ হয়ে ইভানাকে জড়িয়ে ধরল একটু। ইভানাও বিষয়টা মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছে।
” আসো বসে কথা বলি।”
ইভানা শিয়াকে নিয়ে টেবিলের একপাশে বসলো। আন্দ্রেজ আর আহিয়ান বসলো অন্য পাশে। খাওয়াদাওয়া করতে করতে চারজন বেশ কিছুক্ষণ আলাপচারিতা করলো।
ঘন জঙ্গলে, গাঢ় অন্ধকারের মাঝে এক রহস্যময় প্রাসাদ দাঁড়িয়ে আছে। তার সুরম্য স্থাপত্য যেন বছরের পর বছর অতিক্রান্ত সময়ের চিহ্ন বহন করছে। প্রাসাদের দেওয়ালগুলো কালো পাথরের তৈরি, যা মসৃণ হলেও শীতলতাকে ধারণ করে। এখানকার বাতাসে ভুতুরে একটি নিস্তব্ধতা ছড়িয়ে রয়েছে, যা রাতের গভীরতায় আরও প্রবল হয়।
সূর্য ডুবতে ডুবতে, আকাশে ছড়িয়ে পড়েছে লাল ও কমলা রঙের কুয়াশা। প্রাসাদের জানালাগুলোতে কালো পর্দা ঝুলছে, যেন কোনো অদৃশ্য আত্মা সেখান থেকে বাইরে দেখছে। বিশাল বিশাল খিলানগুলোতে ঝুলছে পুরানো মৃতশিল্পের প্রতিচ্ছবি, যেখানে ভ্যাম্পায়ারদের রহস্যময় মুখাবয়ব প্রতিফলিত হয়।
রাতের সাইরেনের মতো, জঙ্গলের পশুদের অদ্ভুত আওয়াজ প্রাসাদের চারপাশে প্রতিধ্বনি করে। হঠাৎ, একজোড়া লাল চোখ প্রাসাদের এক কোণ থেকে দেখা যায়, যা অন্ধকারে যেন আগুনের মতো জ্বলছে। যেন কোনো অশুভ সত্তা অপেক্ষা করছে, কাউকে আকর্ষণ করার জন্য।
প্রাসাদের ভেতর, এক দীর্ঘ হলরুমের মাঝখানে একটি বিশাল টেবিল। সেখানে রক্তের কাপে সবে মাত্র তাজা রক্ত ঢালা হয়েছে। আলো কমে আসার সাথে সাথে, অন্ধকারে ভ্যাম্পায়ারদের কালো কাপড় পরিহিত ছায়া চলাফেরা করতে থাকে। তাদের হাসি, একদিকে শীতল এবং অন্যদিকে ভয়ের।
এই প্রাসাদ, এক বিভীষিকার বাসস্থান—যেখানে রাতের গভীরতা রহস্যময়তা আর অশান্তির গল্প বলে। ইয়ান ওয়ারসকি হলরুমে প্রবেশ করতেই কিং জিয়ান ইশারায় বসতে বললেন। ইয়ান ধীরপায়ে এগিয়ে গেলো টেবিলের দিকে। হাতে তুলে নিলো রক্ত ভর্তি একটা গ্লাস। চুমুক দিলো তারপর বললো,
” আপনি তাহলে আপনার সিন্ধান্ত বদলাবেন না কিং? “
জিয়ান দৃঢ়ভাবে বলেন,
” না ইয়ান। তুমি কেনো চাচ্ছো না আন্দ্রেজ সিংহাসনে বসুক? “
” আন্দ্রেজ সিংহাসনে বসুক তাতে সমস্যা নেই। কিন্তু ওর পরবর্তী প্রজন্ম হবে আবারও সেই অর্ধ মানব ও অর্ধ ভ্যাম্পায়ার! যার অর্থ আগামী ভ্যাম্পায়ার জাতির রাজা হবে শুধুই ড্যাম্পায়াররা। “
জিয়ান নিজেও একটু গলা ভিজিয়ে নিলো। ইয়ানের কথাগুলো অমূলক নয়। তবে এটাই বিধির বিধান। ভ্যাম্পায়ার দেবতা শাং এর ভবিষ্যৎ বাণী অনুযায়ী ভ্যাম্পায়ারদের পরবর্তী প্রজন্ম হবে শুধু ড্যাম্পায়ার।
” আমি কি এসব বুঝি না ইয়ান? “
” ক্ষমা করবেন কিং। “
ইয়ান বসা থেকে উঠে হনহনিয়ে কক্ষ ত্যাগ করলো। আন্দ্রেজকে ছোটো থেকে লালন-পালন করলেও প্রকৃতপক্ষে ওর রাজা হওয়ার বিষয়টা মানতে পারছে না ইয়ান। আর এই বিষয়টাই আড়াল থেকে অন্য কেউ খেয়াল করে মুচকি হাসছে। কথায় আছে শত্রুর শত্রু হলো মিত্র!
আজকে সারাদিন ইভানাকে নিয়ে বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করেছে আন্দ্রেজ। বাংলাদেশে আসার আগেই ম্যাকের সাহায্যে রেবেকার কাছ থেকে ইভানার সমস্ত পছন্দ-অপছন্দের কথা জেনে নিয়েছিল ও। তাই ইভানাকে পেতেই একেবারে আদরযত্ন দিয়ে সব ভুল বোঝাবুঝি মিটিয়ে ফেলতে চাইছে আন্দ্রেজ।
ঘড়িতে এখন সময় রাত ন’টা বেজে পয়তাল্লিশ মিনিট। আন্দ্রেজ আর ইভানা মুভি দেখার জন্য সিনেমা হলে ঢুকল মাত্র। যদিও আন্দ্রেজ কখনো সিনেমা হলে যায়নি কিন্তু ইভানার না-কি হলে গিয়ে মুভি দেখতে খুব ভালো লাগে। তাই প্রিয়তমার মন গলাতেই তার পছন্দমত সবকিছু করছে বেচারা। হলে ঢুকে নিজেদের সিটে পাশাপাশি বসলো ওরা। ইভানা চুপচাপ হয়ে থাকলেও মনে মনে ঠিকই গলে গেছে। সারাদিন একসাথে থাকার পরও মানুষটা হাতটা পর্যন্ত ধরেনি ওর। এ যেন অন্য কোনো আন্দ্রেজ! গল্প, সিনেমায় দেখত ইভানা– নায়ক নায়িকার আগমনে সংশোধন হয়ে যায়। কিন্তু বাস্তবে যে কোনো পুরুষ এভাবে বদলায় ভাবতে পারেনি। আসলে পুরুষ মানুষ তার শখের নারীর জন্য সবকিছু করতে পারে, সবকিছু! কিন্তু অবশ্যই শখের নারী হওয়া চাই।
” কিছু ভাবছ ইভা? “
আন্দ্রেজের কথায় ভাবনার ছেদ ঘটল ইভানার। মুচকি হেসে মাথা নেড়ে বললো,
” কিছু না। “
” রাগ কমেছে? “
” রাগ তো করিনি! “
” বুঝলাম। এই অধমের প্রতি দয়া হয়েছে তবে? “
ইভানা চমকাল। এতো ভালো করে কথা বলছে আন্দ্রেজ? ইশ ম্যাক যদি থাকতো এখন! বিষয়টা খুবই আনন্দময় হতো।
” হু। “
” সত্যি! “
আন্দ্রেজ উত্তেজিত হয়ে বেশ জোরেশোরেই কথাটা বলে ফেলাতে সবাই ওর দিকে তাকিয়ে আছে। ইভানা আশেপাশের লোকজনের অবস্থা দেখে ফিক করে হেসে উঠলো।
” এটা পাবলিক প্লেস স্যার। “
” তাহলে কি প্রাইভেট প্লেসে যেতে চাও? “
কথাটা বলে নিজেই থতমত খেলো আন্দ্রেজ। স্বভাব কি এতো জলদি বদলায়? ইভানা কিছু বলার আগেই ফের বললো আন্দ্রেজ,
” অবশ্যই বিয়ে করে তারপর প্রাইভেট প্লেসে নিয়ে যাবো। ভুল বুঝো না আবার। “
ইভানা ঠোঁট কামড়ে হাসছে। এই মানুষটার সাথে সত্যি বিয়ে হবে? এতো সহজে সবকিছু পেয়ে যাবে ভাবতেই অবাক লাগছে ওর।
” ঠিক আছে। “
” সত্যি ইভা? “
” হুম। “
” তাহলে চলো। “
আন্দ্রেজ বসা থেকে উঠে ইভানাকেও উঠতে বললো। ইভানা অবাক হয়ে শুধালো,
” কোথায় যাবো? মুভি তো শেষ হয়নি! “
” রাখো তোমার মুভি! এখুনি তোমার বাসায় চলো। আমি বাবাকে কল দিয়ে বলছি আসতে। বিয়ের কথা বলতে যাবো। “
ইভানা ফ্যালফ্যাল দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে আন্দ্রেজের দিকে। লোকটা সব বিষয় এতো তাড়াহুড়ো করে কেন? একটুও কী রয়েসয়ে থাকা যায় না? এরমধ্যে হলের মধ্যের অন্য দর্শকেরা হৈহল্লা করতে শুরু করেছে। ইভানা বিষয়টা বুঝতে পেরে আন্দ্রেজের হাত ধরে সিটে বসালো। একটু ঝুঁকে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে বললো,
” একটু আস্তে আস্তে এগোন স্যার। আগামীকাল করলেও হবে সেসব।”
” আগামীকাল তুমি আমার বাড়ি বউ হয়েই আসছ ইভা। আমি অপেক্ষা করতে পারি না, পারবোনা। “
আন্দ্রেজের শেষের কথাটায় হয়তো কিছু একটা ছিলো। যাতে ইভানা লজ্জায় অন্য দিকে তাকিয়ে আছে।
( মুক্তমনাদের জন্য উন্মুক্ত।)
হুট করে আন্দ্রেজের বিয়ের কথা শুনে ইয়ান অবাক হয়েছে। সকাল সকাল কল দিয়ে আন্দ্রেজ নিজেই জানিয়েছে বিষয়টা। তবে ইয়ান যে এতে মোটেও খুশি হয়নি সেটা তার চেহারার ভাবভঙ্গি বলে দিচ্ছে। বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছে ইয়ান। রাগে হাত মুষ্টিবদ্ধ করে বারকয়েক গ্রিলে মারলো সে। সেই ছোটো থেকে ইয়ান বড়ো ভাই হওয়া স্বত্বেও ছোটো বোন অর্থাৎ আন্দ্রেজের মা সব সময় সবকিছু বেশি পেয়েছে। হোক সেটা বাবা- মায়ের ভালোবাসা কিংবা শক্তি সঞ্চয়ের বিষয়। সবদিক থেকেই আন্দ্রেজের মা এগিয়ে ছিলেন। বড়ো হওয়ার পরেও আন্দ্রেজের মা যখন মানবকে বিয়ে করলো তবুও তাকে কেউ কিছু বললো না! এমনকি ভাগ্য দেবতা ভবিষ্যত জানালেন এবং আন্দ্রেজকেই বেছে নিলো পরবর্তী রাজা হিসেবে। এসবকিছু ইয়ানের একদম সহ্য হচ্ছিল না। তাই ছলেবলে কৌশলে প্রথমে নিজের বোনকেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলো। তারপর কায়দা করে ওয়াসিম চৌধুরীর কাছ থেকে আন্দ্রেজকে নিজের সাথে পোল্যান্ডে নিয়ে গেলো। চেয়েছিল ছোটো থাকতেই শেষ করে দিতে ছেলেটাকে। কিন্তু দূর্ভাগ্যবশতঃ আন্দ্রেজের মাঝে দ্বৈত শক্তি বিরাজ করায় সেটা সম্ভব হয়নি । ওর মা মারা যাওয়ার আগের নিজের সবটুকু শক্তি নবজাত আন্দ্রেজকে দিয়ে গেছিলো। তাই চেষ্টা করা স্বত্বেও ইয়ান আজ পর্যন্ত আন্দ্রেজের কোনো ক্ষতি করে উঠতে পারেনি। তবে হ্যাঁ খুব করে চেয়েছে আন্দ্রেজ যাতে বিয়েসাদী না করতে পারে কিংবা কোনো মেয়ের সাথে বেশিদিন সম্পর্কে না থাকতে পারে। আন্দ্রেজই পথের কাঁটা, এরমধ্যে যদি ওর স্ত্রী, সন্তান হয় তাহলে ঝামেলা আরো বাড়বে। তাছাড়া আন্দ্রেজের বংশধর হবে আরো শক্তিশালী! চিন্তায় মাথা যন্ত্রণা করছে ইয়ানের। এখন সিলভাই ওর একমাত্র ভরসা। সিলভা ভ্যাম্পায়ার রাজ্যের মন্ত্রী। কিং জিয়ানকে শীঘ্রই নিজেদের রাস্তা থেকে সরানোর চেষ্টা করবে সে। এটাতে যদি সফল হতে পারে তাহলেই কেল্লাফতে! ইয়ান এসব ভাবতে ভাবতে বেশ খুশি হয়ে গেলো। নতুন আশার আলো হাতছানি দিচ্ছে যেনো। আপাতত বিয়েতে রাজি বলেই জানাবে আন্দ্রেজকে। পরেরটা পরে দেখা যাবে!
চৌধুরী বাড়িতে আজ বিয়ে! দীর্ঘ সময় পর এ বাড়িতে আবার বিয়ে লেগেছে। শহরের সবচেয়ে বড়ো ইভেন্ট প্ল্যানাররা বিয়ের জন্য চৌধুরী বাড়ি সাজাচ্ছে। ইভানার পরিবার বলতে বাবা-মা শুধু। বাবা-মায়ের একমাত্র মেয়ে। মেয়ের জন্য এতো বড়ো ঘরের সম্মন্ধে তাদের কোনো আপত্তি নেই। তাছাড়া ওদের সম্পর্কের বিষয়টা জানার পর তো আপত্তি করার আর কোনো সুযোগ ছিলোই না। সবমিলিয়ে খুব সুন্দরভাবেই ওদের বিয়েটা এগোচ্ছে। শিয়া আজ দারুণ খুশি। ও কখনো ভাবেনি আন্দ্রেজ ভাই এভাবে হুট করে কাউকে ভালোবাসতে ফেলবে অথবা বিয়ে করবে! আসলে মানুষ যা ভাবতেও পারে না মাঝে মধ্যে সেটাই হয়, আবার যা ভাবে তা হয় না। এ্যানি চৌধুরীর এসব আদিখ্যেতা মোটেও ভালো লাগছে না। যে ছেলে ছোটো থেকে কাছেই ছিলো না তার জন্য এতোকিছু করার কী দরকার? কিন্তু স্বামীর সাথে পেরে উঠেন না তিনি। ফলশ্রুতিতে সবকিছু চুপচাপ মেনে নিয়েই এগোচ্ছেন এ্যানি। তবে সুযোগমত আন্দ্রেজকে কথা শোনাতে ছাড়ছেন না।
” শিয়া! “
বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে সবকিছু কেমন সাজানো হয়েছে দেখছিল শিয়া। হঠাৎ আহিয়ানের কণ্ঠস্বর শুনে চমকে পেছনে ফিরে তাকাল।
” আপনি? “
” ইয়েস! বিয়েতে আমি তোমাদের বাড়িতে আসবো। “
আহিয়ান শিয়ার মুখোমুখি এসে দাঁড়িয়েছে। ওর কথার হেয়ালি ঠিক বোধগম্য হচ্ছে না শিয়ার।
” কী!”
” ভাইয়ার সাথে কথা হয়েছে আমার। ভাইয়া বলেছে শীঘ্রই আমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করবে এবং এই বিয়েতে ভাইয়া বন্ধুর পরিচয় আমি সারাক্ষণ তোমার আশেপাশে থাকছি। “
আহিয়ানের কথায় হাসলো শিয়া। আর্মি সাহেব তার প্রেয়সীর জন্য বড্ড ব্যাকুল হয়ে থাকে।
” ঠিক আছে। তবে হ্যাঁ বেশি ছুঁকছুঁক করবেন না। “
শিয়ার কথায় আহিয়ান ঠোঁট উল্টে বললো,
” যখন বললেই আমি ছুঁকছুঁক করি তখন না হয় একটুআধটু করি? “
আহিয়ান এই কথা বলে সামনে এগোতে গেলেই শিয়া দৌড়ে বাড়ির ভেতর চলে যায়। আহিয়ান মাথা চুলকে ঠোঁটের কোণে হাসির রেখা ঝুলিয়ে বাড়ি থেকে আপাতত বের হয়ে যায়।
মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে ইভানা। একমাত্র মেয়ের বিয়েতে যতটুকু সম্ভব সবটাই করেছে রাতুল। আসমা সিদ্দিকাও মেয়ের বিয়েতে ভীষণ খুশি। আসরের নামাজ শেষে ওদের বিয়ে। এখন দুপুর আড়াইটা। রোদে ঘেমে-নেয়ে একাকার অবস্থা সবার। এই রোদের মধ্যে রান্নাবান্নার সব কাজ বাড়ির বাইরে ইটের চুলোয় করছে। ইভানার সবকিছু কেমন স্বপ্ন স্বপ্ন লাগছে। একটা রাতের ব্যবধানে সবকিছু হয়ে গেছে? কীভাবে সবকিছু সামলে নিলো লোকটা?
ইভানাকে সাজানোর জন্য পার্লার থেকে লোক এসেছে। ড্রেসিং টেবিলের সামনে বসে নিজেকে সাজানোর প্রকিয়া পর্যবেক্ষণ করছে ও। ইভানার কিছু বান্ধবী ড্রেসিং টেবিলের পাশে বিছানায় গোল হয়ে বসে আছে।
” হ্যাঁ রে ইভানা! শুনলাম তোর হবু বর খুবই হ্যান্ডসাম! তা কীভাবে পেলি তাকে? “
বান্ধবী ঐশী কথাটা বলতেই তেতে উঠে ইভানা। ওর প্রিয়তমকে অন্য কেউ কেন হ্যান্ডসাম বলবে?
” শোন, একদম হ্যান্ডসাম বলবি না। তোদের নজর খারাপ। “
ইভানার কথা শেষ হতেই ঘরে হাসির রোল পড়লো। সবাই হাসাহাসি করছে। ইভানা অবশ্য সেসবে কান দিচ্ছে না। ওর ভাবনায় অন্য কিছু। একটু বাদেই আন্দ্রেজ বর সেজে বিয়ে করতে আসবে! ভীষণ এক্সাইটেড লাগছে মেয়েটার।
” মামা! তুমি তো চাইলেই আসতে পারো! “
ফোনের অপরপ্রান্তে বসে ইয়ান বিরক্তিতে চোখমুখ কুঁচকে ফেললো। গলায় মেকি ভালোবাসা এনে নরম কণ্ঠে বললো,
” বিয়ে করে কি তুমি আর পোল্যান্ডে আসবে না আন্দ্রেজ? না-কি ওখানেই থেকে যাবে? “
” মামা! আমি কী জিজ্ঞেস করলাম আর তুমি কী বলিতেছ? “
” আমি দিনের বেলায় কীভাবে থাকবো বলো? তোমাদের দেশের আবহাওয়া অন্য রকম। তাছাড়া রাতে গিয়ে আবার ফিরতে গেলে সমস্যা হতে পারে। “
” হুম বুঝলাম। ঠিক আছে। তাহলে ওদেশে গিয়ে আরেকবার বিয়ে করে নিবো। কী বলো মামা? “
” একদম আমার মনের কথা বলেছো আন্দ্রেজ! ভালোভাবে বিয়ে করে ফিরে আসো। আর শুভকামনা রইলো। “
আন্দ্রেজ কিছু বলতে যাবে এরমধ্যে শিয়ার হাঁকডাক শুনতে পেলো। বের হওয়ার সময় হয়ে গেছে।
” মামা এখন রাখছি। “
” ওকে। “
মামার সাথে কথা শেষ হতেই ঘর থেকে বেরুলো আন্দ্রেজ। আগে থেকেই রেডি হয়ে ছিলো বলে বের হতে আর দেরি হয়নি। শুভ্র পাঞ্জাবিতে দারুণ লাগছে আজ আন্দ্রেজকে। তবে এখানকার লোকজন এরকম সোনালী চুলওয়ালা ছেলেকে শুভ্র পাঞ্জাবিতে হয়তো দেখেনি। সারা রাস্তায় যেখানে যেখানে বরপক্ষ গিয়েছে সবাই আন্দ্রেজের দিকে তাকিয়ে থেকেছে। শিয়া আর আহিয়ান সবার সামনে বসেই বহুবার চোখে চোখে কথা বলেছে। কোনো কথা না বলে চোখের ইশারায়ও যে এভাবে ভালোবাসা প্রকাশ করা যায় ওদের না দেখলে বোঝা যায় না।
কিং জিয়ানের শরীরটা আজ একটু খারাপ যাচ্ছে। অমাবস্যার বেশি দেরি নেই। খুব বেশি হলে চার-পাঁচ দিন! এরমধ্যে আন্দ্রেজকে অবশ্যই ফিরতে হবে এখানে। কিন্তু আন্দ্রেজের বিয়ের খবরটা শুনে একটু চিন্তিত কিং। বিয়ের জন্য যদি কোনোভাবে বিষয়টা ওর মাথা থেকে বেরিয়ে যায়? নাহ! তাহলে অনর্থ হয়ে যাবে। নিজের কক্ষে শুয়ে শুয়ে এইসব ভাবছিলেন কিং জায়ান। হঠাৎ এমন সময় দরজার বাইরে এসে দাঁড়াল সিলভা।
” কিং আসবো? “
জিয়ান মাথা উঁচিয়ে এক নজর সিলভার দিকে তাকিয়ে বললেন,
” হ্যাঁ এসো। “
সিলভা ক্রুর হাসলো। তবে সেটা জিয়ানের নজরে পড়লো না। সিলভা ধীরপায়ে এগিয়ে এসে কিং জিয়ানের মাথার পাশে দাঁড়িয়ে ফের বললো,
” শুনলাম,আপনার শরীর খারাপ করলো! তা এখন কেমন লাগছে আপনার? “
” বিশেষ ভালো না সিলভা। তুমি ইয়ানকে বলো আন্দ্রেজকে দ্রুত সংবাদ পাঠাতে। ও যেনো বিয়ে সেরেই আমার শরণাপন্ন হয়। “
সিলভা কিয়ৎক্ষণ চুপ থাকলো। তারপর বললো,
” ঠিক আছে কিং। আপনার ইচ্ছে! “
জিয়ান লম্বা লম্বা নিঃশ্বাস ফেলে চোখ বন্ধ করে নিলেন। কথা বলতেও কষ্ট হচ্ছে। হঠাৎ করে কী হলো বুঝতে পারছেন না।
চলবে,