ঘাসফড়িং -১১
_____________
সকাল হলে সাদাত নিচে নামলো।তাকিয়াকে কোথাও দেখলোনা।হয়তো সে আগেই চলে গিয়েছে।সাদাত চিন্তিত হলোনা সে দুপুরের জন্য অপেক্ষা করছে।ইয়াসিনও চলে এসেছে।দেড়টা বাজতেই দু বন্ধু আবারো নিচে নামলো।গেইটের সামনে গিয়ে দাড়ালো।সাদাত দু হাত পিছনে মুট করে দাঁড়িয়ে আছে।তার ভঙ্গিমা দেখে বুঝা যাচ্ছে সে বাড়ি পাহারা দিচ্ছে।ইয়াসিন মুখ চেপে হাসলো।সাদাত অসহায় ভঙ্গিতে বললো।এভাবে হাসিস না ভাই।আমার বুক ধরফর করছে।আমি মনে হয় কথা বলতে পারবোনা ওর সাথে।
“আরে পারবি পারবি।
ইয়াসিন কথার ইতি টেনেই সামনে তাকালো।বোরকা পরিহিত একটি মেয়ে এদিকেই আসছে।সে সাদাত কে ইশারা করলো।সাদাত এক ধাপ পিছনে সরে গিয়ে বললো এটাই তাকিয়া।কিন্তু আমার খুব ভয় লাগছে। দেখ হাটু কাপছে।
” ইয়াসিন সব গুলো দাত বের করে বললো।আমি তোর হাটু ধরে রাখি কি বলিস?
“মজা নিস না।এটা সিরিয়াস মূহুর্ত।
” আচ্ছা ঠিকাছে একটা বুদ্ধি দেই শোন। তুই এখানেই দাড়িয়ে থাক, তিনি তোকে দেখলে অবশ্যই চিনতে পারবে।
” সাদাত ইতস্তত ভাব নিয়ে বললো। তুই কোথায় যাচ্ছিস? যাসনা।
“আমি আছি তোর পিছনে ভয় পাওয়ার কোনো কারন নেই।
” দুজনে দৃষ্টি সরাতেই তাকিয়ার দেখা পাওয়া গেলোনা।সাদাত হন্তদন্ত হয়ে বললো
” এই সামনে তো কেউই নেই।
“আরে আছে ওই দোকানটা তে গিয়েছে।
” একটা কাজ করলে কেমন হয়।চল আমরাও দোকানে যাই।
“গিয়ে কি বলবি?
” ওকে কিছু বলবো না। আমরা সেখানে কিছু কিনতে যাবো।
“আচ্ছা এটাও ভালো বুদ্ধি, চল দেখি।
দুজনে ধীরপায়ে হেঁটে হেঁটে দোকান অবধি পৌঁছালো । দোকানে কিছু মানুষের ভীর আছে যার দরুন তাকিয়া এক কোনায় চুপ করে দাড়িয়ে আছে। সে হয়তো মানুষের সমাগম কমার অপেক্ষা করছে।কিছুক্ষন পর তার ইচ্ছে বাস্তবে পরিণত হলো। কাস্টমারদের ভীর এখন নেই।তাকিয়া দোকানদার কে উদ্দেশ্য করে বললো।
” আংকেল, রুটি হবে?
“জি হবে, কত টাকার টা দিবো?
” কমের মধ্যেই একটা দিন।
দোকানদার আবার বয়স্ক লোক, পান খেয়ে দু ঠোঁট একদম লাল বানিয়ে ফেলেছেন।কিছু ক্ষন পর পরই চিপটি ফেলে দোকানের সামনে লাল রংয়ে রঞ্জিত করছেন। আঙুলের অগ্রভাগে চুন দেখা যাচ্ছে। লোকটি সাদাত দের পরিচিত। তার বাবার সাথে খুব ভালো বন্ধুত্ব। সাদাত দোকানে পা রাখতেই ভদ্র লোক এক চিমটি চুন মুখে দিয়ে বলতে থাকলো।আরে সাদাত বাবাজী কি খবর?
“সাদাত মুচকি হেসে বললো।এইতো আংকেল ভালো আপনার কি খবর।
“এইতো আল্লাহ ভালোই রাখছেন।
তাকিয়া জড়োসড়ো হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।দোকানটি অবশ্য খুব বড়সড় , দুজন কর্মচারীর উপস্থিতি সব সময়ই এখানে দেখা যাবে, কিন্তু আজ একটু ব্যতিক্রম, লোকটি একাই দোকানে উপস্থিত আছেন। তাকিয়া সাদাত দের উপস্থিতি পেয়ে ঘুরে তাকালোনা।সে আঁচ করতে পারলো দোকানে দুইটি ছেলে প্রবেশ করেছে।তাই সে তার নেকাবের নেট পার্ট ফেলে দিলো।এখন তার চক্ষু দেখা যাচ্ছেনা। সাদাত তাকিয়ার মধ্যে কোনো প্রতিক্রিয়া দেখতে পেলোনা।তাই সে তার পাশে এসে দাড়ালো। তাকিয়া তার ব্যাগ থেকে টাকা বের করায় ব্যস্ত। দোকানদার মুখ নাড়াতে নাড়াতে রুটির প্যাকেট টি সামনে রাখলেন। সাদাত অপ্রকৃতস্থ হয়ে রুটির প্যাক টি নিজের হাতে নিয়ে নিলো।তাকিয়া বিষয়টি লক্ষ করলো।সে তার দৃষ্টি নত রেখেই বললো এটা আমি অর্ডার করেছি।
” সাদাত কাপা স্বরে বললো।আমিও এটা নিতে এসেছি।
“তাকিয়া কথা বাড়ালোনা।
দোকানদার সাদাতকে উদ্দেশ্য করে বললো।
” বাবা তোমারও কি একি জিনিস লাগবে?
“সাদাত মাথা নাড়ালো।
” তুমি মেয়েটিকে এটা দিয়ে দাও, আমি তোমাকে আরেকটা দিচ্ছি।
তাকিয়া নিচু গলায় বললো।
“এটা উনিই নিক, আমাকে আরেকটা দিন। দোকানদার তাই করলো।
তাকিয়া টাকা দিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে এগুতে থাকলো। সাদাত হা করে তাকিয়ে আছে।
ইয়াসিন বিস্ময় কন্ঠে বললো।
” ভাবি একবারও তোর দিকে তাকালোনা।
“হুঁ!সেটাইতো দেখালাম।
” আংকেল তো তোর নাম ধরেও ডেকে ছিলো তখন তো তাকাতে পারতো।
“ও আমাকে মাফি নামে চিনে।ঢাকা আসার পর সবাই আমাকে সাদাত নামে ডাকে।
“ইয়াসিন সাদাতের কাধে হাত দিয়ে বললো। আচ্ছা চল তিনিতো বাসায়ই যাচ্ছেন তাঁর পিছু পিছু যাই।
তাকিয়া প্রধান গেইটে এসে কিছুক্ষণ দাড়ালো।সাদাত ধারণা করলো।এই বুঝি সে পশ্চাতে দৃষ্টি দিবে। না তা হলোনা।তার ধারণা ভুল প্রমাণিত হলো।তাকিয়া গেইটের ভিতর প্রবেশ করলো।এবং দারোয়ানের কক্ষের দিকে এগিয়ে গেলো। নিচ তলার এক পাশে ছোট্ট একটি রুম করে দেয়া হয়েছে দাড়োয়ানের জন্য।মাঝে মাঝে তার পরিবার এখানে আসে। আজ তার স্ত্রী এবং ছোট মেয়ে এসেছে।তাকিয়া সেদিকেই যাচ্ছে।তাকিয়া ছোট্ট মেয়েটিকে দেখে কাছে টেনে নিলো।আদর করলো।এবং তার হাতে থাকা রুটির প্যাক টি মেয়েটির হাতে দিয়ে দিলো।এরপর উপরে চলে আসলো।লিফট দিয়ে উঠলোনা।সিড়ি দিয়ে উঠলো।মস্তিষ্ক আর দিলে রয়েছে আল্লাহু আকবার।সে একাগ্রচিত্তে আল্লাহর নাম জপে জপে উপরে আসলো।
সাদাত আর ইয়াসিন পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষন করলো।সাদাত তাকিয়ার এহেন ব্যবহারে প্রচন্ড খুশি হলো। অন্তরিন্দ্রিয় ধ্বনি তার কর্ণলতিকায় এসে বলছে ।মেয়েটি পুরো পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে সুন্দরী , কারণ তার সুন্দর একটি মন রয়েছে।যাকে দেখলে কখনো ক্লান্তি আসবেনা।আফসোস হবেনা। ইয়াসিন সাদাতকে মুচকি হেসে বললো।ভাবি খুবই ভালো মানুষ। আর দেরি করিস না।দ্রুত বিয়েটা সেরে ফেল।আর আমাদের দাওয়াত দে।কতদিন যাবত দাওয়াত খাইনা।
” হুঁ দিবো দিবো।শুধু দুয়া কর। চল উপরে যাই।
সাদাত লিফটের সামনে এসে দাড়ালো।কিছু ভেবে বললো।চল সিড়ি দিয়ে উঠবো।
“আমি কিন্তু কিছু বুঝতেছি।
” সাদাত জোর আওয়াজে হাসলো।এবং বললো।বুঝলে ভালো এবার চল।
রাফিয়া আজ দ্রুত বাসায় ফিরেছে।সে এই কাণ্ড গুলো শুরু থেকে শেষ অবধি রাস্তায় দাড়িয়ে দেখেছে। মনের অজান্তেই তার কার্নিশ বেয়ে দু ফোটা পানি নিচে গড়িয়ে পড়েছে। বরাবরই তার ধৈর্য শক্তি কম। সে স্বীয় চোখে এসব দেখার পর নিজেকে আর নিয়ন্ত্রণ করতে পারলো না।
প্রচন্ড গোস্বা নিয়ে উপরে উঠলো।কপাটের সামনে এসে অন্যদিনের মত কলিংবেল বাজালোনা।জোর গলায় তাকিয়াকে ডাকলো।
তাকিয়া সবে মাত্র খাবারের প্লেট নিয়ে বসেছে, পান্তা ভাত, সাথে এক টুকরো পেয়াজ, এবং দুটো শুখনো মরিচ।রাতে ভাত গুলো বেশি হয়েছিলো। অপচয় না করার শর্তে ভাতে পানি দিয়ে রাখা হয়েছে।সেগুলোই খেতে বসেছে সে।
রাফিয়ার আওয়াজ শুনে তার মা দরজা খুললো।রাফিয়া ক্রোধভাব নিয়ে রেবেকাকে উদ্দেশ্য করে বললো।
“এতো দেরি করলে কেন দরজা খুলতে?
” আমি গোসলখানায় ছিলাম। আর তাকিয়া খাচ্ছে,তাই দেরী হয়েছে।তোমাকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে খুব, কি হয়েছে মা?
”আমার কি হয়েছে সেটা তোমার না জানলেও চলবে।আগে বলো ওই কাজের মেয়ে কোথায়।আজ তার সাথে আমার বোঝাপড়া আছে।
“তাকিয়া তার রুমে। কি হয়েছে তোমার বলবে?
” রাফিয়া অপেক্ষা করলোনা। সে দৌড়ে তাকিয়ার কক্ষে প্রবেশ করলো।আগ পিছ না ভেবেই তাকিয়ার খাবারের প্লেট টি মাটিতে ফেলে দিলো।
বেচারি কিছুই বুঝলনা।শুধু প্রশ্নবিদ্ধ নয়নে রাফিয়ার দিকে চেয়ে থাকলো।রাফিয়া শাহাদাত আঙুল খাড়া করে তাকিয়াকে বললো। এই তুই চাস কি বলতো।বাড়িতে থাকতেও তোর জন্য আমাকে কেউ পছন্দ করতোনা।সবাই শুধু তোর কাছে গিয়েই বসে থাকতো।আমি যাদের পছন্দ করতাম তারা শুধু তোকেই পছন্দ করতো।
এখন আবার সাদাতের পিছনে লেগেছিস।সাদাতকে আমার থেকে কেড়ে নিতে চাস তাইতো?সমস্যা কি তোর, তোকে মাদ্রাসায় পাঠানো হয়েছে পড়া লিখা করার জন্য, ছেলে পটানোর জন্য নয়।
আজ সাদাতের সাথে দোকানে দাড়িয়ে কি কথা বলেছিস সব বল আমায়? নয়ননীরে তাকিয়ার গণ্ডদেশ স্নান সেরে নিয়েছে। সে কিছুই বুঝতে পারছেনা রাফিয়া কি বলছে।তবুও সে বুকে সাহস নিয়ে বললো।তুমি কি বলছো, আমি কিছুই বুঝতে পারছিনা।আমি সাদাত নামের কাওকেই চিনিনা।ছেলেদের পটাতে আমি কেন যাবো!তোমার কোথাও ভুল হচ্ছে আপু।
রাফিয়া আরো রেগে গেলো।এবার মৌখিক আঘাত মারা মারিতে রুপান্তরিত হলো।সে তাকিয়ার চুল গুলো শক্ত করে ধরে বললো।তোর মত মেয়েকে আমার চিনা হয়ে গেছে।এখন ভালোই ভালোই সত্যিটা বল।
“আচ্ছা আমি বলছি তুমি আমার চুল টা ছাড়ো। আমি খুব ব্যথা পাচ্ছি।
রেবেকা নিরব দর্শক হয়ে সব পরখ করছে।মেয়েকে একদমই আটকাচ্ছেনা। সাদাতের কথা শুনেও বিচলিত হচ্ছেনা।কারন রাফিয়া তাকে সাদাতের সম্পর্কে জানিয়েছে।রেবেকা মেয়েকে কথা দিয়েছে,সাদাতের সাথেই তার বিয়ের ব্যবস্থা করবে।রেবেকারও সাদাতকে খুব পছন্দ।
একদা রেবেকা বাজার নিয়ে বাসায় আসছিলো, তার হাতে জিনিস পত্র বেশি থাকায় উপরে উঠতে কষ্ট হচ্ছিলো।বিষয়টি সাদাতের দৃষ্টিগোচর হলে সে তাঁকে সাহায্য করে।সেদিন থেকেই রেবেকা সাদাতকে পছন্দ করতে থাকে।একজন ভালো ছেলেকে কে-ই বা চাইবেনা মেয়ের জামাতা হিসাবে দেখতে।তাকিয়া ব্যথায় জোরে জোরে কাদঁতে থাকলো।এখন রেবেকার মানবতা কিছুটা উঁকি দিলো।
সে রাফিয়া কে উদ্দেশ্য করে বললো।
” রাফিয়া ওকে ছেড়ে দাও, আমি জিজ্ঞাসা করছি।
তাকিয়া রাফিয়া যা বলছে তা সত্যি?
” তাকিয়া নিশ্চুপ।
“তাকিয়া আমি তোমাকে কিছু জিজ্ঞাসা করছি।
” মা সত্যি এই সাদাতটা কে আমি চিনিনা।তবে আজকে দোকানে একটি ছেলে নিজ থেকে আমার সাথে কথা বলেছে, এটাই সত্যি। কিন্তু আমি ছেলেটাকে যতটা পেরেছি উপেক্ষা করেছি।
কারন আমি তাকে চিনিনা।
“রাফিয়া কর্কশ কন্ঠে বললো।
মা ওর কথা একদম বিশ্বাস করবেনা।
আমি সাদাত কে কয়েক বছর যাবত চিনি, আমি তাকে সবসময় দেখেছি, সে মেয়েদের ইগনোর করে চলে।আর ওর সাথে সে নিজে থেকে কথা বলবে তোমার মনে হয়?
দুপুরে আর তাকিয়ার ভাত খাওয়া হলোনা।সে স্বীয় স্থানে শুয়ে শুয়েই কাঁদতে থাকলো।এখন রাত হয়ে গিয়েছে। সকলে ঘুমিয়ে পড়েছে।তাকিয়া এখনো ঘুমায়নি।সাদাতও ঠিক তাই।তাকিয়া জানালা খুলে দিলো।বাহির থেকে আসা বাতাস তার দ্বীর্ঘশ্বাসের ভারত্ব অনুভব করতে পারলো।তাকিয়ার আজ এশারের নামাজ পড়তে দেরি হয়েছে।রাতে আর খাওয়া হয়নি।সে নামাজ পড়েই জানালার পাশে গিয়ে বসলো। ধরণিতে সুনসান নিরবতা বিরাজ করছে।পুরোপুরি সুনসান বললেও ভুল হবে কারণ গাড়ির পিপ ধ্বনি কর্ণকুহরে ভেসে আসছে।গ্রামের ন্যায় এখানে ঝিঁঝিদের আনাগোনা নেই। তাকিয়া অপলোক নয়নে গগনে তাকিয়ে আছে।সেথায় মিষ্টি চন্দ্রমার অবস্থান স্থিতিশীল। তাকিয়া অন্যদিনের মত আজও চাঁদ দেখছে। পাশে কিছু নক্ষত্র ঘুরে বেড়াচ্ছে।তাকিয়ার চোখের পাপড়ি ভিজে উঠলো।সে নিজেকে স্বাভাবিক করে নিলো।চাঁদ থেকে দৃষ্টি হটিয়ে বাতায়নের সামনে থাকা কৃষ্ণচূড়া গাছটির দিকে তাকালো।ফুল গুলো যেন তাকিয়ার দিকে চেয়ে আছে।তাকিয়া তাদের দেখলো।সে একটি ফুল নিতে চায়। বাতায়ন দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলো।কিন্তু ব্যর্থ হলো।আবারো চেষ্টা করলো। এবারো ব্যর্থ হলো।এক বিঘতের ফারাক।তাকিয়া তার কক্ষে বড় লাঠি খুজতে থাকলো।বেশিক্ষন অপেক্ষা করতে হলোনা।সে খাটের নিচে একটি লাঠির দেখা পেলো।সাদাতও তার কক্ষের বাতায়নের পাশে বসে আছে।সে চাঁদ দেখতে বসেছে।সে এখন নিয়ম করে চাঁদ দেখে। সেথায় তাকিয়ে থাকে।তাছাড়া আজ তার মনও কিছুটা বিষন্ন। সে তার মায়ের সাথে তাকিয়ার ব্যাপার নিয়ে আলোচনা করেছে। তার মা জানিয়েছে আগে ইফতা শেষ করো এরপর তোমার বাবার সাথে ওর ব্যাপারে আলোচনা করবো।এ অবধি ওর সাথে যোগাযোগ করবেনা একদমই।যদি তার সৎ মা আঁচ করতে পারে আমরা তাকিয়ার পরিচিত তবে তাকিয়ার জন্য বিষয়টি হুমকিস্বরূপ হয়ে যাবে। এসব কারনেই সাদাতের মন ভালো নেই।সে চন্দ্রিমার দিকে এক দৃষ্টিতে চেয়ে আছে।বেশিক্ষন এ অবস্থা স্থায়ী হলোনা।উপরের বাতায়ন দিয়ে কে যেন কৃষ্ণচূড়া গাছ থেকে ফুল ছিড়তে চাচ্ছে।সাদাত বিষয়টি বুঝার চেষ্টা করলো।উপরের তলায় রাফিয়ারা থাকে।এমনও হতে পারে এটা তাকিয়ার কাজ।কারণ রাফিয়া হলে কাজের থেকে মুখ বেশি চলতো।কিন্তু যে এখানে অবস্থান করছে বুঝাই যাচ্ছে তিনি প্রয়োজন ব্যতিরেকে কথা বলেননা।সাদাত বিষয়টি আঁচ করতে পেরে মুচকি হাসলো।গাছটির একটি ডাল সাদাতদের বাতায়নে ঠেকেছে। সাদাত ডাল টি শক্ত করে ধরে উপরের বাতায়নের কাছে ঠেলে দিলো।তাকিয়া কিছুটা অবাক হলো।কিন্তু সম্মুখে ফুল দেখেই সব ভুলে গেলো।কিছু ফুল নিয়ে ডাল টি ছেড়ে দিলো।সাদাত নিচে থাকা ছায়া নকশার মাধ্যমে ব্যপারটি প্রত্যক্ষ করলো।তাই সেও ডাল টি ছেড়ে দিলো।তাকিয়া নিচে উঁকি দিলো।৩য় তলার জানালা দিয়ে কেউ তার উপস্থিতি টের পাচ্ছে। এ ব্যাপারে সে নিশ্চিত হলো।সে দ্রুত জানালা বন্ধ করে দিলো।কিন্তু কিছু একটা মনে হতেই সে আবারো জানালা খুললো।ভ্রুঁ জোড়া কুঞ্চিত করলো।তার মন আর মস্তিষ্ক এক হয়ে তাকে কিছু একটা বলতে চাচ্ছে।সে শুনলো তাদের কথা।তারা বললো মাফি তোমার আশে পাশেই আছে।তাকিয়া এবারো এসব মন থেকে ঝেড়ে ফেলে দিলো।মাফি এখানে কিভাবে আসবে।তাকিয়া আবারো নিচে তাকালো।জানালাটি এখনো খোলা।তাকিয়া তার ঘরের আলো নিভিয়ে দিলো।সাথে সাথে নিচে থাকা ঘরটিতেও আলো নিভিয়ে দেওয়া হলো। তাকিয়ার কাছে ব্যপারটি অদ্ভুত মনে হচ্ছে।সে এসব মাথা থেকে বাদ দিয়ে ঘুমাতে চলে গেলো।বালিশের পাশেই কৃষ্ণচূড়া ফুলটি রাখা।তাকিয়া এই গভীর তমসায় ঘুমের রাজ্যে পারি দিলো।সাদাত বসে বসে এখনো চাঁদ দেখে যাচ্ছে।
আসছে,,
ঘাসফড়িং -১২
~~~~~~~~~~
এখনো ক্লাসের ঘন্টা পড়েনি, এর আগেই তাকিয়া মাদ্রাসায় চলে গেছে। অন্য দিন নিজ থেকেই সবার সাথে কথা বলতো। কিন্তু আজ এর ব্যতিক্রম।নিশ্চুপ রবে এক কোনায় বসে আছে।বিষয়টি সানিয়ার দৃষ্টিগোচর হলে সে তাকিয়ার পাশে গিয়ে বসলো।সানিয়া তাকিয়ার সহপাঠী। খুব ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ।এই মাদ্রাসায় সে ছোট থেকেই আছে।সানিয়া অনেকটা মিশুক সেই সাথে কিছুটা দুষ্ট। তার সামনে সহজে কেউ মন খারাপ করে থাকতে পারেনা।সে তার ঠোটের কোনে মুচকি হাসির রেখা টেনে তাকিয়াকে বললো।
“কি ব্যপার ফুলটুসি, আজ মুখ এতো ভার করে রেখেছো কেন?কি হয়েছে।
” তাকিয়া জোর পূর্বক হেসে বললো।
কই,কিছুনা তো আমি তো ঠিকাছি।
“হুম সে তো দেখতেই পাচ্ছি।বলে ফেলো কি হয়েছে?
” তাকিয়া আর জোরপূর্বক হাসতে পারলোনা।তার অক্ষিযুগল অনিচ্ছাসত্ত্বেও স্বীয়নীরে ভরপুর হয়ে গেলো।সে ডান হাত উল্টিয়ে অশ্রু মুছলো।ব্যাপারটি খুব অদ্ভুত।বিশেষ করে সানিয়ার কাছে।
তাকিয়া খুব নরম স্বভাবের তা ঠিক আছে।কিন্তু যতদিন তাকে দেখেছে মনে হয়েছে যথেষ্ট ধৈর্যশীল।হঠাৎ কি হলো মেয়েটার।সানিয়া প্রশ্নবোধক ভঙ্গিতে তাকিয়ার দিকে তাকিয়ে আছে। তাকিয়া নিরবতা ভেঙে বললো। মাদ্রাসায় হয়ত বেশি দিন থাকা হবেনা তাই মন খারাপ। আমি আজ এসেছি, বড় খালামনির সাথে কথা বলার জন্য। তিনি কি আজ মাদ্রাসায় আসবেন?
“হুঁ আসবেতো কিন্তু তুমি কি নিয়ে কথা বলবে?
” আমি মাসে দু তিন দিন শুধু ক্লাস করতে চাই।আর পরীক্ষাটা দিতে চাই।
“তো বাকি দিন গুলো কি করবে?
” আমার বোন সকালে কলেজের উদ্দেশ্যে বের হয়, সন্ধায় বাড়িতে আসে।মা বেশির ভাগ সময় বাসায় একাই থাকে, তাছাড়া সপ্তাহে দুই তিন দিন তিনি গ্রামে থাকেন।সেই সাথে আমাদের পারিবারিক কিছু সমস্যাও আছে। সব মিলিয়ে আমি এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছি।কিন্তু বড় খালামনি কি এ সিদ্ধান্ত মেনে নিবেন?
“হুঁ নিবেনা কেন? তোমার মত আরো দুজন রয়েছে তারা শুধু এসে পরীক্ষাটা দিয়ে যায়।কিন্তু তোমার মায়ের সাথে আগে কথা বলে নিতে হবে।
” মা-ই বলেছে এভাবে করতে।
“ওহ, তাহলে কথা বলো।দেখো খালামনি কি বলে?
” হুঁ.
“আচ্ছা চলো ক্লাসে,যাই।কিছুক্ষন বাদেই ক্লাসের প্রস্তুতির ঘন্টা পড়ে যাবে।
রাফিয়া রাতে সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছে,যে করেই হোক খুব দ্রুত সাদাতের কাছে তাকে পৌঁছাতেই হবে। সে আনিধার কাছ থেকে জানলো, সাদাত কি কি খেতে পছন্দ করে।সাদাতের পছন্দ গুলো আর তাকিয়ার পছন্দ গুলো একদম কাছাকাছি। অনেক টা কাকতালীয় ব্যপার।অর্থাৎ তাকিয়া যা পছন্দ করে সাদাতও সেম জিনিসই পছন্দ করে। বিষয়টি রাফিয়াকে অবাক করলো। কিন্তু সে এসব বিষয় নিয়ে মাথা ঘামানোর প্রয়োজন মনে করলোনা। সে সিদ্ধান্ত নিলো সাদাতের পছন্দের খাবার গুলো নিজ হাতে রান্না করে সাদাতের মায়ের কাছে দিয়ে আসবে। রাফিয়া এসব চিন্তায় মশগুল।সহসা আনিধার ডাকে তার ধ্যান ভাঙলো। আনিধা বললো।
” কিরে কি হয়েছে। এতো কি চিন্তা করছিস।
“না তেমন কিছুই না।তোর ভাইয়াকে কিভাবে পটাতে পারবো সেটাই ভাবছি।
” ওহ, ভাইয়া যেই কঠোর দীলের মানুষ। মনে হয়না পারবি?
“রাফিয়া কপালে ভাজ ফেলে বললো তোর মনে হয় আমি পারবো না?কিন্তু আমার মন বলছে আমি অনেকটা পেরেছি।
” যেমন?
” আগে তিনি কথায় কথায় আমাকে ধমকাতেন। কিন্তু এখন সেটা করেননা।
“আনিধা অট্টহাসি দিয়ে বললো।এতক্ষণ খুজে এটাই বের করলি। আমি তো ভেবেছিলাম আরো কত কি জানি বলে ফেলবি।
” আচ্ছা তুই আমাকে অপমান করছিস তাই না?
“আরে বোকা তোকে অপমান করতে যাবো কেন? তুই আমার এক মাত্র বান্ধবী বলে কথা।
আনিধা কাধে ব্যাগ নিয়ে বললো। চল ক্যান্টিনের দিকে যাই।আর তুই চিন্তা করিস না। একদিন না একদিন ভাইয়া ঠিকই তোকে বুঝতে পারবে।
” রাফিয়া একটি স্বস্তির নিশ্বাস নিয়ে বললো।তাই যেন হয়।
—
তাকিয়া মাদ্রাসা থেকে বের হয়ে মাদ্রাসার এক স্টুডেন্ট এর বাড়িতে গিয়েছে। সেখানে যাওয়ার পিছনে একটি কারন ছিলো।সে তার কিছু বই তাকে পড়তে দিয়েছিলো।সেগুলোই আনতে গিয়েছে।সে তার বই গুলো নিয়েই দ্রুত বাড়ির উদ্দেশ্যে বেরিয়ে পড়লো। আজ বড্ড একা লাগছে তার।মায়ের কথা খুব মনে পড়ছে।সে রাস্তার কিনারা দিয়ে দুঃখ ভরা মন নিয়ে হেঁটে চলেছে।যদিও এখন দুপুর তবুও আকাশে মেঘের আনাগোনা দেখা যাচ্ছে। মনে হচ্ছে বৃষ্টি হবে।গাছ পালা গুলো একটা একটার উপর নুয়ে পড়ছে। বাতাসে তীব্রতা এতটাই বেশি যে রাস্তায় পড়ে থাকা পলিথিন গুলো আপন মনে উড়ে বেরাচ্ছে,কয়েকটা ঈশান কোনে মিলেয়ে যাচ্ছে এবং কিছু পলিথিন তো বাস, মাইক্রোর সামনে থাকা গ্লাসের উপর যেয়ে আঁছড়ে পড়ছে,বিষয়টি ড্রাইভারদের জন্য বিরক্তিকর । রাস্তার পাশে বসে থাকা হকার রা মাথার উপর ছাদ খুজার আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছে। পরভৃৎরা (কাক) পত্রপল্লবের ফাঁকে যেয়ে আসন পেতে বসে পড়েছে।মোট কথা সবাই বৃষ্টি থেকে পরিত্রাণের জন্য প্রানপন চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু তাকিয়ার মনে এসব নিয়ে কোন ভয় নেই। সে অশ্রুসিক্ত নয়নে সামনে এগিয়ে যাচ্ছে।তাকিয়া হাঁটতে হাঁটতে এক জায়গায় এসে দন্ডায়মান হলো।তার পা সামনে আগাচ্ছেনা।হৃদপিণ্ড কাপছে। সে সামনে থাকা ছেলেটিকে দেখে খুব অবাক হলো। ছেলেটি ফোনে কথা বলছে।সে তার খুব পরিচিত একজন। হয়তো সে তাকেই এতদিন খুজছিলো। তাকিয়া ছেলেটির কাছে এগিয়ে গেলো।সে এখনো ফোনে কথা বলায় ব্যস্ত।
তাকিয়া আগপাছ না ভেবে প্রশ্ন করলো।
“মাফি ভাইয়া?
” ছেলেটি তাকিয়ার দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকলো।এরপর অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে বললো।
আমাকে বলছেন?
“জী। আপনিইতো মাফি।
” দুঃখিত আপনার কোথাও ভুল হচ্ছে আমি মাফি না।
“আরে না আপনিই মাফি। আপনার চেহারা সেটাই বলে দিচ্ছে।আর আমি হচ্ছে আপনার ছোট বেলার বন্ধু তাকিয়া।
” দেখুন আপনার কোথাও একটা ভুল হচ্ছে হয়তো।সাদাতের ফোন আবারো বেজে উঠলো। সে তাকিয়াকে উপেক্ষা করেই সামনে এগিয়ে গেলো। বেচারি ফ্যাল ফ্যাল নয়নে সাদায়ের প্রস্তান দেখতে লাগলো।কিন্তু সে বেশি দুর যেতে পারলো না। আবারো তাকিয়ার দিকে ঘুরে দাড়ালো। তাকিয়ার মুখ খানা মুহুর্তের মধ্যেই হাস্যজ্জোল হয়ে উঠলো।
ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন
ঘাসফড়িং -১৩
_____________
সাদাতকে আসতে দেখে তাকিয়া খুব খুশি হলো।ভিতরে প্রান সঞ্চয় হলো।যাক আপাতত মানুষটি ঘুরে দাড়িয়েছে।হয়তো এখন এসে এটাই বলবে আমি তোমাকে চিনতে পেরেছি তাকিয়া।কিন্তু এসবের কিছুই ঘটলোনা তাকিয়ার সাথে।সাদাত ফিরেছে কারন গগনের অবস্থা তেমন ভালো না।এমন পরিস্থিতিতে তাকিয়ার বাহিরে থাকা তার কাছে বেমানান লাগছে।তাই সে তাকিয়ার সম্মুখে আসার পূর্বে স্বীয় মনকে দৃঢ় করলো,কোনো ভাবেই তাকিয়ার কাছে পরিচয় দেওয়া যাবেনা।এখনতো মোটেও না।সে তাকিয়ার সামনে এসে শাহাদাত আঙুলের অগ্রভাগ দিয়ে ভ্রু চুলকাতে চুলকাতে বললো।
“দেখুন আপনার কেনইবা মনে হচ্ছে আমি মাফি জানিনা।তবে আমি আপনাকে একটা কথা বলি শুনুন।আকাশের অবস্থা ভালোনা।প্রচণ্ড বায়ু প্রবাহের সংকেত দিচ্ছে।তাছাড়া আপনি একজন মেয়ে মানুষ। এ সময় আপনি এখানে কি করছেন?
” আমি কি করছি না করছি সেটা পরে বলবো, আগে বলেন আমাকে চিনতে পেরেছেন কি না?
“ঢাকা শহরে হরেক রকম মানুষ বসবাস করে এখন তাদের মধ্য থেকে কেউ যদি এসে আমাকে জিজ্ঞাসা করে আমাকে চিনতে পেরেছেন? তাহলে এর উত্তরে কি বলা উচিত? আপনিই বলুন।
” কি আর বলবেন। অবশ্যই না সূচক কিছু বলবেন।
“হুঁ তাহলেতো আপনি আপনার উত্তর পেয়েই গিয়েছেন।
“দেখুন আপনি যে মাফি এ ব্যপারে আমি নিশ্চিত। কারন আপনি আমাকে না চিনলে ২য় বার আসতেননা।এখন কথা হলো আপনি হয়তো আমার সাথে পরিচিত হতে চাচ্ছেন না।সমস্যা নেই আমিও আপনাকে বিরক্ত করছিনা ভালো থাকবেন।তাকিয়া কাধে থাকা ব্যাগ টি শক্ত করে ধরলো।সাদাতকে পাশ কাটিয়ে সে এখন সম্মুখে এগিয়ে গিয়েছে।তার অন্তরিন্দিয় উপলব্ধি করছে, সাদাত তাকে ডাক দিবে।কিছুটা আগানোর পর তার মনস্কাম পূর্ণ হলো।
“এই যে শুনুন।
” তাকিয়া সাথে সাথেই ঘুরে তাকালো। গাঢ় স্বরে বললো।কি হলো. আপনি তো আমাকে চিনেন না।তাহলে ডাকলেন কেন?
“দেখুন আকাশে খুব মেঘ জমেছে। আমি বলি কি আপনি যেহেতু একজন মেয়ে মানুষ, একা হেঁটে যাওয়ার প্রয়োজন নেই।রিকশা করে চলে যান।
” তাকিয়া এবার সাদাতের এভিমুখে এসে দাড়ালো।ভ্রু জোড়া কুঞ্চিত করলো।সাদাত অবশ্য এসবের কিছুই আঁচ করতে পারলোনা।কারন তাকিয়া নেকাব দিয়ে মুখ ডেকে রেখেছে।সে তাচ্ছিল্যের স্বরে বললো।এক মিনিট!!!আমি হেটে গেলে আপনার সমস্যা কোথায়, আপনিতো আর আমাকে চেনননা তাইনা?
“বৃষ্টি নামতে পারে তাই বললাম আর কি?
” নামুক না তাতে কি হয়েছে? ভিজে ভিজে যেতে পারবো আমি।
” আপনি আমাকে সন্দেহ করছেন ।আমি মানবতার খাতিরে এসব বলছি।
” ও তাই বুঝি, রাস্তায় মেয়েদের দেখলেই আপনার মানবতা উঁকি দেয়?
“আপনি শুধু শুধু সমন্বয় করছেন। আমি রিকশা ডাকছি।আপনি বরং রিকশা তে চড়ে চলে যান।
সাদাত এক হাত উঁচু করে রিকশা ডাকলো।এই মামা কলাবাগান যাবেন?রিকশা চালক মুচকি হেসে মাথা নাড়ালেন ।মানে তিনি যাবেন।সাদাত ইশারা করে তাকে আসতে বললেন।
” তাকিয়া সাদাতের কথার রেশ ধরে বললো।ও ভালোইতো কোথাই থাকি তাও দেখি জানেন।শুধু আমাকেই চিনতে পারছেন না।
“ইয়ে মানে দুঃখিত, আমি সব সময় এই ঠিকানা বলেই রিকশাতে উঠি, তাই বলে ফেললাম।
আচ্ছা কোথায় যাবেন বলুনতো উনাকে?
” থাক হয়েছে প্রচুর ঢং করেছেন, আর করতে হবে না। আসলে চোরেরা সবসময় এভাবেই ধরা পড়ে।
“কি বলছেন কিছুই বুঝলামনা।
” থাক বুঝতে হবেনা মাফি ,,,।আপনি বরং রিকশার ভাড়াটাও দিয়ে দেন।
“কেন আপনার কাছে টাকা নাই ।
” থাকবেনা কেন! আপনারতো অগাধ মানবতা, আমি একদম শিহরিত আপনার মানবতা দেখে।যেহেতু নিজে থেকেই রিকশা ডেকেছেন, তাই ভাড়াটাও দিয়ে দিন মাফি।
“আচ্ছা দিলাম,এখন যান।এই মাফি মাফি করা থেকে আমাকে মুক্তি দিন।
তাকিয়া রিকশায় চড়ে বসলো।বৃষ্টি যেন খুব কম সময়ের মধ্যেই জমীন ছুবে।সে রিকশার উপরের পার্ট টেনে দিলো।রিকশা চালক সামনে নীল পলিথিন দিতে চাইলেন তাকিয়া বারণ করলো।সে পশ্চাতপানে ঘুরেও তাকালোনা।ভূলোকে বৃষ্টি আসার আগ মূহুর্তে বালুরা সানন্দে ঘুরে বেড়াচ্ছে,সুযোগ বুঝে মানুষের চোখে ঢুকে পড়ছে।এটা অবশ্য বিরক্ত কর।তাকিয়া হাত দিয়ে তার চোখ চেপে ধরলো।চোখদের শুধু শুধু যন্ত্রণা দেয়ার কোনো মানেই হয়না।সে চুপ করে মাফির কথা চিন্তা করছে।সে কেন এমন করলো আমার সাথে।চিনেও না চিনার ভান করলো। গন্ডার, জলহস্তী, বাঘ,শিয়াল,মহিষ,জগ, মগ,বালতি,আরো অনেককিছু সে।সময় একদিন আমারো আসবে। তখন দেখা যাবে কত ধানে কত চাল।তাকিয়াকে বিড়বিড় করতে দেখে রিকশাচালক বলে উঠলেন।
” আমারে কিছু কইলেন আফা?
“না আপনাকে কিছু বলিনি। আপনি এগিয়ে যান।
রিকশা চালক তাকিয়ার কথা অনুযায়ী কালো পিচের রাস্তার উপর দিয়ে চলতে থাকলো।
সাদাত সেখানেরই এক দোকানে যেয়ে বসে আছে।এখন বাসায় যাওয়া যাবেনা। গেলেই তাকিয়ার বিষয়টি দৃষ্টিগোচর হবে।মা যেহেতু চাচ্ছে তাকিয়ার সাথে এখন যোগাযোগ না করি।সেটাই আমি করবো।সাদাত মনে মনে কথা বলছে। আমার সাথে আজ যেভাবে কথা বললে এভাবে তোমার পরিবারের সাথে বললেই তো হয়। তাহলে তারা তোমাকে এতোটা কষ্ট দেয়ার সাহস দেখাতে পারতোনা ।জানোইতো মানুষ দুর্বল দেখলে আরো পেয়ে বসে।এ জন্য মাঝেমাঝে শত্রুদের সামনে শক্ত থাকাটা অন্যায় কিছু নয়। সাপকেই লক্ষ করোনা?সাপের মুখে বিষ থাকুক অথবা না থাকুক মানুষ তাকে দেখলে ভয় পায়।কারন সে কখনো তার দুর্বল দিক কাওকে দেখায় না।জানিনা তুমি কবে একটু নিজেকে নিয়ে ভাববে।সাদাতের মুখ থেকে সহসাই বের হয়ে এলো পাগলী একটা, সে তার ঠোটের কোনে মিষ্টি হাসির রেখা টেনে দিলো।আপাতত সে বৃষ্টি কমার অপেক্ষা করছে।
_____
তাকিয়া রুমে বসে বসে বই পড়ছে, কিছুক্ষণ পরেই আছরের আজান দিবে।তাকিয়ার দৃষ্টি বইয়ের দিকে থাকলেও তার দৃশ্যপটে বিরাজ করছে মাফির সাথে ঘটে যাওয়া কর্মকাণ্ড।তার ললাটে ঘামের সরু রেখারও উপস্থিতি দেখা যাচ্ছে।লজ্জায় কিছুক্ষণ বাদে বাদেই শির নত হয়ে যাচ্ছে।আচানক রাফিয়া তার রুমে প্রবেশ করলো।তাকিয়ার মনে একপ্রকার ভীতি সঞ্চয় হলো।তবুও সে নিজেকে স্বাভাবিক রাখলো।রাফিয়া এসেই তাকে জড়িয়ে ধরলো।সাধারণত রাফিয়া এমন করেনা।সে তাকিয়ার থেকে যথাসম্ভব দুরুত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করে।কিছুতো একটা হয়েছে যার দরুন রাফিয়ার এই আচরণ। তাকিয়া কিঞ্চিত অবাক হলো।না না একদমই কিঞ্চিত বলা যাবেনা।বরঞ্চ সে বিস্ময়ের শেষ সীমানায় গিয়ে দাড়ালো।তাকিয়াকে আরো অবাক করে দিয়ে রাফিয়া বললো।
“কিরে কি করছিলি?
” তাকিয়া নিশ্চুপ।
“আচ্ছা থাক তুই কিছু বলবিনা।শোন আমি তোর কাছে একটা আবদার করতে এসেছি।
” সে তার বিমাতা কন্যার মার্জিত ব্যবহারের কারন কিছুটা আঁচ করতে পারলো।সে জিজ্ঞাসু নেত্রে রাফিয়ার দিকে তাকালো।
“তুই আমাকে একটা সাহায্য করতে পারবি?
” কি বিষয়ে?
“তুই তো সুন্দর করে পাস্তা রান্না করতে পারিস।আমাকে রেধে দিবি?
” হুঁ দিবো, কিন্তু কেন বলো তো। তুমি তো পাস্তা পছন্দ করো না।
“আমার বন্ধু খুব পছন্দ করে। তাকে দিতে চাই।
” ওহ আচ্ছা। কখন লাগবে?
“এখনি দে।আমি বিকেলে ওদের বাসায় যাবো।
তাকিয়া বাধ্য মেয়ের মত রসুইঘরের দিকে পা বাড়ালো।কোনো প্রকার প্রশ্ন করে রাফিয়াকে বিরক্ত করলোনা।কিছুক্ষণ পর কলিংবেলের ধ্বনি কর্ণকুহরে ভেসে আসলো।রাফিয়া যেয়ে কপাট খুলে দিলো।আনিধা এসেছে।সে ঘরে ঢুকলোনা।বাহিরে দাঁড়িয়েই বললো।
” কিরে তোর রান্না কতদুর।সন্ধার পর কিন্তু ভাইয়া বেরিয়ে যাবে?
“আরে রান্না করে ফেলেছি।তুই একটু বস আমি তৈরি হয়ে আসছি।
” তুই করেছিস?
“হুঁ আর কে করবে?
“রাফিয়া পাস্তাগুলো একটি বক্সে ভরলো।আনিধাকে সে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করালোনা।
দুজনই বাটি নিয়ে উপরের তলায় চলে গেলো।
বর্তমানে বাসায় তাকিয়া একাই অবস্থান করছে।রেবেকা গ্রামে গিয়েছে। সে নামাযে দণ্ডায়মান হলো।সহসা কলিংবেল বেজে উঠলো। ভিতর থেকে কোনো সাড়া পাওয়া গেলোনা।না পাওয়াটাই স্বাভাবিক। কারন তাকিয়া নামাজ পড়ছে।তাকিয়া নামাজ শেষ করে দরজা খুললো।সে কাওকেই দেখতে পেলোনা।ফিরে আসলো।কিছুক্ষণ পর আবারো কলিংবেল বাজলো।
তাকিয়া ত্বরায় দরজা খুললো।বাহিরে দারোয়ানের মেয়ে দাড়িয়ে আছে।তাকিয়া তাকে দেখে মুচকি হেসে ঘরে আসার জন্য আহবান জানালো।
” সে দুই দিকে মাথা নাড়ালো।অর্থাৎ সে আসতে পারবেনা।সে কিছুটা কঠিন গলায় বললো।তুমি তখন দরজা খুলোনি কেন?
“নামাজ পড়ছিলাম রে।
” সে একটি চিরকুট বের করে তাকিয়ার হাতে দিলো।এটা তোমার জন্য।
“তাকিয়া কপালে ভাজ ফেললো।সে ভালোমত চিরকুটটি পর্যবেক্ষণ করে বললো।কে দিয়েছে এটা?
” একটা ভাইয়া, নাম বলতে নিষেধ করেছে।
“সে নিষেধ করেছে আর অমনি তুইও তার কথা মেনে নিলি।
” মেনে নিয়েছি কারন সে আমাকে অনেকগুলো মজা আর খেলনা কিনে দিয়েছে তাই।
“আচ্ছা বুঝতে পেরেছি।এখন ভিতরে আসবি নাকি বাহিরে দাড়িয়ে কথা বলবি?
“ভিতরে আসবোনা।বাবাকে বলে আসিনি।আমি এখন যাই?
” তাকিয়া মুচকি হেসে তাকে বিদায় জানালো
আচ্ছা, সাবধানে সিড়ি থেকে নামিস।
তাকিয়া কপাট ভালোমত লাগালো।সে চিরকুটটি খুললোনা।আগে কিছুক্ষণ কুরআন তেলওয়াত করলো। আসরের নামাজের পর সুরা নাবা পাঠ করা তাকিয়ার দৈনন্দিনের অভ্যাস।মাদ্রাসায় থাকা কালীনই সে এ অভ্যাসকে দৈনন্দিন রুটিনে যুক্ত করেছে।আজও তাই করলো।খুব সুন্দর করে সে কুরআন শরীফ পড়লো।পড়া শেষ করে বুকে জড়িয়ে নিলো।চুম্বন করলো।এখন তৃপ্তি লাগছে।যেদিন সে খুব খুশুখুজুর সহিত নামাজ, কুরআন পড়ে সেদিনই সে এই তৃপ্ততা অনুভব করতে পারে।
এই যে আপনি পড়েনতো? হ্যা সম্মানিত পাঠক আপনাকেই বলছি পড়বেন কিন্তু কেমন?
_______
সাদাতের সামনে তার মা পাস্তা রাখলো।সে খুব মজা করে খাচ্ছে।বরাবরই এটা তার প্রিয় খাবার।
সাদাত খাবারটি খুব মজা করে শেষ করলো। প্রথমত প্রশংসা করলো।প্রশংসা না করে উপায় আছে? তাকিয়ার সব রান্নাই খুব অসাধারণ।মেয়েটার গুনের শেষ নাই। সাদাত তার মাকে জিজ্ঞাসা করলো।তুমি রেধেছো?
“না।
” আচ্ছা তাহলে জানতে চাইনা।
সাদাতা তেমন আগ্রহ দেখালোনা।তাই তার মাও কিছু বললোনা।কিন্তু রাফিয়া হেনাকে জানিয়েছে সে রান্না করেছে।হেনা নিরবতা পালন করলো।কারণ একটি চরম সত্য এখন তার সামনে উদীয়মান।তাই সে এখন রাফিয়ার সাথে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি কথা বলেনা।
_____
তাকিয়া দরজা জানালা বন্ধ করে চিঠি পড়ায় মনোযোগী হলো।
আসসালামু আলাইকুম।আমি জানি তুমি ভালো নেই।তাই আর কেমন আছো জিজ্ঞাসা করলামনা। তবুও তোমার জন্য সু দোয়া করি, আল্লাহ যেন তোমাকে সব সময় ভালো রাখেন।তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে।প্রথমে বলবো,আমি তোমার মত অতো সুন্দর করে লিখতে জানিনা মুখেও বলতে পারিনা।তবুও চেষ্টা করছি।তুমি যেই বাসায় থাকো একি বাসার ৩ তলায় আমিও থাকি।ঢাকা আসার পর আমার বাবা বাড়িটি ক্রয় করেন।এরপর থেকে এটাই হয় আমার আবাসস্থল। জানি অবাক হয়েছো। অবাক হওয়ার কিছু নেই।ঢাকায় আসার পর মাদ্রাসায় আমার নাম পরিবর্তন করে সাদাত রাখা হয়।এরপর থেকেই আমি এই নামে ভুষিত হই। এবার অনুমান করতে পারছো আমি কে?
তাকিয়া স্বীয় ললাটে ভাজ ফেললো। কিছু একটা ভেবে আবারো চিঠিতে মনোনিবেশ করলো।
তুমি এই বাসায় থাকো এটা আমি আগে থেকেই জানি।আমি অনেকবার চেয়েছিলাম তোমার সাথে যোগাযোগ করবো।কিন্তু জোড়ালো কিছু কারনের জন্য আমি সেটা করিনি।তোমাকে দেখলে হয়তো বলবো,চিন্তা করো না,আমি তোমাকে এখান থেকে উদ্ধার করবো।তোমার দাবী করা চাওয়াটি পুরন করবো।কিন্তু সত্যি বলতে এক সময় কথা বলতে বলতে আমরা অনেকটা ঘনিষ্ঠ হয়ে যাবো।যেমন, ফোন নাম্বার আদান-প্রদান করা ইত্যাদি ইত্যাদি।
কিন্তু এতে লাভের বদলে লোকসান বেশি হবে।কারন আল্লাহ কখনো আমাদের কাজে খুশি হবেননা।তুমি নবী করিম সাঃএর হাদীস এর দিকে একটু নজর দেও।সেখানে বলা আছে।
(বেগানা কোন নারীর সাথে (রোমাঞ্চকর)কথা বলা হলো মুখের যিনা।
তার দিকে তাকানো হলো চোখের যিনা।
তার কথা চিন্তা করা অন্তরের যিনা।(নেগেটিভ চিন্তা)খারাপ উদ্দেশ্যে তার দিকে পায়ে হেঁটে যাওয়া হলো পায়ের যিনা।তার কথা কানে শোনা কানের যিনা( রোমাঞ্চকর ফোন আলাপে নিমগ্ন থাকা)অতঃপর লজ্জাস্থান তাকে পূর্ণতা দেয় অথবা অসম্পূর্ণ রেখে দেয়।)
বুখারী শরীফ।
একজন যিনা কারীর শাস্তি সম্পর্কে তোমার তো জানাই আছে।এসব কিছু চিন্তা করেই আমি তোমাকে সেদিন উপেক্ষা করেছি।তোমার কি মনে হয়? আমরা… কেমন আছি…. এই পর্যন্তই ক্ষান্ত থাকতাম?কখনোই না, তখন আমাদের মধ্যে ৩য় জন হত শয়তান।আরেকটি কারনতো রয়েছেই!! তোমার মা।আমি তোমাকে নিয়ে বাসায় আলোচনা করেছি।কয়েক মাস তোমাকে কষ্ট করতে হবে।এরপরেই আমার পড়ালেখার গণ্ডি শেষ।তখন ইন শা আল্লাহ একটা সমাধান করা যাবে।বলতে বলতে অনেক কথাই বলে ফেললাম।সবসময় ভালো থেকো এই কামনাই করি।কারন তোমার ভালো থাকায় আমার প্রশান্তি।
ইতি,, মাফি।