অর্ধাঙ্গিনীঃ2,3,4

অর্ধাঙ্গিনী

অর্ধাঙ্গিনী সকল পর্ব👈 

অর্ধাঙ্গিনী

২য় পর্বঃ
মোর্শেদা রুবি

♥♪♠♪♥
গত কয়েকদিন যাবৎ সারা বেশীই অসুস্থ হয়ে পড়েছে।তাই বাইরে বেরোতে পারছেনা।সেজানের নাম্বারে অনবরত কল দেবার পরও সে ফোন ধরছেনা এমনকি কল ব্যাকও করছেনা।এই ব্যাপারটা সারাকে আরো বেশী অসুস্থ করে ফেলেছে।সেজানকে সে অনেক বেশী বিশ্বাস করতো !কখনো মনে হয়নি ও সারাকে ধোঁকা দিতে পারে।সারা আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করেছে জারা আজকাল ওর সাথে কথা খুবই কম বলে। জরুরী দরকার ছাড়া কথা বলেনা।
সারা একদিন ওর হাত চেপে ধরল-“আপি,তুই খুব রাগ করেছিস,না?”
জারা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল-“আমার রাগে তোর কি যায় আসে?তোর যেটা ভালো লেগেছে, তুই করেছিস।কোনদিন আমার কোনো কথা শুনিসনি।আজ নিজেতো ডুবেছিস আমাকেও ডুবিয়েছিস!”
সারা মলিন কন্ঠে বলল-“আমিতো ওকে বিশ্বাস করেছিলাম আপি! আমার এমন কেন হলো! “
জারা রেগে বলল-“আগুনে হাত দেবার সময় যদি কেউ বলে আমিতো আগুনকে বিশ্বাস করেই হাত দিয়েছি তাহলে দোষটা কার? আল্লাহ কি আমাদের স্বাভাবিক জ্ঞান বুদ্ধি দেননি?বিয়ের আগে ছেলেমেয়ের অবাধ মেলামেশা ইসলামে হারাম।তুই তোর দুনিয়া আখেরাত দুটাই নষ্ট করলি।বল্,তোর এই বাচ্চা কি পরিচয়ে বড় হবে? ওর তো কোনো দোষ নেই অথচ তোদের অপকর্মের শাস্তি ওকে পেতে হবে!কেন?
কখনো ভেবেছিস, লোকে আমাকে কি বলবে?বলবে ওর বোন এমন এমন কাজ করেছে।কেউ সমন্ধ নিয়ে আমাদের বাসায় আসবেনা আর আমারো কোনোদিন বিয়ে হবেনা।বোন হয়ে তুই আমাকে এই উপহার দিলি?তাই না?”জারার চোখ পানিতে ভরে গেল।
.
সারা কিছু বলতে যাবে তখনি গেটের কাছে গাড়ীর হর্ণ শোনা গেল।সারা জানালার পর্দা সরিয়ে দেখল এক দীর্ঘদেহী লোক গাড়ী থেকে নামছে।ওদের বাড়ীতেই ঢুকছে।
সারা ত্রস্তে জারাকে বলল-“এই আপি,কে জানি এসেছে! সেজানের ভাই নাকি এটা দেখ্তো!”
জারা চোখ মুছে উঠতে উঠতে বেল বেজে উঠলো।জারা দ্রুত ভেতর ঘরে চলে গেল।সারা মাথায় ওড়না পেঁচিয়ে দরোজা খুলল।সালাম দিল।ভদ্রলোক দুহাত পকেটে ঢুকিয়ে মার্জিত কন্ঠে বলল-“এটা কি “জারা বিনতে জামান” এর বাসা?
-“জ্বী,জ্বী……আমি জারা’পুর ছোটোবোন সারা।আপনি প্লিজ,ভেতরে আসুন ভাইয়া!”
-“আচ্ছা,আপনিই সারা? আমার নাম “জাওয়াতা আফনান”,আমি সেজানের বড় ভাই”!
-“জ্বী,ভাইয়া বুঝতে পেরেছি,বসুন ভাইয়া!”
-“আসলে,আমি তোমার বড় আপুর কাছে এসেছি।ওনার সাথে এক মিনিট কথা বলে চলে যাবো,আমার তাড়া আছে”!
-” আমি বলছি আপুকে, আপনি একটু বসুন না ভাইয়া!’
আফনান একটা সোফায় বসল।সারা ভেতরে দৌড় দিল।মিনিট দুইয়ের মধ্যেই একটা চওড়া নীল ওড়না দিয়ে হাতপা শরীর সম্পূর্ণ ঢেকে জারা এলো।সে সোফায় বসলোনা,দুরে একটা ছোট টুলের উপর মুখ ঘুরিয়ে বসল!আস্তে করে সালাম দিলো।
আফনান ওর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে চোখ সরিয়ে নিল।মুখ নিচু করে বলল-“দুঃখিত,অসময়ে বিরক্ত করার জন্য।আসলে আমি জানাতে এলাম যে আমি আমার মা’র সাথে কথাটা শেয়ার করেছি।তিনি যথেষ্ট আপসেট,সেজানের উপর প্রচন্ড রেগেও গেছেন।বুঝতেই তো পারছেন,তিনি সেজানকে খুব বকেছেন… এমনকি সম্পত্তি থেকে বেদখল করার হুমকিও দিয়েছেন বাট……..!” আফনান চুপ করে গেলো!”
জারা বলল-“কিন্তু…..কি? বলুন? তিনি কি সারাকে মেনে নিতে চাচ্ছেননা?
আফনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“আমি আসলে ওদের দুজনের সাথে পেরে উঠছিনা।মায়ের জেদ একদিকে আর সেজানতো……সেতো সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে সে নাকি সারাকে মেনে নেবেনা!ওর পক্ষে নাকি এমুহূর্তে তা সম্ভব না।তার সম্মান, সামাজিকতা…..!আরো যা যা বলেছে সেটা না শোনাই ভালো।”
.
জারা মুখ নিচু করে আস্তে করে চোখ মুছল।আফনান সেটা টের পেলো!অপরাধীর সুরে বলল-“দেখুন,আমি এটা নিয়ে খুবই রাগারাগি করেছি সেজানের সাথে,বকেছি,তাকে জোরও করেছি কিন্তু…..(আফনান থেমে গেল)তারপর আবার বলল-“আমি আপনাকে এটাই বলতে এসেছি যে আমাকে একটু সময় দিন।আমি সেজানকে প্রয়োজনে বাধ্য করবো,আর মা কেও বোঝাবো,আর সারার যাবতীয় খরচ আমাদেরই।
সেটা এনি হাউ সারার কাছে পৌঁছে দেয়া হবে….আপনি এতটা ভেঙ্গে পড়বেন না……!”
.
-“আপনার অনেক দয়া,অনেক কষ্ট করেছেন আমাদের জন্য কিন্তু আফসোস….আমরা উপকৃত হতে পারলাম না” দীর্ঘশ্বাসের সাথে কথাগুলো বলল জারা।
.
আফনান কি বলবে ভেবে পেলোনা।জারা আস্তে করে উঠে পড়লে বলল-“চা দিচ্ছি, একটু বসুন”!
-“ওহ্,না না একদম সময় নেই।আমি বরং আসি,পরে যোগাযোগ করবো! যাবার আগে সারাকে দুটো কথা বলে যেতে চাই !”
.
জারা কিছু না বলে ভেতরে চলে গেল।প্রায় সাথে সাথেই সারা ঢুকল।সে গেটের কাছেই দাঁড়িয়ে ছিল।আফনান ওকে নিজের ফোন নম্বর দিলো আর যে কোন প্রয়োজনে ওকে বিনা সংকোচে জানাতে বলল, আরো কিছু টুকটাক কথা বলে সে চলে গেল।

দেখতে দেখতে মাসগুলো চড়ুই পাখির মত উড়ে উড়ে গেল।জারা বাবাকে সংক্ষেপে সব জানানো হলে তিনি তাড়াহুড়া করে দেশে চলে আসার প্রস্ততি নেন।
পরে সংবাদ আসে তিনি এয়ারপোর্টেই ভীষন অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে নিকটস্থ হাসপাতালে পাঠানো হয়েছিল।সেখানে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন,তাকে আরবের মাটিতেই দাফন করা হবে।সংবাদটা জারা দের কাছে পৌঁছালে ওরা দুবোনই পুরোপুরি ভেঙ্গে পড়ল।
.
ফুপির পরামর্শে সারাকে নিয়ে জারা সিলেটে চলে এলো।এখানে জারার বিধবা ফুপির এক বান্ধবী থাকেন।তার বাসার কাছে বাসা নিলো ওরা।ঢাকায় আত্মীয় স্বজনের নানান প্রশ্নের উত্তর দেয়া লাগবে,এখানে সেটা নেই।
সারা বলেছিল,আফনান ভাইয়াকে জানাই?
জারা রাগে বারণ করে দিয়েছে-“কোনো দরকার নেই!”
কিন্তু সারা গোপনে আফনানকে বিষয়টি ঠিকই জানিয়ে দিলো।
যথাসময়ে সারাকে সিলেটের একটা নার্সিং হোমে ভর্তি করানো হলো।দুশ্চিন্তায় জারার অসুস্থ হবার দশা।হাতে টাকাপয়সা ফুরিয়ে এসেছে।সারা চাকরী টিউশনি করে কিছু জমিয়েছিল আর আগে বাবা টাকা পাঠাতো এখন কি হবে!এখন তো সব পথ বন্ধ।এ দিকে সারার অবস্থাও বিশেষ সুবিধার না।জারা চোখে যেন পথ দেখতে পাচ্ছেনা।নামাজে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইলো।
.
সারাকে ওটিতে নেবার কিছুক্ষণ পর ডাক্তার জানালেন পেশেন্টের অবস্থা আশঙ্কাজনক।ভেতরে বাচ্চা ঠিকমত অক্সিজেন পাচ্ছেনা।বাচ্চাকে বাঁচাতে গেলে মাকে হারাতে হতে পারে।
দিশেহারা জারা মাকেই বাঁচাতে বলল।
ঘন্টাখানেক পর ডাক্তার মলিন মুখে এসে এক ফুটফুটে শিশুর জন্মের এবং তার সাথেই বাচ্চার মায়ের মৃত্যু সংবাদটি দিলেন।
জারার পায়ের নিচ থেকে যেন মাটি সরে গেল।শিশুটিকে কোলে নিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়লো জারা।ফুপিও নির্বাক হয়ে রইলেন।
এদিকে ক্লিনিকের মোটা অংকের বিল জমেছে।
.
এতোদিন সারা দেখে এসেছে এসব।
দিশেহারা জারা কেবিনে বসে আকাশপাতাল ভাবছে আর থেকে থেকে চোখের পানি মুছছে।এমন সময় নার্স এসে জানালো কাল দুপুর বারোটার মধ্যে কেবিন খালি করতে হবে।
জারা বলল-“মানে? আমরাতো এখনো বিলই দেইনি।
নার্স কাঠখোট্টার মতো বলল-“আপনাদের নতুন বাবুর বাবাই তো এসে বিল দিয়ে দিয়েছে!”
.
জারা বোকার মত তাকিয়ে রইল।নার্স বললো-“উনি বাইরে চাইল্ড স্পেশালিষ্টের সাথে কথা বলছেন,এলেই সব জানতে পারবেন!”
জারার ভেতরটা কষ্টে ফুঁসে উঠল।ভাবল-“আমার বোনের মৃত্যুর পর সেজানের আসতে ইচ্ছে হয়েছে?”
জারা কেবিনেই অপেক্ষায় রইল সেজানের।

এমন সময় গেটে নক হলে ফুপি উঠে দরোজা খুললেন।তার হাতে বাচ্চার ডাক্তারের ফাইল ধরিয়ে দিল কেউ একজন।ফুপি তা নিয়ে জারার হাতে দিলেন।জারা ঘোমটার আড়াল থেকে হাত বাড়িয়ে তা নিলো।
ফুপি বোধহয় ঐ সেজানকেই বসতে বলছেন-“বসুন,বাবা।”

জারা প্রস্তুতি নিলো সেজানকে কড়া কিছু বলবে।হঠাৎ ফাইলে বাচ্চার নামের নিচে গোটা অক্ষরে “জাওয়াতা আফনান” লেখা দেখে বিস্ময়ে মুখ ফিরিয়ে তাকালো চেয়ারে বসে থাকা লোকটার দিকে।ভুলে গেল ওর মুখে কোনো পর্দা নেই,ওড়না সরে গেছে।তাকিয়ে দেখে সেজান নয় বরং আফনান অর্থাৎ সেজানের বড় ভাই বসে আছে।জারার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগলো।আফনান ওর দিকে চরম বিস্ময়ে তাকিয়ে নিজেকে দ্রুত সামলে নিল।
জারাও মাথার ঘোমটা টেনে লম্বা করে বলল-“আ..আপনি?”।আফনান সামান্য কেশে নিয়ে বলল-“জ্বী,দুঃখিত পৌঁছুতে দেরী হহয়ে গেল।এখন চলুন, আমার সাথে” আপনার ব্যাগপ্যাক গুছিয়ে নিন!”
জারা পাথরের মত ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইল।কোনমতে বলল-“মানে?কোথায় যাবো আমি?”
আফনান কিছুক্ষণ চুপ থেকে বলল-“আমার বাড়ীতে”!
জারা মুখ ঘুরিয়ে সেই অদ্ভুত চোখে তাকালো-“আপনার বাড়ী?কেন?আর কিসের অধিকারে?আপনার বাড়ীতে আমি কেন যাবো?”
আফনান একবার ওর ফুপুর দিকে তাকালো।
তারপর জারার দিকে তাকিয়ে স্থির বিশ্বাসে ধীরে ধীরে বলল-“সেখানে যাবেন আমার অর্ধাঙ্গিনীর অধিকারে…….সসম্মানে! “
..

Online-Course
Online-Course

অর্ধাঙ্গিনীঃ৩য় পর্ব

মোর্শেদা খাতুন

আফনানের কথায় মনে হলো যেন ঘরের মধ্যে বাজ পড়েছে।
পিনপতন নিরবতা বিরাজ করছে।জারা মাথা নিচু করে বাচ্চার মুখের দিকে তাকিয়ে আছে চুপ করে।বাচ্চাটা মিহি শব্দেওঁ..ওঁ…করছে।ফুপু একবার জারাকে দেখছেন আরেকবার আফনানকে দেখছেন।
.
আফনান কথাটা বলে কিছুক্ষণ চুপ করে বসে থাকল যেন জারা কিছু বলতে পারে।কিন্তু জারাকে একেবারে নিশ্চুপ দেখে সে উঠে দাঁড়ালো।
সামান্য কেশে স্পষ্ট ভাবে বলল-“আমি জানি আপনি অনেক বড় একটা ভাবনাতে পড়ে গেছেন।প্রত্যেক মেয়েরই নিজস্ব কিছু স্বপ্ন থাকে,আপনারও থেকে থাকবে।জানিনা, আমার এই প্রস্তাবকে আপনি কি চোখে দেখছেন।শুধু এটুকু বলতে পারি,বিষয়টাকে অন্যভাবে নেবেননা প্লিজ।আপনাকে দয়া দাক্ষিণ্য কোনটাই করতে আসিনি আমি।বাচ্চাটা আমাদের বংশের সন্তান।জেনেশুনে তো এটাকে অগ্রাহ্য করতে পারবোনা !”!
.
জারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“আমার যে কি করা উচিৎ কেউ একটু বলে দেবেন?আমি স্থিরভাবে কিছু ভাবতে পারছিনা।বাচ্চাটাকে আপনাকে দিয়ে দিলে আমি নিজেও খুব একটা স্বস্তি পাবোনা।তাছাড়া ও আমার সারার সন্তান।আবার মন থেকে এটাও মেনে নিতে পারছিনা কেবল বাচ্চাটার জন্য আপনি আমাকে বিয়ে করতে বাধ্য হচ্ছেন!!”
.
আফনান ঠোঁটে ঠোঁট চেপে দুহাত পকেটে পুরে দিয়ে বললো-“বাধ্য হচ্ছি বলতে কি বুঝাচ্ছেন? আমাকে কে বাধ্য করবে?
জারা দেবার মত কোনো উত্তর খুঁজে পেলনা।
আফনান অসহিষ্ণু কন্ঠে বলে উঠল- “আমি কিন্তু প্রথমেই বলেছি আমি কোনোভাবেই আপনার প্রতি দায়বদ্ধ নই।হ্যাঁ,বাচ্চাটা আমাদের দায়িত্ব যেটা আমি কখনোই অস্বীকার করিনি।”
.
-“তাহলে আমাকে বিয়ে করতে চাওয়ার পেছনে আপনার ইন্টেনশনটা কি?(জারা মৃদু শব্দে বলে একটু চুপ থেকে বলল)-“আমি…আ..আমিতো কোনোভাবেই আপনার উপযুক্ত বা সমকক্ষ নই!”

আফনান নিরবে তাকিয়ে থাকল জারার দিকে।পাশ থেকে ওড়নার আড়ালে ওর ভারী খোঁপাটা চোখে পড়ছে।
আফনান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“আমার উপযুক্ত হতে হলে কি কি থাকতে হবে বলে আপনি মনে করেন?

মনে মনে কিছুটা তেতে উঠল আফনান,’আর কিভাবে বললে তুমি বুঝবে যে আমি তোমাকেই চাইছি,সেই প্রথম দিনেই বাধা পড়ে গেছি তোমার কাছে”!
কিন্তু মুখে শান্তভাব বজায় রেখে বলল-“তাছাড়া বাচ্চাটা আপনার কাছেই ভালো থাকবে।আপনি ওর খালামনি হন, আপনার চে বেশী আর ওকে কে ভালবাসবে বলুন ?”

আপনিও তো ওর চাচা হন!
আফনান কোনোকিছু না ভেবেই বলে বসল-“বাচ্চাটাকে পরিপূর্ণ ভালোবাসা আর যত্ন দিতে ওর একজন মা প্রয়োজন যেটা আপনি দিতে পারেন।তাই খালাকেই চাচীর স্থানে বসাতে চাচ্ছি”!
মনে মনে ভাবছে আফনান-“আর কত ধৈর্য্য পরীক্ষা নেবে জারা?”
জারা ভাবছে কিন্তু কোনো সিদ্ধান্ত নিতে পারছেনা।ওর বর্তমান পরিস্থিতির প্রেক্ষাপটে এটা নিঃসন্দেহে বিরাট একটা লোভনীয় প্রস্তাব কারন সে নিজে আজ অভিভাবকহীন একাকী।
সে একটু থেমে বলল-“সেজান আর আপনার মা??”
.
আফনান মাথাটা সামান্য কাত করে কপালটা চুলকে বলল-“এটা একটা ভাইটাল কোশ্চেন।তবে আমি এটা নিয়ে বিশেষ চিন্তিত নই।তাছাড়া আপনাকে তো আরেকটা কথা বলাই হয়নি,’সেজান কিছুদিন আগে মারাত্মক ভাবে ইনজিওরড হয়েছে একটা কার এক্সিডেন্টে! সেখানে ওর গাড়ী ছ ফুট নিচু খাদে পড়ে যায়!ওর অবস্থা আশঙ্কাজনক ছিল।পরে ওকে উন্নত চিকিৎসার জন্য বাইরে পাঠানো হয়েছে বাট…ওর পুরোপুরি সেরে ওঠার সম্ভাবনাও অনেক কম।যদি সেরে ওঠেও তবু সে কখনো স্বাভাবিক জীবনে ফিরে যেতে পারবে কিনা এ ব্যপারে ডাক্তারদের আশংকা রয়েছে !আমার আম্মা ওর সাথে আছেন সেখানে।’
আসলে আপনাকে অনেক কথাই বলার ছিল, কিন্তু সময় বা পরিস্থিতি কোনোটাই অনুকূলে নয়।তাই কেবল এতটুকুই বলব বাচ্চাটার স্বার্থে হলেও আমাদের এক হওয়া উচিত।
আপনি যাবার বিষয়টি বিবেচনা করবেন আশাকরি।
আমি আজ আসি ,যদি রাজী থাকেন তো কাল সকাল এগারোটার দিকে গাড়ী পাঠিয়ে দেবো,চলে আসবেন। আর হয়ত কাল রাতের ট্রেনেই ঢাকা ব্যাক করবো।আমি নিজেই আসতে চেয়েছিলাম কিন্তু আমি থাকলে আপনি হয়ত অস্বস্তি বোধ করতে পারেন,তাই…..”!
.
আফনান চলে যাবার জন্য দুপা এগিয়ে আবার ফিরে এলো-“আপনার অমত না থাকলে কালই আমাদের বিয়েটা হবে,ইনশাআল্লাহ।কারন,আপনার সম্পর্কে যতদুর জেনেছি,গায়ের মাহরামের সাথে আপনি সহজ হতে পারবেন না।আর আমি নিজেও চাইনা আপনি একটা মুহূর্তও কোনো পরপুরুষের সাথে সময় কাটান।
আর একটা কথা, আপনাকে পছন্দ না হলে গায়ে পড়ে বিয়ে করতে যাওয়ার মত অতটা উদার বোধহয় আমি নই।অবশ্য তারমানে এটাও না যে আমি আপনার ওপর স্বামীত্বের অধিকার খাটাবো! এটা আমার একতরফাই থাক।এ বিষয়ে আপনি নিশ্চিন্ত থাকতে পারেন।আপনি নিজে মন থেকে আমাকে মেনে না নেয়া পর্যন্ত আমি আপনাকে বিরক্ত করবোনা।”
আর…..আর একটা কথা,পরিস্থিতির কারনেই আপাতত চাচ্ছিনা মাকে বিয়ের কথাটা জানাতে।কিছুদিন পর তিনি দেশে ফিরলে তাকে আমিই জানিয়ে দেবো।এবার আপনি সিদ্ধান্ত নিন।এই যে কার্ডটা এখানে রেখে গেলাম।(ফুপুর দিকে একটা কার্ড বাড়িয়ে ধরল)আমার ফোন সারারাত আপনার ফোনের অপেক্ষা করবে।আসি।”
বলে আফনান আর দাঁড়ালো না।
.♥.

আফনান চলে যাবার পর জারা বাচ্চাটাকে আলতো করে শুইয়ে দিলো।ওর চোখ থেকে টপটপ করে পানি পড়ছে।ফুপু ওর কাঁধে হাত রেখে বললেন-“শোনরে মা,আল্লাহ তো তোকে সম্মাণিত করেছেন।বাচ্চার চাচার প্রস্তাবটা তোর জন্য আল্লাহর রহমত হয়ে এসেছে।কেন এটাকে ঠুকরাচ্ছিস।রাজী হয়ে যা।ছেলেটা খুব ভালো দেখেই মনে হচ্ছে।মাগো! চুল তো আর বাতাসে পাকেনি,লোক চিনতে এখন আর ভুল হয়না”!
.
রাত প্রায় বারোটা।বাচ্চাটা ঘুমাচ্ছে। ফুপুও অপর বেডে ঘুমাচ্ছেন কেবল ঘুম নেই জারার চোখে।ইস্তেখারার নামাজ শেষে মনটা হালকা লাগছে।সিদ্ধান্ত নেয়াটা সহজ হয়েছে।মনে পড়লো আফনানকে ওর সম্মতির কথাটা জানাতে হবে।এত রাতে ফোন দেবে কিনা ভেবে ভেবে কল দিয়ে ফেলল।রিং ঠিকমতো হয়ওনি অমনি কট করে রিসিভ করে ফেলল আফনান।যেন ফোন হাতে নিয়েই বসেছিল।
ভারী শব্দে বলল-“জ্বী বলুন”!
জারা ইতস্তত করে বলল-“জ্বী….গাড়ী ক’টায় আসবে?”
আফনান লাফ দিয়ে বিছানার উপর উঠে বসে ডানহাতটা সজোরে মুঠো করে ঝাঁকালো,মনে মনে বলল-“ইইইয়েসসস!”
ফোনে খুব শান্ত ভঙ্গিতে বলল-“এই ধরুন,এগারোটা কি সাড়ে এগারোটার দিকে ? ঠিক আছে?”
জারা মৃদু শব্দে বলল-“হমম”!
-“আপনার ফুপুকেও নিয়ে আসবেন।আমি চাই বিয়েতে তিনিও থাকুন!”
-“ফুপু গেলেও রাতে চলে আসবে উনি ঢাকা যাবেননা”!
-“আচ্ছা,ঠিকআছে।ছাড়ি তাহলে?আর একটা কথা!
,-“জ্বী বলুন!”
-“আফনান ভারী কন্ঠে বলল-“থ্যাংকস!”
-“থ্যাংকস না,বলুন,যাজাকাল্লাহ।”
-“যাজাকাল্লাহ”!
জারা ফোন নামিয়ে চেয়ে রইল বাচ্চার দিকে।
.
.♪♪..♥♪♪
পরদিন ঠিক এগারোটার সময় গাড়ী চলে এলো!ড্রাইভার নিজেই মালপত্র গাড়ীতে তুলল।ফুপু বাচ্চাটাকে নিজের কোলে রেখেছেন।ড্রাইভার গাড়ীর দরজা খুলে সরে গেছেন।জারা নিঃশব্দে উঠে বসল।
আধাঘন্টার মধ্যেই বিলাসবহুল একটা হোটেলের সামনে গাড়ী পার্ক করলো”!”বোরকা পড়া জারার নিজেকে এখানে অনাহুত মনে হতে লাগল।একজন নারী পোর্টার এসে সালাম দিয়ে সসম্মানে জারাকে পথ দেখিয়ে নিয়ে গেল।দুটো কামরা বুক করা হয়েছে,একটা জারা আর ফুপুর জন্য অন্যটা আফনানের।
.
সারাদিনে আফনান একবারো দেখা করলোনা।সন্ধ্যের সময় একজন মহিলা এসে জারাকে কিছু প্যাকেট দিয়ে গেল।সাথে একতোড়া ফুল আর একটা চিরকুট।
জারা চিরকুট খুলে দেখলো তাতে লেখা-“সারাদিন ইচ্ছে করেই আসিনি,ভেবেছি বিশ্রাম নেবেন।সাথে দেয়া প্যাকেটগুলোতে কিছু জামাকাপড় আছে।পছন্দ হবে কিনা জানিনা,এক বন্ধুর স্ত্রীকে দিয়ে কিনালাম।ওগুলো পরে নেবেন।রাতে একেবারে কাজী নিয়ে আসবো।ভালো থাকবেন।’
.
জারা প্যাকেটগুলো নেড়েচেড়ে দেখলো,তাতে দামী শাড়ী এবং হালকা গহনা রয়েছে।জারার এবার সত্যিই লজ্জা করতে লাগল।কোনোদিন ভাবেনি এভাবে অচেনা লোকদের মাঝে ওর বিয়ে হবে!
.
সন্ধ্যের দিকে জারা মাগরিবের নামাজ পড়ে উঠতেই গেটে নক হলো! গেট খুলতেই দেখলো দুজন মহিলা।যাদেরকে সারা চেনেনা।তারা সালাম দিয়ে নিজেদের পরিচয় দিল,তাদেরকে পাঠানো হয়ছে।তারা বৌ সাজাতে এসেছে।জারা কিছুটা বিরক্ত হলো, কি এক বিয়ে তার আবার সাজ!! আফনানকে বারকয়েক ফোন দিল জারা। কিন্তু আনরিচেবল আসছে।
.
অগত্যা জারাকে মেকাপ নিতে হলো।ওরা চুল বেধে একেবারে ভারী লেহেঙ্গাটা সুন্দরভাবে পড়িয়ে দিয়ে গেল।জারা চুপচাপ বসে ওদের কাজ দেখতে লাগল।বাচ্চাকে ফুপিই টেক কেয়ার করছে।সাজ শেষ হলে ওরা বলল-“ম্যাম দেখুন তো ঠিকআছে কিনা?”
জারা অনিচ্ছাসত্ত্বেও ঘুরে আয়নায় তাকাল।মনে মনে বেশ চমকে উঠল-‘ওরে বাবা,ওকে তো চেনাই যাচ্ছেনা।’
.
রাত নটার দিকে আফনান এল।ওর সাথে দুতিনজন ঘনিষ্ট অতিথি।ফুপুর বান্ধবীও এসেছে পরিবার নিয়ে।তিনিও আমন্ত্রিত। এসব নিশ্চয়ই আফনানের কাজ।এত হুলুস্থুলের কি দরকার ছিল?
.
পরের ঘটনাগুলো একের পর এক ঘটে গেল।বিয়ে পরানো হয়ে গেলো।সবাই মিষ্টি মুখ করলেন।অতিথিদের সবাইকে খাবারের জন্য ডাইনিং হলে নিয়ে যাওয়া হল।ফুপুও গেলেন।আফনান সবাইকে পঠিয়ে বলল-“আপনারা যান আমি একটু পর আসছি।”!
.
জারা সোফায় চুপটি করে বসে আছে।আফনান ওর কাছে গিয়ে হাটু গেড়ে কার্পেটে বসে বলল-“কি ভাবছেন?”
জারা মাথা নাড়ল’না,কিছুনা!”।
আফনান একটু হেসে বলল-“এখনতো আমি আর পরপুরুষ নই,ঘোমটাটা সরিয়ে কথা বললে ভালো হতোনা?আমি নিজেই সরাতাম আবার এটা ভেবে না বসেন স্বামীত্বের অধিকার ফলাতে এসেছি।”
.
আফনানের কথা শেষ হবার আগেই জারা আফনানের পাশে কার্পেটে বসে পড়ল।মেহেদীরাঙা জড়োয়া গহনায় ঢাকা ডান হাতটা দিয়ে আফনানের পা ছুঁলো!”
আফনান ওর হাত ধরে ফেলল-“এটা কি হলো?”
-“পা ছুঁয়ে সালাম করলাম, যেভাবেই হোক,আপনি আমার স্বামী।মাথা না নুইয়ে এভাবে সালাম করার অনুমতি ইসলামে আছে!”
.
আফনান দুষ্টামীর ছলে বলল-“ওও…..তা আমিও কি তাহলে ছুঁতে পারবো?মানে আমার তো অনুমতি আছে?”
জারা মাথা সোজা করে ওর দিকে তাকালো, অমনি ঘোমটাটাও খসে গেল।আফনান কথা ভুলে অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকল।দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল-“মাশাআল্লাহ”!
.
জারা হাসি চাপতে দ্রুত মুখ নামিয়ে নিল।আফনান মুগ্ধ চোখে ওর দিকে তাকিয়ে রইল।জারা নিরবতা ভেঙ্গে বললল-“দুজনই এভাবে ফ্লোরে বসে আছি,চলুন উঠি”!
দুজনই একসাথে উঠতে গেলে জারা ভারী লেহাঙ্গায় পা বেঁধে আফনানের গায়ের ওপর পড়ে যেতে নিল।আফনান দ্রুত ওকে ধরে ফেলল-“আরে সাবধানে”! হাঁটতে কষ্ট হলে বলুন,কোলে করে নিয়ে যাই”!
জারা ত্রস্তে সরে দাঁড়ালো-“আরে না না।”!
আফনান হেসে ফেলল-“ভয় পাবেননা।আপনার অনুমতি ছাড়া আপনাকে ছোঁবোনা,আপনি কিন্তু অলরেডী আমাকে দুবার ছুঁয়ে ফেলেছেন।
এটা কিন্তু চিটিং।”!
.
জারা এবার হেসেই ফেলল।আফনান সেদিকে তাকিয়ে মৃদু শব্দে বলল-“উফ,পাগল হয়ে যাবো”!
……

carnation Academy

অর্ধাঙ্গিনী

৪র্থ পর্বঃ
মোর্শেদা খাতুন

…………………..
সবাই চলে যাবার পর আফনান ঘোষণা দিল,আজ রাতে ঢাকা যাবার প্ল্যান ক্যানসেল করা হয়েছে।কারন এত ধকল সামলে আজ যাওয়াটা সবার জন্যেই কষ্টকর।দুদিন পরে গেলেও সমস্যা নেই।
.
ফুপিকে আরো দুতিনদিন তাদের সাথে থাকার জন্য বিশেষ ভাবে অনুরোধ জানালো আফনান।ফুপু সানন্দে রাজী হলেন, এতবড় হোটেলে থাকতেও তার বেশ লাগছে! তাছাড়া তার বিশেষ কোন তাড়াও ছিলোনা,এতদিন ওদের দুবোনের সাথে ছিলেন,আজ সেই প্রয়োজনটা ফুরিয়েছে।জারা স্বামীর সাথে নিজের সংসারে যাবে।ছোট্ট ভাড়া বাড়ীটা ছেড়ে দিয়ে তিনিও বান্ধবীর বাড়ীতে একটা রুম সাবলেটে থাকবেন।
.
সবার খাওয়া-বিদায় সম্পন্ন হলে আফনান ফুপুকে প্রশ্ন করলো -“একা থাকতে তার কোনো কষ্ট বা অসুবিধা হবে কিনা! ফুপু জানালেন তার কোনোই সমস্যা হবেনা।
জারা অবাক হয়ে বলল-“ফুপু একা থাকবে কেন,আমি কোথায় থাকবো ? “বলেই বুঝল ভুল করে ফেলছে।তাদের মধ্যে যত কথাই হোকনা কেন! সমাজের চোখে সে একজন বিবাহিতা।আর সদ্য বিবাহিতা নারী তার স্বামীর সাথেই থাকবে এটাই স্বাভাবিক।
জারা দুর্বল কন্ঠে বলল-” তাহলে বাবুকে রেখে যাবো?”
আফনান সহজভাবেই বলল-“তাহলে ওকেও নিয়ে নিন্,মানে নিয়ে নাও!” বলে সে ফুপুর দিকে তাকিয়ে বলল-“বাবুকে নিয়ে যাই ফুপি,কি বলেন ?”
ফুপি হেসে বললেন-“আজই তো তোমাদের বিয়ে হয়েছে,আজ তোমাদের বাসর! বাবুতো সারাজীবন তোমাদের কাছেই থাকবে।যে কদিন এখানে আছি সে ক’দিন আমার নানুভাইকে আমার কাছেই থাকতে দাও,তোমরা যাও।জীবনের এ সময়টা সব মেয়ের জন্যই মূল্যবান।আমার জারার সংসারটা আমার চোখের সামনেই শুরু হোক।” বলে তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে চোখ মুছলেন।জারা চুপ করে বোকার মত দাঁড়িয়ে রইল।
.
আফনানের মনে কি চলছে বোঝা গেলোনা।
সে ফুপিকে সবরকম সুব্যবস্থা করে সবকিছু গুছিয়ে দিল।প্রয়োজনে ফোন দিতে বলল।তারপর জারাকে ডাক দিলো-“চলো তাহলে?”
জারা ওর “তুমি” ডাক শুনে ওর দিকে তাকাল।
তারপর ধীরপায়ে হেটে বাবুর কাছে গেল।বাবু ঘুমিয়ে কাঁদা।ঝুকে আলতো করে ওর কপালে চুমু খেল।ফুপু উঠে দাঁড়িয়ে জারার কাঁধে হাত রেখে ওকে আফনানের কাছে আনলেন-“বাবা,আমি ওর মা নই কিন্তু ওকে পেটের মেয়ের চে কম ভালবাসিনা।আজ এমন একটা দিন যেদিন ওকে তোমার হাতে সমর্পন করার মত কেউ নেই।”বলে জারার ডান হাতটা তুলে ধরলেন আর আফনানের হাতটা ধরে তাতে রাখলেন। নিজের দুহাত দিয়ে ওদের দুহাত চেপে ধরে কেঁদে দিয়ে বললেন-“বাবা,আমার মেয়েটাকে তোমার হাতে তুলে দিলাম।ওর আজ থেকে তুমি ছাড়া কেউ রইলোনা।আমার মেয়েটাকে দেখে রেখো,ওকে কোনো কষ্ট দিওনা।ও বড় ভালো মেয়ে,ওর মত মেয়ে আজকাল হয়না।”
আফনান বলল-“আমাদের জন্য দুআ করবেন”!
ফুপু চোখ মুছে বললেন-“যাও ওকে নিয়ে যাও”!
জারা নিজেও কিছুটা ভাবাবেগে আপ্লুত হয়ে গেল।ফুপুকে জড়িয়ে ধরল।ফুপু ওর কানের কাছে ফিসফিসিয়ে বলল-“আজ থেকে তিনিই তোর সব। স্বামীর সম্মান সবার আগে মা”!
আফনানের দিকে তাকিয়ে বললেন-“রাত বাড়ছে,তোমরা দুজনই তো না খেয়ে আছো, যাও বিশ্রাম নাও”।
.
আফনান জারার হাত ধরে বেরিয়ে এল।গন্তব্য পাশের রুম ৩০২।ফুপুর রুম ৩০১।
আফনান লক বাটন ঘুরিয়ে দরজা খুলল।জারার হাতটা এখনো ওর হাতে ধরা।জারার মনে হচ্ছে আফনান প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশীই জোরে ধরেছে ওর হাতটা।জারার কাছে সবকিছু কেমন যেন স্বপ্নের মত লাগছে।
আফনান ভেতরে ঢুকে দরোজা লক করে দিলে মনে মনে কেঁপে উঠল জারা।লাইট জ্বালালে বিস্ময় নিয়ে ঘরটাকে দেখল জারা।ভীষন সুন্দর একটি বসার ঘর।তবে কেবল সোফা সাজানো, কোনো খাট নেই।আফনান ওকে বলল-“ভেতরে চলুন”। জারা অবাক হলো ওর পুনরায় আপনি বলা শুনে আর এবার হাতও ধরেনি।ওর সাথে হেঁটে ভেতরের রুমে গেলে ওর চোখ কপালে ওঠার দশা হলো! বিশাল বড় একটা রুম।পুরো ঘরটাকে আগাগোড়া গোলাপ রজনীগন্ধ্যা আর গাঁদা ফুল দিয়ে সাজানো হয়েছে।বিশাল গোল খাটটার উপর যে চাঁদোয়া ঝুলানো হয়েছে তা এককথায় অপূর্ব।কার্পেটের রঙটা চমৎকার।পা রাখলে পায়ের পাতা ডুবে যায়।আফনান বলল-“এটা একটা স্যুইট।আপনার পছন্দ হয়েছে?”
জারা মুখ নামিয়ে বলল-“জ্বী, আপনিই এসব সাজিয়েছেন!”
আফনান হাসল-“ঠিক আমি না,হোটেলের লোকদের বলেছি ওরা করিয়ে দিয়েছে।”
তারপর কিছুটা সিরিয়াস কন্ঠে বলল-“দেখুন,আমাদের দুজনের পারস্পরিক সমঝোতা অন্যের জন্য সমালোচনার কারন হতে পারে তাই আমরা সবার সামনে স্বাভাবিক ভাবেই থাকবো।চারদেয়ালের ভেতরে আপনি স্বাধীন, কি? কিছু বোঝা গেছে?”
জারা মাথা নাড়ল।মৃদু কন্ঠে বলল-“এভাবে কি আপনি খুশি?”
আফনান ওর কাছাকাছি এসে দাঁড়ালো-“খুশি বলতে?”
জারা তোতলাতে লাগল-“ন্ না মা মানে,এত আয়োজন করে বিয়ে করলেন অথচ নিজে কি পেলেন,আপনার রাগ হচ্ছে না?”
আফনান সোফা দেখিয়ে বলল-” বসে কথা বলি,চলুন! রাগ হবে কেন? একটু বুঝিয়ে বলুন!”
জারা নিরব।
আফনান হেসে বলল-“মনে হয় বুঝতে পেরেছি।জারা,বিয়ে মানেই বউ আমার সম্পত্তি, এমন তো না, আমি আপনাকে যে আমার পাশে পেয়েছি, আপনাকে দুচোখ ভরে দেখতে পারছি এটা আমার জন্যে অনেক বড় পাওয়া।আমরা কি পরস্পর ভালো বন্ধু হতে পারিনা?”
জারা মুখ তুলে তাকাল।মাথা নাড়ল-“জ্বী।”
আফনান বলল-” আমি আমার ওয়াদা ভুলিনি,ফুপির সামনে ওসব না করলে ওনার মনে খটকা থেকে যেতো।দেখেছেন তো! উনি কত খুশি?”
জারা বলল-“হুঁ…ঠিকই বলেছেন”!
আফনান এবার উঠে দাঁড়িয়ে জারাকে বলল-“কথা পরে অনেক হবে,আপাতত খাওয়া দাওয়া করি চলুন।পেটের নাড়ীভূড়ি হজম হবার যোগাড়।বলুন, কি খাবেন,আজ আপনিই অর্ডার করুন”!
জারা বলল-“আপনিই করুন না প্লিজ!আমি একটু চেন্জ করতে চাচ্ছি।তার আগে কিছু করনীয় আছে!”
আফনান বললো-“কি সেটা?”
জারা আফনানের দিকে এগিয়ে গিয়ে বলল-“আপনার ডান হাতটা আমার কপালের চুলগুলোর ওপর রেখে এই দুআটা পড়ুন।”বলে একটা কাগজের টুকরা এগিয়ে দিল।আফনান মন্ত্রমুগ্ধের মত কাগজটা হাতে নিয়ে জারার মাথায় হাত রেখে দুআটা পড়লো!
জারা দুআটার মর্ম সংক্ষেপে বুঝিয়ে দিল।

জারা হঠাৎ বলে উঠল-“এই যাহ্”!
আফনান বলল-“কি হলো!”
-” আমি জামাকাপড় তো সব ওই রুমে রেখে এসেছি।কি করবো এখন? যেয়ে নিয়ে আসবো?”
-“কোনো দরকার নেই।(বলে ড্রয়ার থেকে নতুন থ্রীপিসের সেট বের করে জারার হাতে দিল) এটা পড়ুন।একটা নাইটিও কেনা হয়েছে,আরামের জন্য পড়তে পারেন।
জারা কটমটে চোখে তাকিয়ে ওর হাত থেকে জামার প্যাকেটটা ছোঁ মেরে কেড়ে নিয়ে বাথরুমে চলে গেল।পনের বিশ মিনিট পর যখন বেরিয়ে এল তখন ওর মুখ একেবার ধোঁয়া মোছা।”!
আফনান সেদিকে তাকিয়ে বলল-” বাহ্! খুব সুন্দর মানিয়েছে তো জামাটা?এবার বসে পড়ুন তো,বেশ খিদে পেয়েছে”!
জারা নিজহাতে খাবার তুলে দিলো আফনানের হাতে।
আফনান প্লেট নিতে নিতে বলল-“আমি ভাবলাম,খাইয়ে দেবেন”!
জারা লজ্জায় লাল হয়ে নিজের প্লেট থেকে ছোটো লোকমা তুলে নিয়ে আফনানের দিকে এগিয়ে দিল।আফনান বলল-” স্বপ্ন দেখছি না তো?”
-“হয়েছে, নিন্! “আফনান জারার হাত ধরে মুখে খাবারটা নিলো।
.♥
খাওয়া দাওয়া সেরে জারা বারান্দায় এসে দাঁড়ালো।এতো উঁচু থেকে নিচের সবকিছু ছোট দেখাচ্ছে।পাশে আফনানের উপস্থিতি টের পেয়ে অভ্যাসবশতঃ ওড়নাটা মাথায় দিলো।আফনান মুগ্ধ দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে বলল-“ঘোমটা দিলে আপনাকে আরো বেশী দারুন লাগে”!আপনার চোখগুলো কিন্তু দারুন।কথা বলা চোখ।জানেন,যেদিন আপনাকে প্রথম দেখেছি,আপনার চোখ জোড়া আমাকে কাবু করে ফেলেছিল।তবে বেশী ভালো লেগেছে আপনার ঈমানদারীতা!”
-“ঈমানদারীতার কি দেখলেন?”
আফনান হাসল-“আপনাকে দেখার পর মনে হলো আপনি সাধারন নারী নন।আপনি আমার ভবিষ্যত।তাই আপনার ব্যপারে খোঁজখবর করা শুরু করলাম।যা জানলাম তাতে আপনাকে পাবার আকাঙ্খা আমার মধ্যে আরো তীব্র হয়ে উঠল।জারা মুখ নামিয়ে নিল।
আফনান বলে চলল-“জানেন তো,সমুদ্রে লক্ষ লক্ষ ঝিনুক থাকলেও মুক্ত সবটাতে থাকেনা।পথে চলতে ফিরতে পর্দা করা হিজাব করা মেয়ে প্রচুর দেখা যায়,তাদের কজনের ভেতর ঈমানের মহামূল্যবাণ মুক্তোটি আছে বলুন?”
-“যাহ্, আপনি বাড়িয়ে বলছেন,আল্লাহ মাফ করুন”! জারা হাসল।
আফনান বলল-“ঘুমুবেন না?”
-” জারার মুখের হাসিটি মুছে গেল।আফনান বলল-“আরে বাবা! ভয় পাচ্ছেন কেন?আমি কি ভয় পাবার মতো কিছু বলেছি?আসুন তো! “”
.
জারাকে বিছানায় তুলে দিয়ে আফনান সোফার দিকে পা বাড়ালে জারা ওর জামা পেছন থেকে টেনে ধরল।-“আমাকে এতটা গোনাহগার করবেন না, আসুন এই পাশ দিয়ে শুয়ে পড়ুন।স্টেডিয়ামের মত এত্ত বড় বিছানা! “
-“রাতে ঘুমের ঘোরে ভুলে আপনাকে জড়িয়ে টড়িয়ে ধরলে তখন কিন্তু আমাকে দোষ দেবেননা যেন!”
কথা শুনে লাল হয়ে গেল জারা।-“ইস্,আপনার মুখে দেখছি কিছুই আটকায় না!”
হাহাহা করে হেসে আফনান বালিশ টেনে শুয়ে পড়ল।বিছানার অপর পাশে গুটিশুটি মেরে জারা কাত হলো।আফনান বেড সাইড বাটন টিপে লাইট অফ করে দিতেই ঘর মৃদু মায়াবী নীলাভ আলোয় ভরে গেল।
আফনান ফিসফিসিয়ে বললল-“প্রচন্ড পিপাসা লেগেছে!”
জারা উঠে বসল-“কি বললেন?”
আফনানও উঠে বসে লাইট জালাল,বললাম পিপাসা লেগেছে।”
-“এর মানে?”
-“আপনি দেখছি বড্ড ঝগরাটে,পানিও চাইতে পারবোনা?”
জারা ওর দিকে বাঁকা দৃষ্টিতে তাকিয়ে শুতে যাবে তখনি হঠাৎ চিৎকার করে উঠল-“ওহ্ মাগো!”
আফনান দ্রুত ওর কাছে গিয়ে বলল-” কি,কি হলো?”
জারা ভয় ঘেন্নামেশানো দৃষ্টিতে ওর বাহুতে বসে থাকা এক বড়সড় পোকা দেখিয়ে চিৎকার দিল-“প্লিইজ,সরান এটাকে?”
আফনান প্রথমে খুঁজে পেলোনা পোকাটা।তাই ওর হাত পা ঘাড় পিঠে পোকা খুঁজতে লাগল।জারা রেগে গিয়ে বলল-“আপনি না আসলেই মহা ফাজিল,এখানে ওখানে কি খুঁজছেন?এই যে এটা এটা! উহ্…আল্লাহ গো!কি ভয়ংকর! “
আফনান টিসু নিয়ে সেটাকে চেপে ধরে বাইরে ফেলে দিল।
জারা ভয়ে ভয়ে বলল-“এখানে পোকা আসলো কোত্থেকে?”
আফনান বলল-“বুঝেছি,এগুলা ফুলের পোকা,এই সিজনে গাঁদা ফুলে একরকম পোকা হয়।ওরা বলেছিলো গাদাটাকে এভয়েড করতে।আমি ফুলগুলো সরিয়ে দেই ওরা সকালে রুম পরিস্কার করে দেবে।”
আফনান যথাসম্ভব ফুলগুলোকে একটা কর্ণারে সরিয়ে দিল।
পুনরায় লাইট নিভিয়ে বলল-“এবার শুয়ে পড়ুন”!আর পোকা আসবেনা!”
জারা দীর্ঘশ্বাস ফেলে শুয়ে পড়ল।ওর ভয় লাগছে কিন্তু কি আর করা।
ঘন্টাখানেক পর জারার চোখ লেগে এল।এরইমধ্যে স্বপ্ন দেখ জেগে উঠল।ওর চোখে পানি।আফনান জেগেই ছিল।দুর থেকেই বলল-“কি হলো? স্বপ্ন টপ্ন দেখেছেন?”
জারা কেঁদে ফেলল-“সারাকে দেখেছি।”
আফনান ডান হাত বাড়িয়ে জারাকে ডাকল-“এদিকে কাছে আসুন তো!”
জারা আগের তুলনায় অনেকটা সহজ।সে আফনানের কাছে এসে বসল-“এখানে শুয়ে পড়ুন।গত কয়েকদিনের ঘটনাগুলো আপনার মনে কঠিন ছাপ ফেলেছে তাই এমন হচ্ছে।আপনি শুয়ে পড়ুন।আমি জেগে আছি!”
জারা এবার সত্যিই পরম নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়ল।আফনানের চোখে যেটুকুও ঘুম এসেছিল তা মুহূর্তে উধাও হয়ে গেল।ওর কাছে এসে জারা আরামে ঘুমাচ্ছে কিন্তু জারাকে কাছে টেনে আফনানের আরাম হারাম হয়ে গেল।

চলবে…….

carnation newsletter
carnation newsletter

সংগ্রহ:-https://www.facebook.com/golpo.bhandar72/

অর্ধাঙ্গিনী সকল পর্ব👈 

carnation e book

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *