গল্প: তোমায় নিয়ে 21,22,23 শেষ পর্ব

তোমায় নিয়ে

গল্প : তোমায় নিয়ে

পর্ব: (২১+২২)
.
নীরার চেহারা ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। ঈশাম নীরাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবে। কিন্তু নীরা বলল,
– থাক না, হতেই পারে এরকম।
– থাক কিসের? চল। আমি তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাব। উঠ! রেডি হও।
নীরা যাবে না তাও ঈশামের জেদের কাছে হার মানল।
.
মহিলা ডাক্তারের কাছে নীরাকে দেখিয়েছে ঈশাম। ডাক্তার নীরাকে চেকআপ করল।
– মি: ঈশাম! গুড নিউজ। আপনি সন্তানের বাবা হতে চলেছেন। ভয়ের কারন নেই। প্রেগনেনসির সময় এরকম অসুস্থতা হয়ই।
কথাটা বাংলা সিনেমার ডায়লগের মত শুনালেও এই ডায়লগ না শুনলে যেন মনেই হয় না তারা সন্তানের পিতা মাতা হতে চলছে। আধুরাই থেকে যায়।
ডাক্তারের মুখে এই কথা শুনার পর হবু বাবা মায়ের কি অনুভূতি হয় সেটি কেবল তারাই জানে যারা সন্তানের মা বাবা হয়েছে। ঈশাম ডাক্তারের কথা শুনা মাত্রই বলে উঠল,
– আলহামদুলিল্লাহ। ঈশামের সেই কি হাসি।
নীরার দিকে তাকিয়ে দেখল নীরার চোখ ছলছল করছে। নীরা সাথে সাথে তার পেটে হাত দিয়ে অনুভব করতে লাগল, আসলেই কি নীরা কনসিভ করেছে, আসলেই কি তার শরিরের ভিতর একটা প্রান আছে।
নীরার আনন্দ যেন আর ধরে না।
ঈশাম ওইযে ডাক্তারের চেম্বার থেকে নীরার হাত ধরেছে আর ছাড়ে না। পৃথিবীর মধ্যে আর কে সুখি? ঈশামের মন চাচ্ছে জোরে করে একটা চিতকার দিয়ে বলি,
আমি বাবা হতে চলেছি।
.
ঈশাম নীরাকে নিয়ে বাসায় ঢুকল সাথে মিষ্টির প্যাকেট।
– কিরে ঈশাম হঠাত মিষ্টি আনলি?
– তোমরা কি নাতি নাতনী কে দেখতে চাও না নাকি?
ঈশামের কথা শুনে বুঝতে বাকি রইল না যে নীরা মা হতে চলেছে।
নীরার শাশুড়ি তো দৌড়ে গিয়ে শশুড় কে খবর দিল।
একটা সন্তান পৃথিবীতে আসার আগে তার হবু মা বাবার কি যে আনন্দ তা যদি কোনো কিছুতে বুঝানো যেত?
সেই বাধ ভাঙা খুশির জোয়ারে ভাসছে ঈশাম আর নীরা।
ঘরের দরজা বন্ধ করেই ঈশাম নীরাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
নীরা ঈশামের বুকে মুখ গুজে দিয়ে চোখের পানি ছেড়ে দিল।
নাহ! আজ ঈশাম নীরার কান্না থামাবে না। কারন আজ ঈশামও কাদবে । এই কান্না দুখের না।
আচ্ছা! ছেলে মানুষ তো খুব কষ্ট না পেলে সহজে কান্না করে না। তাহলে সন্তান পৃথিবীতে আসবে শুধু এই খুশিতেই কি চোখে পানি আসবে?
কি অদ্ভুত?
আল্লাহ সুবাহানু ওয়া তা’য়ালা সন্তানদের জন্য পৃথিবীতে এই মানুষ রূপি এঞ্জেল সৃষ্টি করেছেন।
.
নীরার জন্য ঈশাম এক্সট্রা কেয়ার নিতে শুরু করল। খাবার দাবারে, দৈনন্দিন রুটিনে ঈশাম পরিবর্তন আনল। নীরার প্রথম কয়েকমাস ঈশাম এক্সট্রা যত্ন নিবে। কারন খুবই সেনসিটিভ সময়।
নীরা মন খারাপ করে বসে আছে। কারন শরীর তার ভাল নেই। বমি, ক্লান্তি, অবসাদ, ক্ষুধামন্দা সব যেন জেকে বসেছে। কিছুই ভাল লাগছে না। ঈশাম নীরার কাছে এসে বসল। নীরার মাথা ঈশাম তার বুকের উপর রেখে নীরার চুল বুলাতে বুলাতে বলল,
” হযরত আনাস ( রা) হতে বর্নিত, রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন- তোমাদের কেউ কি এতে খুশি নয় যে, সে যখন স্বামী কর্তৃক গর্ভবতী হয় এবং স্বামী তার প্রতি সন্তুষ্টও থাকে তখন ( এই গর্ভকালীন) সে আল্লাহর পথে সর্বদা রোজা পালনকারী ও সারারাত নফল ইবাদাতকারীর মত সাওয়াব পাবে? তার যখন প্রসব বেদনা শুরু হয় তখন তার জন্য নয়ন শীতলকারী কি কি নিয়ামত লুকিয়ে রাখা হয়, তা আসমান জমিনের কোনো অধিবাসীই জানে না। সে যখন সন্তান প্রসব করে তখন তার দুধের প্রতিটি ফোটার পরিবর্তে একটি করে নেকি দেওয়া হয়। এ সন্তান যদি কোনো রাতে তাকে জাগিয়ে রাখে ( অসুখ ইত্যাদি কারনে বিরক্ত করে মাকে ঘুমাতে না দেয়) তাহলে সে আল্লাহর পথে নিখুত সত্তরটি গোলাম আযাদ করার সাওয়াব পারে। ( আলমু’ জাম, তাবরানী: ৬৯০৮, আবু, নুঅাইম: ৭০৮৯)।
.
নীরা ঈশামের দিকে তাকাল।
তুমি কি আরও সুসংবাদ শুনবে?
– হুম।
– হযরত ইবনে ওমর ( রা) হতে বর্ণিত, নবী কারীম ( সা) বলেছেন, মহিলাদের গর্ভধারণ থেকে নিয়ে সন্তান প্রসব পর্যন্ত তাদের এতই সাওয়াব হয় যেরূপ সাওয়াব হয় আল্লাহর রাস্তায় সীমান্ত পাহারা দিলে। এর মাঝখানে মৃত্যুবরন করলে ( অর্থ্যাত গর্ভ ও ভূমিষ্ঠ এর মাঝখানে মারা গেলে) সে শহীদের মর্যাদা পাবে। ( মাজমা’ -৪/ ৩০৮)।
.
– সুবহানাল্লাহ!
– কি নীরা? দেখেছ? কত মর্যাদা একজন গর্ভবতী মায়ের। পুরুষেরা কি এই মর্যাদা পাবে?
– না কখনই না।
– তাহলে দেখ তো কত বড় একটা অনুগ্রহ আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার পক্ষ থেকে।
– নীরা ঈশামকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
– কিছু খাবে নীরা?
– ভাল লাগছে না।
– ঈশাম নীরার কোনো কথা না শুনে খাবার নিয়ে এসে জোর করে খাইয়ে দিল।
– মহিলাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ মহিলা কারা জান?
– নাতো!
– হযরত মা’কাল ইয়াসার ( রা) থেকে বর্ণিত, নবী কারীম ( সা) বলেছেন- মহিলাদের মধ্যে সেই মহিলা শ্রেষ্ঠ যে অধিক ভালবাসতে পারে এবং অধিক সন্তান জন্ম দেয়। ( জামেছগীর, বায়হাকী- ৭/৮২)।
– কি শ্রেষ্ঠ হতে চাও না?
– ইনশাআল্লাহ।
.
একটা সন্তান জন্ম দিতে একটা মা যে কত কষ্ট স্বীকার করে, তা সেই মা জানে যিনি সন্তান জন্ম দিয়েছেন। ভ্রুন অবস্থা থেকেই শুরু হয় অবর্ণনীয় কষ্ট।
ঈশাম খুব কাছ থেকে নীরাকে দেখছে। তারই সন্তান জন্ম দিতে নীরা আজ এত কষ্ট করছে । তাই তার প্রতি সহানুভূতি, প্রেম, ভালবাসা, স্নেহ, মায়া, মমতা, যত্ন, মানসিক সাপোর্ট খুবই দরকার। নীরার কষ্ট দেখে ঈশাম মনে মনে ভাবছে,
আমার মা আমাকে যখন পেটে রেখেছিল, তখন আমার মাও অনেক কষ্ট করেছে।
ঈশাম যেন খুব ফিল করছে। কি কষ্টই না করেছে ঈশামের মা। প্রায় সব মাই কষ্ট করেছে। ঈশাম যেন খুব করে অনুভব করছে। ভাবতে ভাবতে ঈশামের চোখে পানি এসে পরেছে কখন তা সে খেয়ালি করে নি।
.
– নীরা তুমি কি জান মায়ের গর্ভে যখন ভ্রুন থাকে তখন থেকে আল্লাহ ও ফেরেশতাদের মধ্যে কি কথা হয়?
– নাতো! হযরত আনাস ইবনে মালেক ( রা) নবী কারীম ( সা) থেকে বর্ননা করেন, তিনি ইরশাদ করেছেন, আল্লাহ তা’য়ালা প্রত্যেক মায়ের রেহেমে ( গর্ভাশয়ে) একজন ফেরেশতা নিযুক্ত রেখেছেন। মায়ের গর্ভাশয়ে যখন কোন বীর্য ঢুকে তখন উক্ত ফেরেশতা আল্লাহর কাছে আরজ করেন,
হে আল্লাহ! বীর্য কি করা হবে?
যদি আদেশ হয় সম্মুখে পরিচালনা কর, তখন গর্ভাশয়ের মুখ বন্ধ করে দেয়া হয়। তারপর যতদিন বীর্য হিসেবে থাকার নির্দেশ দেন তা বীর্য থেকে যায়। তারপর আস্তে আস্তে যখন তা জমাট রক্তে রূপান্তরিত হয়, তখন ফেরেশতা আবার বলেন,
হে আল্লাহ! এখন তা জমাট রক্তে রূপান্তরিত হয়েছে।
তারপর আদেশ হলে তাকে গোশতের টুকরায় রূপান্তরিত করা হয়।
তখন উক্ত ফেরেশতা পুনরায় বলেন,
ইয়া রব! এখন তা গোশতের টুকরায় রূপান্তরিত হয়েছে। অতপর মহান আল্লাহ তার সৃষ্টি কৌশল পূর্নতে রূপ দেওয়ার ইচ্ছে করলে ফেরেশতাকে তা পরিচালনা করার নির্দেশ দেন।
তখন ফেরেশতা আবার আরজ করেন,
হে প্রভু! এখন তো তা পূর্নতা লাভ করেছে, তাতে রূহ দেওয়ার সময় হয়েছে। এখন তা কি পুরুষ হবে না মহিলা?
তারপর এও যখন সমাপ্ত হয়, তখন ফেরেশতা পুনরায় আরজ করেন,
হে বারী তা’য়ালা! এখন তা বদকার হবে না – নেককার হবে?
এর আদেশ হলে পুনরায় প্রশ্ন করেন,
এর রিযিক কি হবে?
এও আদেশ হলে পুনরায় আরজ করেন,
এখন হায়াত কত দিন হবে?
এরও আদেশ হলে ফেরেশতা তার পরিচর্যা করতে থাকেন।
রাসূলুল্লাহ ( সা) ইরশাদ করেন, এসব কিছু মায়ের উদরে থাকা অবস্থায়ই নির্ধারিত হয়। ( বুখারি- ৩১২)
.
– নীরা এটা আমার আর তোমার প্রথম সন্তান আল্লাহর তরফ থেকে। আমি চাই তুমি তোমার অনাগত সন্তানের জন্য বেশি বেশি দোয়া করবে ।
– জি ইনশাআল্লাহ।
– আমি আরও কিছু পরামর্শ দিচ্ছি তুমি মনে রাখিও এবং সে অনুযায়ি আমল করবে।
– জি বল। আমি অবশ্যই আল্লাহ চাইলে মানতে চেষ্টা করব।
– ঈশাম বলতে লাগল,
তুমি সবসময় চেষ্টা করবে গোনাহ থেকে বিরত থাকবে।
পর্দা করে চলবে।
ধৈর্য্য ধারন করবে, অসুস্থতা, বমি বমি ভাব, দুর্বলতা ইত্যাদি কারনে ধৈর্য্য হারা হয়ে পরবে না। কারন এই সময়টা তোমাদের জন্য জিহাদ তুল্য ইবাদাত।
সময় মত নামাজ আদায় করবে।
যিকির করতে থাকবে। কারন যিকির দ্বারাই মন শান্ত হয়।
আল্লাহ তা’য়ালা বলেন,
যারা ঈমাম আনে এবং আল্লাহর স্মরনে যাদের মন প্রশান্ত হয়, জেনে রাখ আল্লাহর স্মরনেই মন প্রশান্ত হয়। ( সূরা রাদ- ২৮)।
শোকর আদায় করবে। আল্লাহর সব ডিসিশনের উপর কৃতজ্ঞ থাকবে।
তিনিই উত্তম পরিকল্পনাকারী।
অকৃতজ্ঞ হবে না। আল্লাহ বলেন,
” আমার কৃতজ্ঞতা প্রকাশ কর, অকৃতজ্ঞ হয়ো না। “( সূরা বাকারাহ- ১৫২)।
সর্বদা ওযু অবস্থায় থাকার চেষ্টা করবে।
সন্তানের জন্য কোরঅান তেলওয়াত করবে। তুমি যেমন কোরঅান তেলওয়াত করবে ঠিক তেমনি তোমার গর্ভের সন্তানের মাঝেও সেটি পরিলক্ষিত হবে।
সবসময় সন্তানের জন্য দোয়া করবে । আল্লাহ বলেন,
বলো তো কে নি: সহায়ের ডাকে সাড়া দেন যখন সে ডাকে এবং কষ্ট দূরীভূত করেন। ( সূরা নামল- ৬২)।
.
নীরা ঈশামের কথা খুব মনযোগ দিয়ে শুনছে।
গর্ভাবস্থায় স্বামী যদি স্ত্রী কে মানসিক সাপোর্ট করে তাহলে সেই নারী চরম ভাগ্যবতী। কারন এই সময় টাতে একটা মেয়ে খুবই অসহায় বোধ করে। তার দরকার একটু সাপোর্ট এর। ঈশাম সেই চেষ্টাই করে যাচ্ছে। নীরাকে কখনও মনমরা থাকতে দেয় না। হাসিখুশি রাখতে যা করার করে। কারন মা যদি ভাল এবং সুস্থ থাকে তাহলে বেবীও ভাল থাকবে।
ঈশাম তার সাধ্য অনুযায়ী এবং সাধ্যের বাইরেও চেষ্টা করে নীরার জন্য পুষ্টিকর খাবার খাওয়াতে। নিয়মিত চেক অাপ করায়।
স্বামী হিসেবে একজন গর্ভবতী নারীর প্রতি যা যা দায়িত্ব তা নিষ্ঠার সাথে পালন করে যাচ্ছে ঈশাম।
নীরা এবং নীরার ভিতর আরেকটা প্রান!
শুধু ২ জন না। ৩ জনের অস্তিত্ব।
.
নীরাকে তার বাবা মা নিতে এসেছিল।
নীরার সন্তান যতদিন না হচ্ছে নীরার মা চেয়েছিল নীরাকে তাদের কাছে রাখতে। কিন্তু নীরার শাশুড়ি যেতে দেয় নি।
.
নীরার শাশুড়ির কথা,
আমি ঈশামের মা! নীরারও মা! নীরার যত্নের কোনো ত্রুটি হবে না। আপনি যেমন নীরার যত্ন নিবেন ঠিক তেমনি আমি মা আমিও সেইরকম যত্ন নিব। নীরার যত্নের জন্য আপনারা চিন্তা করবেন না। আমার মেয়ের যত্ন আমিই করব।
নীরার শাশুড়ির কথা শুনে নীরার মায়ের চোখের পানি টপটপ করে পড়ছিল। এমন ও শাশুড়ি হতে পারে?
তারপরও নীরার মা বলল,
কিছুদিনের জন্য নিয়ে যাব।
নীরার শাশুড়ি সম্মতি দিল।
সাথে ঈশামও গেল। কারন নীরাকে ছেড়ে থাকা ঈশামের জন্য ইম্পসিবল।
নীরা বলল,
চল! চল! কয়েকদিনের জন্য ঘরজামাই থাকতে!
এই বলে নীরা তো হেসে কুটি কুটি।
.
দিন যায়, নীরার শরিরের পরিবর্তন ঘটতে থাকে। নীরার মনে হতে থাকে যেন তার পেটে ১৫ কেজি পাথর বেধে রেখেছে। নড়তে পারে না, বসতে পারে না, ঠিক মত শুতেও পারে না। কিন্তু এত কিছুর পরও একটাই আকাক্ষা! কবে তার কোল জুড়ে আসবে তার সন্তান!
.
নীরার পেটের ভিতর বেবীটা খুব নড়ছে। নীরার এই সময়টায় অনেক কষ্ট হয়। কিন্তু ঈশামের পরশ নীরার সব কষ্টই যেন নি:শেষ হয়ে যায়।
– এই যে পিচ্চি! মাকে এত কষ্ট দাও কেন? এত লাফালাফি কেন হুম?
ঈশাম মাঝে মাঝেই নীরার পেটে হাত রেখে পিচ্চির সাথে কথা বলে।
জন্ম নেওয়ার আগেই এই অবস্থা, জন্ম নেওয়ার পর এই বাবা সন্তানের যে কি হবে তা ভেবেই নীরার হাসি পাচ্ছিল।
.
নীরা পানি খেতে যাবে। নীরার শাশুড়ির ঘরের দিকে তাকাতেই নীরা দেখল,
ঈশাম তার মায়ের কোলে মাথা রেখে শুয়ে আছে। আর মা ছেলের মাথা বুলিয়ে দিচ্ছেন।
ঈশাম আগের থেকে অনেক যত্ন নিতে শুরু করেছে মা বাবার। কারন নীরার প্রেগনেন্সির এই সময়টাতে ঈশাম বুঝতে পেরেছে একটা মা তার সন্তানকে জন্ম দিতে কত কষ্ট স্বীকার করে।
নীরার চোখ বেয়ে পানি পরতে লাগল।
এমনি বুঝি হয় মা সন্তানের সম্পক।
.
নীরার হঠাত চিতকারে ঈশাম দৌড়ে আসল।
দেখল নীরা মেঝেতে পরে আছে।
.
( চলবে ইনশাআল্লাহ)
গল্প: #তোমায়_নিয়ে
পর্ব: ২২
.
– নীরা! নীরা!!!! কি হইছে?
নীরার শাশুড়ি দেখল নীরার অবস্থা ভাল না। পেইন উঠেছে।
নীরা ব্যাথা সহ্য করতে না পেরে মেঝেতেই বসে পড়েছে।
এদিকে ঈশাম অস্থির কি করবে বুঝে উঠতে পারছে না।
নীরা এদিকে ব্যাথায় চিতকার করছে। ঈশামের হাত ধরে নীরা বলছে,
আমি মনে হয় মরেই যাব! আমি সহ্য করতে পারছি না! কিন্ত প্লিজ ঈশাম আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যেও না। আমি সিজার করতে চাই না। যত কষ্টই হউক না কেন আমি নরমালে আমার সন্তান জন্ম দিতে চাই। প্লিজ আমাকে এই সাওয়াব থেকে বঞ্চিত কর না!
নীরার কথা শুনে ঈশাম দ্বিধায় পড়ে গেল। এদিকে নীরার ব্যাথা বেড়েই চলছে।
নীরা আল্লাহ কে ডাক। আল্লাহ তোমার ব্যাথা কমিয়ে দিবেন ইংশা আল্লাহ!
– মা! নীরা তো হাসপাতালে যেতে চাচ্ছে না। কিন্তু আমি এভাবে ফেলে রাখতে চাই না। আমি ওকে হাসপাতালে নিয়ে যাব।
নীরার বারন সত্তেও ঈশাম নীরাকে হাসপাতালে নিয়ে গেল।
ডাক্তার কে বলল, নরমালে নীরা ট্রাই করবে।
কিন্তু ডাক্তার বলল, যদি খারাপ কন্ডিশন হয়ে যায় তাহলে সিজার করবে ।
.
পৃথিবীর পুরুষেরা যদি স্ত্রীর সন্তান প্রসবের সময় পাশে থেকে অবজার্ব করে কি পরিমান কষ্ট সহ্য করে মায়েরা সন্তান প্রসব করে তাহলে এই পুরুষেরা কখনও তাদের স্ত্রীদের অবহেলা করবে না।
মৃত্যুকে হাতে নিয়ে একেকটা মা তার সন্তান জন্ম দেয়। কি অবর্ণনীয় সীমাহীন কষ্ট! পুরুষেরা যদি চেয়ে দেখে তাহলে কখনও তার মাকে কষ্ট দিবে না, কখনও তার স্ত্রী কে কষ্ট দিবে না। একজন মানুষ কত ব্যাথা সহ্য করার ক্ষমতা রাখে? তার থেকেও বেশি ব্যাথা সহ্য করতে হয় এই মায়েদের! হে পুরুষ সমাজ? একজন গর্ভবতী মায়ের কাছে গিয়ে দেখ! সন্তান প্রসবের সময় তার কি চিতকার! হয় সে মারা যাবে না হয় আল্লাহ বাঁচিয়ে দিবেন। এই পরিস্থিতি তে একজন মা সন্তান জন্ম দেন। আর সেই স্ত্রী কে অবহেলা করতে মনে কি একটুও দ্বিধা হয় না? কিভাবে একজন স্ত্রীর গায়ে হাত তুলো? স্ত্রীর হক আদায় কর না?
মা কি তোমাকে জন্ম দেয় নি? কেন মায়ের জায়গা হয় না তোমার বাড়িতে?
মায়ের জরায়ু ফেটে চিরে তুমি বের হইছ! বিছানার চাদর রক্তে ভেসে গেছে! সেই রক্তে ভেসে যাওয়া বিছানায় তোমাকে প্রথম কোলে নিয়ে তোমার ওই দুটি গালে চুমু দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে।
আর সেই মায়ের এক থালা ভাত তোমার কাছে হয় না? কত টাকা কত সম্পদ তুমি অর্জন কর! কিন্তু মায়ের এক প্লেট ভাতের টাকা তোমার কাছে পাহাড় সরানোর মত কঠিন!
.
জীবনে যদি কোনো স্বামী তার স্ত্রীর সন্তান জন্মের সময় পাশে থাকে তাহলে সেই স্বামী আর কখনই নারী জাতিকে অসম্মান করবে না, তুচ্ছ ভাববে না। সন্তান জন্ম দেওয়ার ব্যাথা শুধু সেই মাই জানে যিনি জন্ম দিয়েছে। আমরা শুধু সহানুভূতিই দেখাতে পারব! কিন্তু হায় এই সহানুভূতিই কয় জনই বা দেখায়?
.
২ দিন ধরে নীরার ব্যাথা! ট্রাই করছে খুব করে যাতে নরমালে হয়। ঈশাম আর সহ্য করতে না পেরে বলল,
– নীরা প্লিজ! তোমার কষ্ট আমার আর সহ্য হচ্ছে না। দুই দিন তো ট্রাই করছ!
নীরার মাথার ঘামে যেন বালিশ ভিজে যাবে।
ঈশামের হাত শক্ত করে ধরে বলল,
না ঈশাম! আল্লাহ চাইলে নরমালেই হবে!
নীরা যেন আরো শক্ত করে ঈশামের হাত চেপে ধরল।
– ঈশাম! আমি মনে হয় মারা যাচ্ছি!
ঈশাম নীরার কথায় কোনো উত্তর দিতে পারল না।
নীরার শাশুড়ি ঈশামকে বাহিরে যেতে বলল।
কিছুক্ষন পরেই ইংশা আল্লাহ সন্তান হবে।
.
আরও প্রায় আধা ঘন্টা সময় পর প্রত্যেক মায়ের মত ৫৭+ ইউনিট ব্যাথা ২০ টা হাড্ডি একসাথে ভেঙে যাওয়ার ব্যাথা সহ্য করে নীরা তার সন্তানকে জন্ম দিল।
নীরার শাশুড়ি ঈশামকে ডাক দিল।
ঈশাম দৌড়ে এসে সন্তানকে দেখেই আল্লাহর সুমধুর আযান দিতে লাগল।
কন্যা সন্তান হয়েছে। ঈশাম আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! আলহামদুলিল্লাহ! বলে অশ্রু সিক্ত চোখে কন্যা সন্তানকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে নিল।
এক হাতে সন্তানকে নিল আর এক হাতে নীরার মাথায় হাত বুলিয়ে জিজ্ঞাসা করল,
– নীরা?
নীরা ঈশামের দিকে তাকিয়েই বলল,
– আলহামদুলিল্লাহ আমি ভাল আছি। দেখ! তোমার জন্য আমার তরফ থেকে একটা গিফট! ইওর প্রিন্সেস!
– ঈশাম নীরার ঘামার্ত কপালে একটা চুমু একে দিল।
– আল্লাহ তোমাকে উত্তম প্রতিদান দান করুন।
.
একজন মা যখন একটি সন্তান জন্ম দেয় তখন সেই সন্তানকে নিয়েই সবাই ব্যস্ত হয়ে যায়। কিন্তু মায়ের দিকে খেয়াল থাকে না। সন্তান জন্ম দেওয়ার পর যে মাকে আরও বেশি কেয়ার করতে হয় সেটা যেন বেমালুম সবাই ভুলে যায়।
কিন্তু ঈশাম তা করে নি।
নীরার পরিচর্যা ঈশাম নিজের কাধেই নিয়েছে। কারন নীরা এখন আর ঈশামের স্ত্রী না, একটি সন্তানের মা। ডাবল কেয়ার প্রয়োজন।
.
ঈশাম তার মেয়ের নাম রেখেছে জান্নাত।
” আমার জান্নাত মামুনি!” “আমার লিটেল ডল! “
” আমার কিংডমের প্রিন্সেস “
” আমার ছোট সোনা”
কত নামে কত ঢং এ যে বাপ বেটিকে ডাকে তার ইয়াত্তা নেই।
.
নীরা বলল,
ছেলে হলে নাকি বংশের বাতি হয়। এজন্য ছেলে হলে মানুষ খুশি হয়। আর তুমি আর তোমার ফ্যামিলি দেখছি উল্টা।
ঈশাম বলল,
নীরা! এত লেখাপড়া করে এই শিখেছ?
– কেন?
– মানলাম গ্রামে বা আধুনিক এই যুগেও মানুষ মূর্খতার বশে ছেলে হলে বেশি খুশি আর মেয়ে হলে মুখ বেজার, এইটা করে। কিন্তু তুমি এই কথা বলবে আশা করা যায় না।
– না আসলে জিজ্ঞাসা করলাম। আমার ফ্রেন্ড এর মেয়ে সন্তান হয়েছে বলে তাকে নানা রকম কথা শুনতে হয়। ছেলে হয় নি কেন সেইটা দোষ। মেয়ে হয়েছে তাতে তারা খুশি না। তারা বংশের বাতি ছেলে চেয়েছিল। এই হ্যানত্যান। কিন্তু তার জন্য খুব কষ্ট হয়। বেচারির তো কোনো দোষ নাই। আল্লাহ দিয়েছেন তাতে অসন্তুষ্টর কি আছে?
– তুমি ঠিকই বলেছ। আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট থাকা উচিত। আর ছেলে হউক আর মেয়ে সবই আল্লাহর ইচ্ছায়। যাকে খুশি আল্লাহ ছেলে দিবেন আর যাকে খুশি মেয়ে দিবেন।
পবিত্র কুরঅানে মহান আল্লাহ বলেন- আর যখন তাদের কাউকে কন্যা সন্তানের সুসংবাদ দেওয়া হয় তখন তাদের চেহারা কালো হয়ে যায়। আর সে থাকে দু: খ ভারাক্রান্ত। তাকে যে সংবাদ দেওয়া হয়েছে, সে দু: খে সে কওমের থেকে আত্নগোপন করে। আপমান সত্তেও কি একে রেখে দেবে, না মাটিতে পুতে ফেলবে? জেনে রাখ, তারা যে ফয়সালা করে, তা কতই না মন্দ?! সুরা আন নাহল- ৫৮-৫৯
.
এটা তো আইয়ামে জাহেলিয়াত এর কথা। সে সময়ের কথা যখন কন্যা সন্তানদের জীবন্ত কবর দেওয়া হত। কিন্তু বর্তমানে? তার থেকে কমই বা কি হচ্ছে? যেখানে কন্যা সন্তান হলে বাবা তাদের ছেড়ে যায়, শাশুড়ি বলে ছেলেকে অন্য জায়গায় বিয়ে দিবে, শশুড় বাড়ির মানসিক অত্যাচার, কন্যা সন্তানদের ঠিক মত লালন পালন না করা, তাদের বোঝা মনে করা, আর কত? আরও আছে তা তারাই জানে যারা এরকম অসহায় পরিস্থিতির শিকার।
.
আচ্ছা ছেলে বা মেয়ে এটা কি মানুষ সৃষ্টি করতে পারে? মানুষ তো একটা মাছিও সৃষ্টি করতে পারে না। তাহলে কেন তারা আল্লাহর ফয়সালারর উপর সন্তুষ্ট থাকতে পারে না। আল্লাহ মানুষদের সৃষ্টি করেছেন নারী বা পুরুষ হিসেবে সেখানে কেন একজন মাকে দোষ দেওয়া হয়? তোমার কেন বার বার মেয়ে সন্তান হয়? এটা কেন একজন মাকে প্রশ্ন করা হয়? যেখানে আল্লাহ মানুষকে সৃষ্টি করে। এখানে কারও ক্ষমতা নেই, কারও হাত নেই এক আল্লাহ ছাড়া।
.
কুরঅান বলে- আসমান ও জমীনের রাজত্ব আল্লাহরই। তিনি যা ইচ্ছা সৃষ্টি করেন, যাকে ইচ্ছা কন্যা এবং যাকে ইচ্ছা পুত্র সন্তান দান করেন। অথবা তাদের দান করেন পুত্র ও কন্যা উভয়ই এবং যাকে ইচ্ছা কিছুই দেন না। নিশ্চয় তিনি সর্বজ্ঞ, ক্ষমতাশীল। সুরা আশ শুরা- ৪৯।
.
– নীরা কেন আমি মেয়ে হয়েছে বলে খুশি হব না? যেখানে রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন,
যার গৃহে কন্যা স্নতান জন্মগ্রহণ করল, অত:পর সে ওই কন্যাকে কষ্টও দেয়নি, তার উপর অসন্তুষ্টও হয় নি এবং পুত্র সন্তানকে তার উপর প্রাধান্যও দেয় নি তাহলে ওই কন্যার কারনে আল্লাহ তা’ য়ালা তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবেন । মুসনাদে আহমদ: ১/২২৩
.
আল্লাহ কত সম্মানিত করেছেন একজন কন্যা সন্তানের পিতাকে। একজন কন্যা সন্তান মা বাবার জন্য রহমত, কন্যা সন্তানের জন্য জান্নাতের সুসংবাও রয়েছে। হাদিস কি বলে দেখ-
হযরত মুহাম্মদ ( সা) বলেছেন – যার ঘরে তিনজন কন্যা সন্তান হবে আর সে তাদের লালন পালন করে, তাদের প্রতি মমতা প্রদর্শন করে এবং তাদের ভার বহন করে তাহলে তার জন্য বেহেশত নিশ্চিত। জিগাসা করা হল, হে আল্লাহর রাসূল, যদি দুজন হয়? বললেন, দুজন হলেও। হজরত জাবের (রা) বলেন, কারও কারও ধারনা, যদি বলত একজন হলে? তাহলে নিশ্চয় রাসুল ( সা) বলতেন, একজন হলেও। ( মাজমাউজ জাওয়াইদ- ১৩৪৯০)
.
যেখানে তাদের লালনপালন তাদের ভার বহন করলে জান্নাতের সুসংবাদ দেওয়া হয়েছে সেখানে তারা এই সুযোগ কে বুড়ো অাঙগুল দেখায়। সেইসব পিতার জন্য আফসোস। যারা তাদের স্ত্রীদের শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন করে কন্যা সন্তান জন্ম হওয়ার কারনে। আসলে এটা তাদের জ্ঞানহীনতার অভাব। কুরঅান হাদিসের জ্ঞান না থাকার অভাব। যদি তারা জানত আল্লাহ ও রাসুল ( সা) এর কুরঅান এবং হাদিস সম্পকে তাহলে এরূপ হত না।
.
শিক্ষিত অশিক্ষিত সব পরিবার গুলোতেও মেয়ে হওয়াকে বোঝা মনে করা হয়, হীনতার চোখে দেখা হয়। অনেকে মুখ ফুটে বলতে পারে না কিন্তু মন থেকে মেনে নিতে পারে না।
.
হে কন্যা সন্তানের পিতা! আপনি কি চান না হযরত মুহাম্মদ ( সা) কিয়ামতের দিন আপনার পাশে থাকুক? কত বড় সুযোগ আপনার। কত সম্মান। যা একজন ছেলের পিতাকে দেওয়া হয় নি। মেয়ের পিতাকে দেওয়া হয়েছে। তাহলে শুনুন হাদিসটি-
রাসূল( সা) বলেন, যে ব্যক্তি দুটি কন্যার লালন পালন করল তাদের সাবালিকা হওয়া পর্যন্ত কিয়ামতের দিন আমি ও সে দুটি অাঙগুলের মত পাশাপাশি আসব। ( অত:পর তিনি তার অাঙগুল গুলো মিলিত করে দেখালেন। ( মুসলিম- ২৬৩১, তিরমিজি- ১৯১৪, আহমদ – ১২০৮৯)
.
এরপরও যদি কন্যা সন্তানদের অবজ্ঞার চোখে দেখা হয় তাহলে তাদের মাঝে এবং আইয়ামে জাহিলিয়াত যুগের লোকদের মাঝে পার্থক্য রইল কোথায়?
.
– ওকে ওকে! মহাশয়! এইবার মেয়েকে আমার কোলে একটু দাও! সারাক্ষণ তুমিই নিয়ে থাকবে? বড় হলে তো মেয়ে বলবে যে, মা আমাকে আদর করে নি, সব বাবাই করেছে।
ঈশাম মুচকি হাসি দিয়ে জান্নাতকে নীরার কোলে দেয়।
.
ছোট মিষ্টি পরীকে নিয়ে নীরা ভেবেছিল, আলহামদুলিল্লাহ জীবন এখন পূর্ণ, জীবন তরীতে এখন সুখের ঢেঊ শুধু লাগবে। কিন্তু আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার পরিক্ষা এখনো বাকি রয়ে গেছে তাদের জন্য। সব যেন এলোমেলো হয়ে গেল…..
.
( চলবে ইনশাআল্লাহ)
গল্প : তোমায় নিয়ে
পর্ব: ২৩ ( শেষ পর্ব)
.
জান্নাতের বয়স যখন ঠিক ৬ মাস তখন ঈশামের ব্লাড ক্যান্সার ধরা পড়ে। ডাক্তার যখন ঈশাম আর নীরাকে এ কথা শুনাচ্ছিল তখন ঈশাম বলে উঠল,
– আলহামদুলিল্লাহ আলা কুল্লি হাল।
নীরা ঈশামের দিকে চোখের পানি ফেলে জিজ্ঞাসা করছে,
– ঈশাম তুমি কি শুন নি? ডাক্তার কি বলেছে? সাধারন জর কাশির সংবাদ তোমাকে দেয় নি।
– আমি শুনেছি নীরা। সেজন্যই আমি আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালার প্রসংশা করলাম। কারন আমার জন্য আল্লাহ যেটা কল্যান মনে করেছেন ঠিক সেটাই আমাকে দিয়েছেন।
নীরা আর কোনো কথা বলছে না। অঝর ধারায় চোখের অশ্রু গড়িয়ে পরছে।
– এই নীরু! তুমি কেন এত কান্নাকাটি করছ? তুমি কি আল্লাহর ফয়সালার উপর সন্তুষ্ট নও?
– ঈশাম তুমি কি কিছুই বুঝ না?
– সব বুঝি। আল্লাহ আমাকে তার কাছে তাড়াতাড়িই নিয়ে যাবে। আল্লাহর বান্দাকে আল্লাহ তার কাছে তাড়াতাড়িই নিয়ে যাবে, এর থেকে বড় সৌভাগ্যের আর কি হতে পারে?
– নীরা দৌড়ে এসে ঈশামকে ঝাপটে ধরে শিশুদের মত কান্না শুরু করে দিল।
আমি আল্লাহর কাছে দোয়া করব। আল্লাহ সব কিছু করতে পারে, মৃত কে জীবিত , অসুস্থ কে সুস্থ করতে পারেন, সব করতে তিনি পারেন। আল্লাহ ইংশা আল্লাহ তোমাকেও সুস্থ করে দিবেন। দুনিয়াতে কত মিরাকল হয়! আল্লাহ তোমাকেও সুস্থ করে দিবেন দেখিও।
.
নীরা! ধৈর্য্য ধারন কর তুমি। আমার থেকে তোমাকে বেশি ধৈর্য্য ধরতে হবে।
রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন, মুমিনের ব্যাপারটা আশ্চর্যজনক। তার সমস্ত কাজই কল্যানকর। মুমিন ছাড়া অন্যের ব্যাপার এরূপ নয়। তার জন্য আনন্দের কোন কিছু হলে সে আল্লাহর শোকর করে। তাতে তার মঙ্গল হয়। আবার ক্ষতিকর কোন কিছু হলে সে ধৈর্যধারণ করে। এটাও তার জন্য কল্যানকর হয়। ( মুসলিম)
সুবহানাল্লাহ! দেখ নীরা! আল্লাহ সব জিনিসের ভিতরেই কল্যান লিখে রেখেছেন। শুধু আমাদের দরকার ধৈর্য্য ধারন করা।
– তোমার মত ঈমানের পারদ আমার এত উচু না ঈশাম! তুমি তোমার এই কন্ডিশনেও এত ধৈর্য্য ধরে আছ? তুমি ভাবছ তুমি আল্লাহর কাছে তাড়াতাড়ি চলে যাবা, আর আমার কথা ভেবেছ? তোমার সন্তান? ভেবেছ ঈশাম?
ঈশাম বুঝতে পেরেছে নীরা কি পরিমান ভেঙে পরেছে। নীরা ঈশামকে কতটা ভালবাসে। কিন্তু কি করার আছে আল্লাহর ফয়সালা। এমন এক মরনব্যাধি ঈশামের শরিরে বাসা বেধেছে ধীরে ধীরে ঈশামের শরীর শেষ করে দিবে।
কিন্ত ঈশাম ধৈর্য্যশীল। সব বিষয়ের উপর সন্তুষ্ট সে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’লা তাকে যে সিলেক্ট করেছেন, আল্লাহ তার মঙ্গল চান।
রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেন, আল্লাহ যার মঙ্গল চান তাকে দু:খ কষ্টে ফেলেন। ( বুখারি- ৫৬৪৫)।
ঈশাম ধৈর্য্য ধারন করছে কারন সে আল্লাহর ওয়াদার কথা ভুলে যায় নি। আল্লাহ নিজেই বলেছেন-
” ওহে যারা ঈমান এনেছ! সাহায্য কামনা কর ধৈর্য্য ধরে ও নামাজ পড়ে। নি: সন্দেহে আল্লাহ ধৈর্য্যশীলদের সাথে আছেন। ( বাকারাহ- ১৫৩)।
আল্লাহ সুবাহানাহু ওয়া তা’য়ালা ঈশামকে নীরাশ করবেন না।
ঈশামের এই কষ্টটাই হয়ত সুখের সাগরে ভাসিয়ে দিবেন।
আল্লাহ বলেন,
” আল্লাহ কষ্টের পর সুখ দিবেন।” ( তালাক – ৭)
” অতপর নিশ্চয় কষ্টের সাথে সুখ রয়েছে। নিশ্চয় কষ্টের সাথে সুখ রয়েছে। ( সূরা ইনশিরাহ- ৬-৭)।
.
ঈশামের চিকিৎসা চলছে। কিন্তু ক্যান্সার ঈশামের শরীরকে যেন একেবারেই নিস্তেজ করে দিচ্ছে। ঈশাম তাহাজ্জুদের নামাজ পরবে বলে উঠল। নীরার সেই কান্নার মাঝে নাক টানার শব্দ। নীরা ঈশামের আগে উঠেই নামাজ শুরু করে দিয়েছে। আর অঝোর ধারায় চোখের পানি পড়ছে। আল্লাহর কাছে ফরিয়াদ করছে,
” হে আল্লাহ! আমার ঈশামকে তুমি সুস্থ করে দাও! আমার ঈশামকে সুস্থ করে দাও! তুমি আমার কাছ থেকে আমার ঈশামকে কেড়ে নিও না। ওর আগে আমার মৃত্যু দাও। আমি কিছুতেই সহ্য করতে পারব না। ঈশামের মেয়ে ঈশামকে আব্বু আব্বু বলে ডাকতে পারবে না! আমি কিভাবে আল্লাহ সহ্য করব! হে আল্লাহ তুমি রহিম রাহমান! দয়ার সাগর! রাহমানির রাহিম! তুমি আমার ঈশামকে সুস্থ করে দাও। হে আল্লাহ তোমার কাছে আমার চাওয়ার কিছু নাই। আমার স্বামী কে সুস্থ করে দাও।
.
নীরা যেন আল্লাহর কাছে চেয়েই যাচ্ছে চেয়েই যাচ্ছে। নীরার দোয়ার বাক্যগুলি যেন ঈশামের বুকে এসে লাগছে। কি আকুতি! কি মিনতি আল্লাহর কাছে!
.
– নীরা আমার জন্য এক কাপ চা নিয়ে অাসো তো!
– ৫ মিনিটের মধ্যে চা নিয়ে নীরা হাজির।
– বস এইখানে।
– তাড়াতাড়ি চা খেয়ে নাও। ঠান্ডা হয়ে যাব।
– নীরু!
– জি বল।
– তুমি কি আমার সাথে জান্নাতে যেতে চাও?
– নীরা চোখের পানি ছেড়ে বলল, ইংশা আল্লাহ।
– তোমার চোখের পানি আমার সহ্য হয় না । যতদিন বেচে আছি আমি তোমার হাসিমুখ দেখতে চাই। আমি তোমার হাসি মুখটাই বড় ভালবাসি।
ঈশাম নিজের হাত দিয়ে নীরার চোখ মুছে দিয়ে বলতে লাগল,
রাসূলুল্লাহ ( সা) আয়েশা ( রা) বলেছিলেন,
তুমি কি সন্তুষ্ট নও যে, তুমি দুনিয়া ও আখিরাতে আমার স্ত্রী হয়ে থাকবে?
তিনি বললেন, জি হ্যা!
তখন নবী কারীম ( সা) বললেন- তুমি ইহকালে ও পরকালে আমার স্ত্রী। ( হাকিম, সিলসিলা সহীহাহ- ২২৫৫)।
আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তা’য়ালা কুরঅানে বলেছেন,
” তোমরা বেহেশতে প্রবেশ করো- তোমরা ও তোমাদের সঙ্গিনীরা তোমাদের আনন্দিত করা হবে। ( আয- যুখরুফ-৭০)
.
দুনিয়াতে আমরা স্বামী স্ত্রী একে অপরের জন্য অনেক কিছুই করি, এত এত ভালবাসি, তুমি হীনা আমার জীবন মরূভূমি, এত প্রেম কিন্তু আমরা এতই নির্বোধ যে, শুধু দুনিয়াতেই আমরা স্বামী স্ত্রী ভালবাসতে চাই। আল্লাহ দুনিয়ার নেককার স্বামী স্ত্রী দের যে জান্নাতেও মিলিয়ে দিবেন – সেই জান্নাতে যাওয়ার কাজ গুলো আমরা করি না। তাহলে কি ভালবাসলাম? একজন স্বামী স্ত্রী কে খুব মহব্বত করে। কিন্তু দুনিয়াতে আল্লাহর অবাধ্য। সে কি স্ত্রী কে দুনিয়াতেই পেতে চায়? আখিরাতে না? তাহলে এমন ভালবাসার মূল্য থাকল কোথায়? দুনিয়াতে শুধু ভালবাসলে হবে না, আখিরাতের জন্যও কিছু করতে হবে। দুনিয়াবি ভালবাসা যদি আখিরাতে কাজে তাহলে মন্দ কিছু না।
.
মুঅা’বিয়া ( রা) আবু দারদার বিধবা স্ত্রী কে বিবাহের প্রস্তাব দিলে তিনি নাকচ করে বলেন,
আমি আবু দারদাকে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ ( সা)বলেছেন – একজন মহিলা তার সর্বশেষ স্বামীর সাথেই জান্নাতে থাকবে। ( বাগাভী, তাবারানী সিলসিলা সহীহাহ- ১২৮১)।
.
তো? দুনিয়াতে তাহলে কি আল্লাহর অবাধ্য হওয়া যাবে? হলে কি জান্নাতে যেতে পারব? আর দুনিয়ার স্ত্রী কে নিয়ে কি জান্নাতে যেতে পারব?
আমরা যদি দুনিয়াতে নেককার হতে পারি তাহলে আল্লাহ আমাদের পরকালেও মিলিয়ে দিবেন আল্লাহ যদি চায়।
বুদ্ধিমানেরা স্বামী বা স্ত্রী কে শুধু দুনিয়াতেই পেতে চায় না। আখিরাতেও যাতে একসাথে থাকতে পারে সেইজন্য আল্লাহর কাজ করে । আর তাছাড়া নেককার সন্তানও জান্নাতে থাকতে পারবে আল্লাহ চাইলে।
.
নীরু! রোগ-শোক, দুখ কষ্ট, বিপদ আপদ এসব আল্লাহর তরফ থেকে পরিক্ষা।
আল্লাহ বলেন-
আমি অবশ্যই তোমাদেরকে কিছু না কিছু দিয়ে পরীক্ষায় ফেলবোই: মাঝে মধ্যে তোমাদেরকে বিপদের আতঙ্ক, ক্ষুধার কষ্ট দিয়ে, সম্পদ, জীবন, পণ্য-ফল-ফসল হারানোর মধ্য দিয়ে। আর যারা কষ্টের মধ্যেও ধৈর্য-নিষ্ঠার সাথে চেষ্টা করে, তাদেরকে সুখবর দাও। (আল-বাক্বারাহ ১৫৫)
তাহলে কি আমাদের উচিত নয় ধৈর্য্য ধারন করা?
.
বিপদ আপদ আসলে আমরা অনেক দুখ করি। বলি কেন আমার সাথে এরকম হয়? কেন আমাকে আল্লাহ এত পরীক্ষা নিচ্ছেন? ঠিক সেই মুহূর্ত একটি হাদিসই তার জন্য যথেষ্ট,
আয়েশা ( রা) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেছেন- মুসলিম ব্যক্তির উপর যে সকল বিপদ আপদ আসে এর দ্বারা আল্লাহ তার পাপ দূর করে দেন। এমনকি যে কাটা তার শরীরে ফুটে এর দ্বারাও। ( বুখারি- ৫৬৪০)।
সুবহানাল্লাহ!
মানুষের বিপদ আপদে আল্লাহ তার গোনাহ মোচন করে দেন। তাহলে আমি কি দুর্ভাগ্যবান? নিশ্চিয় না।
.
রাসূলুল্লাহ ( সা) বলেন, অনেক সময় মুমিনের উপর লাগাতার বিপদ আসতেই থাকে, যাতে করে জীবন্ত অবস্থায় তার সমস্ত গুনাহ মাফ হয়ে যায়। ( তিরমিজি- ২৩৯৮)।
.
এই হল আমাদের ইসলাম! পূর্ণাঙ্গ জীবন ব্যবস্থা। যেখানে আল্লাহ আমাদের বিপদ আপদেও গোনাহ মাফ করে দেন।
অনেকেই বলে যে, আল্লাহ আমাকে দেখে না, এজন্য আমার এত বিপদ, আল্লাহ আমাকে ভুলে গেছেন, আল্লাহ আমাকে দেখেন না বলেই এত বিপদ আপদ আমার।
তাদের জন্য, আল্লাহ বলেন,
আল্লাহর অনুমতি ছাড়া কোনো বিপদই আপাতিত হয় না। যে আল্লাহর প্রতি ঈমান আনে, আল্লাহ তার অন্তরকে সতপথে পরিচালিত করেন। আল্লাহ প্রত্যেক বিষয়ে সর্বজ্ঞ। ( সূরা আততাগাবুন- ১১)
.
আর নীরু! মৃত্যুকে এড়িয়ে যাওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। যখন যার মৃত্যু যেখানে যেভাবে লিখা আছে ঠিক সেই সময়ই হবে। এক মুহূর্ত এদিক ওদিক হবে না।
আল্লাহ বলেন-
যদি আল্লাহ লোকদেরকে তাদের অন্যায় কাজের কারণে পাকড়াও করতেন, তবে ভুপৃষ্ঠে চলমান কোন কিছুকেই ছাড়তেন না। কিন্তু তিনি প্রতিশ্রুতি সময় পর্যন্ত তাদেরকে অবকাশ দেন। অতঃপর নির্ধারিত সময়ে যখন তাদের মৃত্যু এসে যাবে, তখন এক মুহুর্তও বিলম্বিত কিংবা তরাম্বিত করতে পারবে না। (আন নাহল-৬১)
.
প্রত্যেক প্রানীই মৃত্যু বরন করবে। ধ্রুব সত্য কথা।
জীবমাত্রই মৃত্যুর স্বাদ গ্রহণ করবে। অতঃপর তোমরা আমারই কাছে প্রত্যাবর্তিত হবে। (আল কানাবুত -৫৭)
প্রত্যেক প্রাণীকে আস্বাদন করতে হবে মৃত্যু। আর তোমরা কিয়ামতের দিন পরিপূর্ণ বদলা প্রাপ্ত হবে। তারপর যাকে দোযখ থেকে দূরে রাখা হবে এবং জান্নাতে প্রবেশ করানো হবে, তার কার্যসিদ্ধি ঘটবে। আর পার্থিব জীবন ধোঁকা ছাড়া অন্য কোন সম্পদ নয়। (আলে ইমরান- ১৮৫)
.
আমরা মৃত্যু থেকে বেচে থাকতে চাই। কিন্তু মৃত্যু আমাদের কাছে আরও দ্রুতগতি তে ধেয়ে আসে। আমরা মৃত্যু থেকে পালাতে চাই যেই মৃত্যুই কিনা সময় হলে সামনে আসবে। কোনো টাল বাহানা চলবে না। আমরা মৃত্যুকে ভুলে গেলেও মৃত্যু আমাদের ভুলে যায় না।
বলুন, তোমরা যে মৃত্যু থেকে পলায়নপর, সেই মৃত্যু অবশ্যই তোমাদের মুখামুখি হবে, অতঃপর তোমরা অদৃশ্য, দৃশ্যের জ্ঞানী আল্লাহর কাছে উপস্থিত হবে। তিনি তোমাদেরকে জানিয়ে দিবেন সেসব কর্ম, যা তোমরা করতে। (আল জুমুয়া-৮)
.
তোমরা যেখানেই থাক না কেন; মৃত্যু কিন্তু তোমাদেরকে পাকড়াও করবেই। যদি তোমরা সুদৃঢ় দূর্গের ভেতরেও অবস্থান কর, তবুও। বস্তুতঃ তাদের কোন কল্যাণ সাধিত হলে তারা বলে যে, এটা সাধিত হয়েছে আল্লাহর পক্ষ থেকে। আর যদি তাদের কোন অকল্যাণ হয়, তবে বলে, এটা হয়েছে তোমার পক্ষ থেকে, বলে দাও, এসবই আল্লাহর পক্ষ থেকে। পক্ষান্তরে তাদের পরিণতি কি হবে, যারা কখনও কোন কথা বুঝতে চেষ্টা করে না। (আন নিসা-৭৮)
.
ঈশাম জান্নাত কে কোলে তুলে নিল।
– নীরু! আমার মেয়ের নামটা এমনি এমনি রাখি নি। জান্নাত নামটা যেমন সুন্দর তেমনি আমার সন্তান যেন আমাদের জান্নাতে যাওয়ার অসিলা হয়। সেই দায়িত্ব আমি যদি পালন করতে না পারি সেই দায়িত্ব তোমার। সন্তানকে মানুষের মত মানুষ এবং দ্বীনী শিক্ষায় শিক্ষিত করতে হবে । নেক সন্তান হল সদকায়ে জারিয়া। দুনিয়াতে আমরা মা বাবা সন্তানকে কিভাবে বড় করছি, সন্তানের জন্য কি রেখে যাচ্ছি এটা বড় কথা না, বড় হল আমরা সন্তানের মধ্যে কি শিক্ষা দিয়ে যাচ্ছি, তাকে দুনিয়াবি করে যাচ্ছি নাকি জান্নাতের পথ বাতলে দিচ্ছি। প্রথমে এসব মা বাবার উপরেই ন্যস্ত থাকে। সন্তানের পথ আমাদেরই করে দিয়ে যেতে হবে। আমরা যে পথ ওদের দেখিয়ে দিব সে পথেরই পথিক আমাদের সন্তানেরা হবে।
.
মানুষ মৃত্যুবরণ করলে তার যাবতীয় আমল বন্ধ হয়ে যায়, তবে ৩ টি আমল বন্ধ হয় না-১. সদকায়ে জারিয়া ২. এমন জ্ঞান-যার দ্বারা উপকৃত হওয়া যায় ৩. এমন নেক সন্তান- যে তার জন্য দু‘আ করে (সহিহ মুসলিম: ৪৩১০)
.
.
.
.
৩ বছর পর।
নীরার পেটে ঈশামের ৭ মাসের সন্তান।
সাড়ে ৩ বছরের মেয়ে জান্নাত বারবার আব্বু আব্বু বলে ডাকছে। কোনো সাড়াশব্দ নেই।
– আব্বু! আব্বু! উতো! আমি তকলেত খাব! তলো!
মেয়ের কথায় আজ বাবা সায় দিচ্ছে না। কারন আজ ঈশাম আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে।
খাটিয়া ধরে ছোট্ট মেয়ের আবদার। বাবার কাধে উঠে দোকানে যাবে। কি নিষ্ঠুর বাবা! এত ডাকে তবু উঠে না। কি ঘুমে আছে।
ছোট্ট মনি বাবার সাড়া না পেয়ে মায়ের কাছে এসে নালিশ করে,
– আম্মু জি! দেত, আব্বু উতে না।
নীরা জান্নাতকে ঝাপটে ধরে দুচোখের পানি ছেড়ে বলে,
আম্মুরে! তোমার আব্বুজি আর সাড়া দিবে না। তোমার আব্বু আল্লাহর কাছে চলে গেছে আমাদের ছেড়ে। আর আসবে না। আর তোমাকে নিয়ে বাইরে যাবে না মামুনি আমার। সবাইকে ছেড়ে দুনিয়া থেকে বিদায় নিয়েছে আম্মু। তুমি আর আব্বু বলে ডাকতে পারবে না!
ছোট মানুষ বুঝে না, মৃত্যু কি, কেন মা কানছে, কেন আব্বু সাড়া দিচ্ছে না , ছোট মানুষ এখনো বুঝে নি সে আর আব্বু করে ডাকতে পারবে না। তার আব্বু আল্লাহর ডাকে সাড়া দিয়ে এমন জগতে গিয়েছে সেই জগত থেকে কেউ ফিরে আসে না।
.
ঈশামের কড়া নিষেধ ছিল, যে কেউ মারা গেলে উচ্চ আওয়াজে যেন কান্না না করে। নীরার মুখে কোনো আওয়াজ নেই। শুধু দুচোখ যেন শ্রাবনের ধারা বইছে।
আমার ঈশাম! তুমি আমাদের একা করে চলে গেলে? আমাদের ক্ষমা করে দিও। তোমার মেয়ে তোমায় ডাকে, তুমি সাড়া দাও না, দেখ জান্নাত তোমার নামে নালিশ করছে, কিভাবে বুঝাই বল তুমি নাই। আমার পেটে তোমার সন্তান! ভূমিষ্ঠ হয়ে বাবার চেহারা দেখবে না, আব্বু বলে ডাকার ভাগ্য বুঝি তার হল না। আল্লাহ যেন জান্নাতে তোমার সাথে আমাদের মিলিয়ে দেন। আমরা সেখানে একসাথে থাকব ইংশা আল্লাহ। দেখিও সেখানে কাউকে হারানোর ভয় থাকবে না। ঈশাম! কিভাবে তোমাকে ছাড়া একা বিছানায় থাকব। বিয়ের পর কখনও আলাদা বিছানায় থাকি নি, আর আজ তোমাকে সবাই মাটির বিছানায় রেখে আসবে, কিভাবে আমি সহ্য করব বল! আমি তো আর মানতে পারছি না। আল্লাহ তোমার কবর কে জান্নাতের বাগান বানিয়ে দিন। ঈশাম! আমাকে বড় একা করে চলে গেলে!
আর কেউ নীরু বলে ডাকবে না, সোনা বউয়ের মান কেউ ভাঙাবে না, কেউ আর ঈশামের মত আদর করবে না, সন্তানকে আর নাম ধরে ডাকবে না, বাবা মেয়ের খুনসুটি আর হবে না। পরপারে চলে গেলে তুমি? ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
নীরার মনে হাজারো কথা মনে পড়ছে। চোখের পানি বাধ মানে না। আজ যে ঈশাম নীরার জীবন থেকে হারিয়ে গেল। সাদা কাফনে মোড়ানো ঈশাম। কিছুক্ষন পর কবরে রেখে আসবে ঈশামকে। আর বুঝি এক সাথে সংসার করা হল না।
.
মাগরিবের পর ঈশামের দাফন সম্পন্ন হল।
পুরো ঘর ফাকা ফাকা লাগছে। সব জায়গায় ঈশামের গন্ধ। দুষ্ট মিষ্টি ঈশাম আর নেই এই দুনিয়ায়। নীরার মোনাজাতে শুধু ঈশামের সাথে জান্নাতে থাকার দোয়া। কারন সেখানে তাদের কখনও বিচ্ছেদ হবে না। আল্লাহর কাছে এই দোয়া নীরার অশ্রুসিক্ত মুনাজাতে।
.
– ওমর! এই ওমর! উঠ বাবা! মাদ্রাসায় যেতে লেট হবে তো! আজ থেকে না তোমার ছুটি শেষ। উঠ বাবা। ফজরের সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে
ঘুম ঘুম চোখে ওমর উঠে সোজা ওয়াশরুমে চলে গেল।
২ য় সন্তান ওমর। ঈশাম আর নীরার। বয়স সাড়ে ৫ বছর। কুরঅানের হাফেজ বানাবে নীরা ওমরকে। বড় মেয়েকেও মাদ্রাসায় দিয়েছে। ১৬ পারার হাফেজা।
.
সকালে ওমরকে খাইয়ে রেডি করে দিল। সাথে মেয়ে জান্নাতকেও। দুইজনই একই মাদ্রাসায় পড়ে।
মাদ্রাসায় যাওয়ার আগে নীরা ওমরকে বলল,
– আব্বুর কাছে যাবা?
ওমর চিতকার করে বলল,
– আব্বু জিইইইইইইইইইই! হুম! হুম! যাব! যাব!
.
নীরা, জান্নাত আর ওমর ঈশামের কবরের কাছে গেল।
নীরা ও জান্নাত ঈশামের জন্য দোয়া করতে লাগল। নীরার চোখ দিয়ে যখনই অশ্রু গড়িতে পরল তখন নীরা ওমরের কাছ থেকে কিছু একটা শুনতে পেল।
ওমর তার দুইটি ছোট্ট হাত তুলে দোয়া করছে,
رَبِّ ٱرۡحَمۡهُمَا كَمَا رَبَّيَانِي صَغِيرٗا ٢٤ ﴾ [الاسراء: ٢٤]
‘‘হে আমার রব, তাদের উভয়ের প্রতি রহম কর, যেমন তারা আমাকে শৈশবকালে লালন-পালন করেছেন’’ [সূরা বানী ইসরাঈলঃ ২৪]
رَبَّنَا ٱغۡفِرۡ لِي وَلِوَٰلِدَيَّ وَلِلۡمُؤۡمِنِينَ يَوۡمَ يَقُومُ ٱلۡحِسَابُ ٤١﴾ [ابراهيم: ٤١]
‘‘হে আমাদের রব, রোজ কিয়ামতে আমাকে, আমার পিতা-মাতা ও সকল মুমিনকে ক্ষমা করে দিন’’ [সুরা ইবরাহীম- ৪১)
.
ছোট এই দুই হাতের দোয়া শুনে নীরা ওমরকে জড়িয়ে ধরে বলল,
-আব্বু! তুমি কিভাবে শিখলে?
– হুজুর শিখিয়েছে। বলেছে আব্বু আম্মুর জন্য এই দোয়া করতে । আমার আব্বু তো আল্লাহর কাছে। তাই আরও বেশি বেশি করে পরতে বলেছে।
নীরা ওমরকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরল।
– আব্বু আমার! সব সময় দোয়া করবে তোমার আব্বুকে যেন আল্লাহ অনেক ভাল রাখেন, জান্নাত দান করেন। ঠিক আছে। তোমাকে আল্লাহ দ্বীন এর পথে কবুল করুন। আমীন।
.
ঈশাম! জানি না কতটুকু পারব। কিন্তু আল্লাহ যেন আমার সন্তানদের দ্বীনের খেদমতে কবুল করেন। ঈশাম! তোমার সন্তানেরা দেখ আজ তোমার জন্য আল্লাহর কাছে হাত তুলে দোয়া করছে। জানি না আল্লাহ তোমাকে ওই কবরে কিভাবে রেখেছেন। আল্লাহ যেন তোমাকে জান্নাতুল ফেরদৌস নসীব করে। আল্লাহ এই ছোট ছোট দুই হাতের দোয়া কখনো ফিরিয়ে দিবেন না। আমরা সবাই জান্নাতে একসাথে হব। ইনশাআল্লাহ।
.
নীরা কবরের বাঁশের বেড়া একহাতে ধরে অশ্রুসিক্ত নয়নে বলে,
জান্নাতে যেতে চাই আমি ” তোমায় নিয়ে”।
.
আলহামদুলিল্লাহ।
সমাপ্ত।

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *